জাতীয়

সু-শাসনের ঘাটতির কারণে ২২ বছরেও কল্পনা চাকমার অপহরণের বিচার হচ্ছে না – সুলতানা কামাল

আমাদের দেশে যে বিচারহীনতা আছে, আইনের শাসনের অভাব আছে, সু শাসনের যে বিশাল ঘাটতি রয়েছে মানবতার প্রতি যে অশ্রদ্ধা অসন্মান করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি আমরা দাঁড় করিয়েছি সে কারনেই আমাদের কল্পনা চাকমাকে হারাতে হয়েছে এবং তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। আজ সকালে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়াতনে কল্পনা চাকমা অপহরণের ২২ বছর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও মামলার বর্তমান প্রেক্ষিত শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, দিনের পর দিন মানুষকে আইনের বাইরে রেখে দেওয়া হবে, আমাদের সংবিধানে বলা আছে কেউ আইনের বাইরে নয়, আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি কিছু মানুষ আইনের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ভালোভাবেও তাদের আইনের বাইরে রাখা হচ্ছে, মন্দভাবেও তাদের আইনের বাইরেও রাখা হচ্ছে। আইন সন্মতভাবে যেনো এ দেশে কিছু হওয়ার নয়। সে জন্যে মিতু হত্যার বিচার হয়না, তনু হত্যারও বিচার হয়না, এজহারভুক্ত আসামীরা চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় পুলিশ তাদের দেখতে পায়না।
কিছু প্রশ্ন করতে গেলে রাষ্ট্রের কাছে হয়তো উত্তর পাবো কোন প্রমান নাই, সাংবাদিকদেরই বলা হবে যে প্রমান যোগাড় করে দেন। মাদক অভিযানে যার নাম সবার আগে এসেছে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে সম্পর্কে বলেছেন তার নামে তথ্য আছে কিন্তু প্রমান নাই। অথচ প্রমান বের করার দায়িত্বে যারা আছে তারা কিছু করবেননা। কিন্তু যাদেরকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হচ্ছে তাদের সম্পর্কে কি প্রমান আছে সে ব্যাপারটা আমাদের প্রশ্ন হিসেবে দাঁড় করাতে হবে।
কল্পনা চাকমা সেই সংগ্রামের প্রতীক হয়ে আছেন যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা চাইছি এই দেশে আইনের শাসন ফিরে আসুক, বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি আছে তার অবসান ঘটুক, এ দেশের মানুষ তার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে যে অধিকার ভোগ করতে পারে সে অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হোক বলেও মন্তব্য করে্ন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল।
মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির তার বক্তব্যে বলেন, কল্পনা চাকমা অন্যায়ের প্রতিবাদ স্পষ্ট ভাষায় করেছিলো, সাহসী ছিলো, তার কাজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো, সে দৃঢ়ভাবে তার নিজের জীবন দিয়ে প্রত্যেকটা স্তরে তার কাজটা করতো। এ দেশের শোষিত বঞ্চিত মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে, যুদ্ধ করে স্বাধীন করা এ দেশে সব মানুষের মত সমান ভাবে তাদের কথা বলতে পারবে তাদের অধিকার আদায় করতে পারবে তা শাসকের পছন্দ নয়। এবং যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মত জায়গার প্রত্যন্ত এলাকার একটা মেয়ে এ ধরনের সাহস দেখায় তাকে শিক্ষা না দিলে অন্যরা সাহস পাবে এই হল চিন্তা এই হলো মানসিকতা। এই চিন্তা এই মানসিকতা থেকে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিলো। অপহরণ কারা করেছিলো সে কথা সবাই জানে।
তদন্ত কমিটির বিভিন্ন প্রকাশিত প্রতিবেদনকে হাস্যকর বলেও অভিহিত করেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এসপি আমেনার যে রিপোর্ট তাতে বলা হয় কিছু পায়নি দেখে এবং কল্পনা চাকমার সাক্ষ্য নিতে পারিনি বলে আমরা সঠিক ভাবে বলতে পারিনা বলেছে। যাকে অপহরণ করা হয়েছে তাকে কিভাবে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য পাওয়া যাবে, যদি তার সাক্ষ্য নেওয়া যেত তবে তো অপহরণের মামলায় হতোনা। হাস্যকর ব্যাপারগুলো কিভাবে নিয়ে আসে? এসব আমাদের এটাই বোজাচ্ছে যে এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা যা বিচার পেতে চাই, তা আমাদের দেয়া হবেনা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
একুশ বছরের একটা মেয়ে অধিকার চাইতে গেলে, পাহাড়ী আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, নারীর মর্যাদা, সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিজের মত করে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম একটু প্রতিবাদ-কথা বলা রাষ্ট্রযন্ত্র শাসক শ্রেণী সহ্য করতে পারেনা। প্রতিবাদ করলে হারিয়ে যেতে হয়, নিখোঁজ হতে হয়, নিরুদ্দেশ হতে হয় এবং ২২ বছর পর একটা ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়, ৩৯ বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয় এই হলো স্বাধীন বাংলাদেশ, ৪৭ বছরের বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র তার ব্যর্থতা স্বীকার করুক, লজ্জিত হোক, অনুতপ্ত হোক ২২ বছর পর কল্পনা চাকমার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ার জন্য, আমাদের কাছে না হলেও কল্পনা চাকমার ভাইয়ের কাছে, পার্বত্যবাসীর কাছে দেশের নাগরিকের কাছে।
এই রাষ্ট্রের হয়তো আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়া ও গ্লুকোমা রোগ হয়েছে। রাষ্ট্র ডিমেনশিয়া রোগের কারনে আদিবাসীদের ভুলে যায়, আর গ্লুকোমার কারনে আদিবাসীদের দেখতে পায়না বলেও মন্তব্য করেন সঞ্জীব দ্রং।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখীদাশ পুরকায়স্থ তার বক্তব্যে বলেন, কল্পনা চাকমাকে কেবল নারী হিসেবে স্মরণ করা হয়না, বরং তাকে জুম্ম আদিবাসীদের লড়াই সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে স্মরণ করা হয়। রাষ্ট্র আদিবাসীকে নিয়ে কি করেছেন, মেরে ফেলেছেন নাকি মাটিচাপা দিয়েছেন কেউ কিছুই বলতে পারছেনা।
তিনি বলেন, একটি অপরাধের যখন বিচার হয়না, তখন অনেক অপরাধ বাড়ে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি আদিবাসী নারীদের ক্ষেত্রে নারী হিসেবে ও আদিবাসী হিসেবে দ্বিগুন আকারে প্রভাব ফেলে।
পার্বত্য চুক্তি যতদিন বাস্তবায়িত না হবে ততদিন পাহাড়ে খুন ধর্ষণ অপহরণ হামলা বন্ধ হবেনা। পার্বত্য আদিবাসীদের অধিকার ও চুক্তি বাস্তবায়ন অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন রাখীদাশ পুরকায়স্থ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবাদ করলে খুন হতে হয়, অপহৃত হতে হয় ।পার্বত্য চট্টগ্রামে গুজব ছড়ানো হয়, প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখা হয়না, মিথ্যে প্রেস কনফারেন্স করা হয় এটাই পার্বত্য চট্টগ্রাম। আমার কাছে তাই, কল্পনা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমার্থক বলে বক্তব্য রাখেন লেখক ও সাংবাদিক বিপ্লব রহমান।
১৯৯৬ সালের অগাস্টে যখন পাহাড়ে গেলাম, কল্পনা চাকমাকে অপহরণের প্রতিবাদে হরতালে নিহত হওয়া রুপন, সুকেশ, মনোতোষ ও সমরের স্মরণে এক শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেখানে শতশত আদিবাসী নারী পুরুষ নীরবে অশ্রু ফেলছে। আমার স্মৃতিতে এখনো আমি তা ভুলতা পারিনা। সাংবাদিক হিসেবে আমি পাহাড়ে গেছি কিন্তু সাংবাদিক হলেও আমি মানুষ তাই আমার ভেতর এ সব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, পাহাড়ে গণহত্যা আমার উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে বিপ্লব রহমান বলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণের মামলায় গ্রেফতার তো দূরের কথা, তদন্ত কর্মকর্তা এজহারভুক্ত আসামী লেঃ ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও মো সালেহ আহম্মেদকে জেরাও করেনি। তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করেনি। তদন্ত কমিটি কল্পনা চাকমার গ্রামের বাড়ীতেও যায়নি। এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হলেই বা কি না হলেই বা কি!
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, কল্পনা চাকমা একজন সম্ভবনাময়ী রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। সমসাময়িক সময়ে রাজনীতি করলেও তার সাথে সম্পর্ক খুব বেশি জানা সম্ভব ছিলোনা নানান কারনেই। তবে আমি কল্পনা চাকমাকে পড়েছি, চিনেছি তার লেখা ডায়রীতে। যেটা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো।
তিনি বলেন, তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনায় অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পেরেছিলো। অনেক সাংবাদিক পাহাড়ে গিয়েছিলেন সে সময় এবং গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে গণমাধ্যমগুলো কী সে ভূমিকা রাখতে পারছে?
পার্বত্য অঞ্চল বিশেষ বাহিনীর শাসন চলে । তাদের ইশারাতেই সেখানে সব হয়। পার্বত্য এলাকার আইন আর দেশের অন্যন্য জায়গার আইন এক নয়।
চুক্তি হয়েছে ২০ বছর হয়ে গেছে, আপনারা বলছেন আমি ৯০-৮০ ভাগ বাস্তবায়ন করেছি এ ধরণের নানা কথা আমাদের শোনাচ্ছেন এটা এক ধরণের উপহাস, প্রতারণা করা। রাষ্ট্র যদি প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে, রাষ্ট্র যদি প্রতিশ্রুতিবিহীন থাকে, আদিবাসীদের না দেখে তবে কিভাবে দেখাতে হয় সেটাও আমাদের জানা আছে। পার্বত্য অঞ্চলে কান্না-বিলাপ বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্র যদি প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে, প্রতিশ্রুতিবিহীন থাকে, কথা বলা রুদ্ধ করে তবে পাহাড়ে দ্রোহের পরিস্থিতি গড়ে উঠবে, এই দ্রোহের দায় এই রাষ্ট্রকেই নিতে হবে বলেও বক্তব্য রাখেন তিনি।
ফাল্গুনী ত্রিপুরার সঞ্চালনায় আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক চঞ্চনা চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সহ-সভাপতি চদ্রা ত্রিপুরা। আলোচনা সভাটি আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়।

Back to top button