সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের’র সম্মান হারালে দেশের জন্য এটি হবে অপমানকর: সুলতানা কামাল

আজ সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি সম্মেলন কক্ষে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ‘সুন্দরবন ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের’র সম্মান হারালে দেশ ও জাতি হিসেবে এটি হবে একটি বড় অযোগ্যতা, ব্যর্থতা, লজ্জাষ্কর ও অপমানকর ।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র সহ-সভাপতি অ্যাড.সুলতানা কামাল । বক্তব্য রাখেন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডা.আব্দুল মতিন , জাতীয় কমিটির সদস্য শামসুল হুদা ও রুহিন হোসেন প্রিন্স ।
লিখিত বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন,সুন্দরবনের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় ও বনের অদূরে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের প্রেক্ষাপটে, ২০১৭ সনে পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪১তম সভায় বন রক্ষায় বাংলাদেশকে মূল কয়েকটি দায়িত্ব প্রদান করেছিল । তা হলো :“(ক). বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সে এলাকায় বাংলাদেশ কোন প্রকার শিল্পকারখানা বা বৃহদাকার অবকাঠামো নির্মানে অগ্রসর হবেনা। (খ). বন এলাকার ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনের লক্ষ্যে তার জলপথে নৌপরিবহন ব্যবস্থাপনা, নদীর ড্রেজিং বিষয়ে যথেষ্ঠ মাত্রার নিরাপত্তা কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। (গ). রাষ্ট্রকে (বাংলাদেশ) পশুর নদীর ড্রেজিং এর পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ নিশ্চিত করতে হবে। এরই মধ্যে সুন্দরবনের “বিশেষ বৈশ্বিক মূল্য” নিশ্চিত রাখতে হবে।(ঘ). রামপাল এর কারণে স্থানীয় বাতাস ও পানির দূষণ, নৌ চলাচল-ড্রেজিং, প্ল্যান্ট এর জন্য অধিক পরিমানে স্বাদু পানি প্রত্যাহার প্রভৃতি কারণে সম্ভাব্য প্রভাব বিষয়ে সমীক্ষা করা জরুরী। এসব কাজ ‘দক্ষিণ এলাকার কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা’র পূর্বেই সম্পন্ন করতে হবে।”
এসব বিষয়ে সরকার ২০১৮ সনের ডিসেম্বর মাসে গত দুই বৎসরে সুন্দরবন রক্ষায় তাদের কৃত কাজ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ইউনেস্কোর কাছে পেশ করেছেন। প্রতিবেদনটি একটি অপ্রকাশিত বা গোপন প্রকৃতির দলিল। সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিবেদনের একটি কপি প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে কিন্তু এখনও তা দেয়া হয়নি।
তবে গণমাধ্যম সূত্রে আমরা অবগত হয়েছি যে, বাংলাদেশের প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর ইউনেস্কোর ‘বিশ^ ঐতিহ্য কেন্দ্রে’র পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সুন্দরবন বিষয়ে একটি সুপারিশ প্রস্তুত করেছে যা আসন্ন ‘বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি’র সভায পেশ করা হবে। এ বিষয়ে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র’ বন রক্ষায় বাংলাদেশের কৃত কাজ সন্তোষ জনক না হওয়ার কারণে আমাদের জাতীয় গর্ব, সম্পদ ও নিরপত্তা বর্ম সুন্দরবনকে ইউনেস্কোর “বিপদাপন্ন ঐতিহ্য” তালিকাভুিক্তর সুপারিশ করেছে। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৩ তম সভা আগামী ৩০ জুন থেকে ০৮ জুলাই পর্যন্ত ২০১৯) আজেরবাইজানের রাজধানী ‘বাকু’ শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।সভায় বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের সুপারিশ সমূহের উপর আলোচনা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হবে। সুন্দরবন বিষয়ে ’কেন্দ্রের’ সুপারিশ যদি ’কমিটি’ চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহন করে, তাহলে সুন্দরবন তার বর্তমান ‘ঐতিহ্যে’র সম্মান হারাবে। অর্থাৎ সম্মান হারাবে বাংলাদেশ ।সারা বিশ্বে দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এটি একটি বড় অযোগ্যতা, ব্যর্থতা, লজ্জাষ্কর ও অপমানকর বিষয় হিসেবে পরিগণিত হবে।”
সুলতানা কামাল বলেন, সরকার যেহেতু সুন্দরবন ও পরিবেশের প্রতি যতœশীল নয়, সেক্ষেত্রে বন রক্ষায় আমরা ইউনেস্কোর এই পদক্ষেপকে দৃঢ় ভাবে সমর্থন করছি। তিনি বলেন, “আমাদের জাতীয় সম্পদ সুন্দরবন এখন ধ্বংসের সর্বোচ্চ হুমকির সম্মুখীন। তার নানাবিধ কারনের মধ্যে রয়েছেঃ (১). নদী বিনষ্টকরণ ও জলবায়ু পরিবর্তন, (২). জলোচ্ছাস, (৩). চিংড়ি চাষ ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা, (৪). পশু শিকার, গাছকাটা, প্রাণী বিলুপ্তি, (৫). নৌ-পথ অব্যবস্থাপনা, জাহাজ ডুবি, অপরিকল্পিত পোল্ডার ও মাছ শিকার, (৬). জনপদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংকট ও (৭). ধ্বংসাত্বক উন্নয়ন ও বন দখল। আর সর্বশেষ বিষয় “ধ্বংসাত্বক উন্নয়ন ও বন দখল” সমস্যাটির মধ্যে রয়েছেঃ সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে নির্মিয়মান ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন প্রবল ভাবে বিতর্কিত, গণ নিন্দিত ভয়ংকর রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। গণমাধ্যম সূত্রে বনের পাশেই ফার্নেস তেল ভিত্তিক আরেকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন, বনের কাছে বিমানবন্দর, ইপিজেড আদলের শিল্পায়ন পরিকল্পনা জাতীয় তথ্যও আমরা জেনেছি। বনের পাশ ঘিরে ১৫০টি শিল্প প্লট প্রদান করা হয়েছে, তার মধ্যে ২৮টি ‘লাল’ ক্যাটাগরীর শিল্পায়নের জন্য নির্দ্দিষ্ট। হাস্যকর ভাবে লাল ক্যাটাগরীর এলপিজি প্ল্যান্টকে সরকারী আদেশের মাধ্যমে ‘সবুজ’ করা হয়েছে। এছাড়াও বনের ভিতরে বা পাশেই তৈরী হয়েছে সিমেন্ট কারখানা, সাইলো গুদাম। এমনকি প্রভাবশালী রাজনৈতিক কিছু ব্যক্তি বনের ভিতরে বা পাশে জমি ক্রয় করে মালিকানার সাইনবোর্ড টানিয়েছেন। বনের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে সরকারী মোবাইল ফোনের টাওয়ার, অথচ এর পরিবেশগত বিশেষ করে গাছ ও প্রাণীকুলের প্রজনন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব সারাবিশে^ই সবাই জানেন। সুন্দরবনের ৪০কিমি পূর্ব দিকে পায়রা এলাকায় মোট ৪টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মান করা হচ্ছে, একটির কাজ চলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রতিঘাত মোকাবিলায় অক্ষত-সতেজ সুন্দরবন একটি বিশাল প্রয়োজনীয় বিষয়। এই প্রতিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর কাছে যে ন্যায়সিদ্ধ আকাংখা বা প্রাপ্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে, তার সাথে কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সুন্দরবনের প্রতি সরকারের অবহেলামূলক মনোভাব প্রবলভাবে স্ববিরোধী। এই বন ধ্বংস হলে দীর্ঘ উপকুল বিশাল ভাঙ্গনের মুখে পরবে, ছোট বড় জলোচ্ছাসের আঘাত হবে চরম বিধ্বংসী, উপকুল ডুবতে থাকবে, আমাদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিঘাত বৃদ্ধি পাবে।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়,দেশী ও বিদেশী, সর্বাধুনিক ও সঠিক বিজ্ঞান ভিত্তিক, অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ বিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা রামপাল প্রকল্প বিষয়ে ১৩টি প্রতিবেদন প্রকাশ ও তা একজন উর্ধ্বতন সরকারী সচিবের আহ্বানে এর সবগুলোই প্রায় দেড় বছর পূর্বে তার বরাবর জমা দেয়া হয়েছে। সচিব মহোদয় এসব বিষয়ে উন্মুক্ত বিতর্কের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন ।আমরা তার এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহন করেছিলাম। কিন্তু আমাদের গবেষণাপত্র দেখার পর, আমরা একাধিকবার তাগাদা দেয়া স্বত্তেও তিনি এ দীর্ঘ সময় ধরে নিরব রয়েছেন। কারণ আমরা পরিস্কার করে দেখিয়েছি যে,তাদের আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল যন্ত্রপাতি আসলে দূষণ রোধে পূর্ণাঙ্গ সফল কোন প্রযুক্তি নয়, এতে কয়লার ব্যবহার ১০% কম হয়, দূষণের মাত্রা ও ঘনত্ব একই থাকে। আসলে এই প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সরকার সঠিক বিজ্ঞানের ভিত্তিতে রামপালের যন্ত্রপাতির উপযোগীতা ও সম্ভাব্য দূষণ পরিমাপ বা প্রশমণ, কোন কিছুই করছেনা। আন্তর্জাতিক জ্বালানী গবেষণা প্রতিষ্ঠান আ.ই.ই.ফা তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশ সরকারের সামগ্রীক উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানী বা বিদ্যুৎ, সম্পূর্ণ বিকল্প উৎস ও প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করা সম্ভব; কয়লা ও পারমানবিক প্রক্রিয়া ব্যবহারের কোন প্রয়োজন নেই।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়,”সুন্দরবন নিয়ে সারা দেশের ও বিশ্বের সকল সুন্দরবন ও পরিবেশ প্রেমি মানুষই উদ্বেগাকুল দিন অতিবাহিত করছেন, দেশের শত ভাগ মানুষ রামপাল সহ সকল প্রকল্পের সম্পূর্ণ বাতিল চান।আমরা চাই সরকার তার ভুল অবস্থান থেকে সরে এসে রামপাল প্রকল্প বাতিল করুন, বন বিরোধী সকল স্থাপনা উৎখাত করুন এবং বনের প্রাকৃতিক চরিত্রকে সংরক্ষণ, সমৃদ্ধ করণে সঠিক পদক্ষেপ নিন ও দেশে যথেষ্ঠ পরিমানে (কয়লার) বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ তৈরী করুন। বন রক্ষায় আমরা সরকারের পাশে থাকবো।”
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডা. আব্দুল মতিন বলেন, সুন্দরবন এলাকায় উন্নয়নের নামে ধ্বংস চলছে। আমরা সবাই উন্নয়ন চাই, তাই বলে পরিবেশ ধ্বংস করে, বন ধ্বংস করে সে প্রকল্প চাই না। আমরা কেউ বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরুদ্ধে না। আজ ব্যাংক উজাড় করে সুইস ব্যাংকে টাকা রাখা হচ্ছে সেদিকে কারো নজর নেই। আবার আমরা বন ধ্বংসের বিষয়ে প্রতিবাদ করলে নেতিবাচক কথা বলা হয়। এটা হাস্যকর, লজ্জার।