জাতীয়

সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী প্রধান-এর স্মরণসভা

মানিক সরেন: সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক, নিপীড়িত ও অধিকারবি ত মানুষের লড়াকু প্রিয়নেতা শাহজাহান আলী প্রধান-এর স্মরণসভা আজ সকাল ১০.৩০টায় সেগুনবাগিচাস্থ ঢাকা রির্পোটার্স ইউনিটি গোলটেবিল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, জনউদ্যোগ, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন, এএলআরডি, কাপেং ফাউন্ডেশন, ব্রতী, আইইডি, সিডিএ, আসক, নাগরিক উদ্যোগ, নিজেরা করি, ব্লাস্ট ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর যৌথ উদ্যোগে স্মরণ সভাটি আয়োজন করা হয়।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন এর সভাপতিত্বে আয়োজিত স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন ঐক্যন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)’র বজলুর রশীদ ফিরোজ, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়নের উপদেষ্টা দিবালোক সিংহ, জনউদ্যোগ গাইবান্ধার সদস্য সচিব প্রবীর চক্রবর্তী, সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. রেজাউল করিম মাস্টার, সহ-সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্কে, শাহজাহান আলী প্রধানের জ্যেষ্ঠ সন্তান জাফরুল্লাহ প্রধান, হরেন্দ্রনাথ সিং প্রমুখ। এছাড়াও বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষজন স্মরণসভায় উপস্থিত থেকে শাহজাহান আলীর আত্মার শান্তি কামনা করেন।
স্মরণ সভায় পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য বলেন, শাহজাহান আলী প্রধান কৃষক শ্রেনী থেকে গড়ে ওঠা একজন নেতা ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নিপীড়িদের কোন জাত নেই। সে সাঁওতাল হোক বা বাঙ্গালি হোক। তাইতো তিনি বাঙ্গালি-সাঁওতাল মিলে আন্দোলন করেছেন। সাঁওতালদের সাথে রাত কাটিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, বাগদা ফার্মে সাঁওতালদের উপর যে অন্যায় হয়েছে সেটি একধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। নাসিরনগরে, লঙ্গদুতে যে সহিংসতা সেগুলোও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। রাষ্ট্র যদি এগুলো আমলে না নেয় ও এধরনের সন্ত্রাসবাদিতা বন্ধ না করে তাহলে এর পরিণাম একদিন রাষ্ট্রকেই ভোগ করতে হবে।
বাগদা ফার্মে আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানে সাঁওতাল-বাঙ্গালিদের পুনর্বাসন করার প্রহসন চলছে। রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা বুঝেনা আদিবাসীরা এধরনের গুচ্ছগ্রামে কোনদিন থাকবে, এটা তাদের সংস্কৃতির সাথে যায়না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের লেবাসে যারা বর্তমানে দেশ শাসন করছে তারা প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসন চালাচ্ছে। তাই শাহজাহান আলী প্রধানদের মতো শ্রমিক কৃষক শ্রেনীর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে আগামী দিনে রাজপথে লড়াই সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, যারা ন্যায়ের পক্ষে গরীব মানুষের পক্ষে কাজ করেন ও জীবন উৎসর্গ করেন তাদেরকে এ রাষ্ট্র স্মরণ করেনা। বরং যারা টাকা পয়সা লুট করে, ব্যাংক ডাকাতি করে সেসব ভিআইপি মানুষজন রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি আরো বলেন, সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের ন্যায়সঙ্গত ও আইনসঙ্গত আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি। এ সংগ্রামের একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে শাহজাহান আলী প্রধানের রেখে যাওয়া সংগ্রাম আগামী দিনে সেখানকার অসমাপ্ত ভূমি আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তুলতে প্রেরণা হয়ে থাকবে। সাথে সাথে তিনি, চিনিকল কর্তৃপক্ষের দ্বারা সেখানকার জমি বিত্তশালীদের লীজ দেওয়ার সমালোচনা করেন এবং চুক্তি অনুযায়ি অধিগ্রহণকৃত জমি প্রকৃত জমির মালিকদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, রাষ্ট্র এখন ধনীক শ্রেনীর হাতে নিয়ন্ত্রিত যেখানে গরীব মেহনতি মানুষের কথা শোনার কেউ নেই। শাহজাহান আলী ক্যান্সারে মারা গেছেন, চিকিৎসা করতে পারেননি। রাষ্ট্র ব্যবস্থাও ক্যান্সারে আক্রান্ত যার শিকার গরীব কৃষক মেহনতি মানুষেরাই বেশী হচ্ছে।
শাহজাহান আলীর জ্যেষ্ঠ ছেলে জাফরুল্লাহ প্রধান, আমার শৈশব থেকে দেখেছি আব্বা কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি। সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আমরা ছোটবেলা থেকেই আব্বার মুখে শুনতাম কোনদিন মিল বন্ধ হলে আমারা আমাদের বাপ-দাদাদের জমি ফেরত পাবো। কিন্তু এখনো ফেরততো পেলামনা বরং নানা ধরনের হুমকি ধামকি ও মামলার শিকার হচ্ছি।
রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, শাহজাহান আলীর মৃত্যুতে চিনিকল কর্তৃপক্ষসহ শাসক শ্রেনীর অনেকেই উল্লাস প্রকাশ করেছেন তারা হয়তো ভাবছেন বাগদা ফার্মের আন্দোলন এবার থিতিয়ে পড়বে। কিন্তু আমরা তাদের জানাতে চাই একজন শাজাহান আলী মরলেও হাজার শাহজাহান জন্ম নিয়েছে। তিনি এই শোক সভা থেকে আগামী ১৬ জানুূয়ারি ২০১৮ তে উত্তরবঙ্গের সকল জেলা উপজেলায় শহীদ মিনারে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মে সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষনা দেন।
বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও শাহজাহান আলী কখনো আন্দোলনরত জনগণকে তার অসুখের কথা বলেননি যাতে তারা বিচলিত না হয়ে পড়েন। এ থেকেই বোঝা যায় তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্র গরীব মানুষের জমিই সবসময় অধিগ্রহণ করে কিন্তু বড়লোকদের জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনা।
দিবালোক সিংহ বলেন, বাগদা ফার্মের আদিবাসী-বাঙ্গালিদের প্রতি যারা অন্যায় নিপীড়ণ করছেন তাদেরকে বিচারের আওতায় কেন আনা হচ্ছেনা? এটা কি রাষ্ট্রের অনিচ্ছা। যদি তাই হয় তাহলে বাগদা ফার্মের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলন সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই। আন্দোলন করেই শাহজাহান আলী প্রধানের অসমাপ্ত কাজকে আগামী দিনে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।
শামসুল হুদা বলেন, শাহজাহান ভাইয়ের অসামাপ্ত আন্দোলনকে মাঠের লড়াইয়ের মাধ্যমেই আদায় করে নিতে হবে। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু তারা এখনো কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আমরা দেখছি সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী, গরীব বাঙ্গালি মানুষদের প্রতি রাষ্ট্র বা এর সাথে জড়িত প্রভাবশালীরা নানা ধরনের হামলা নির্যাতন করে যাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
রেজাউল করিম মাস্টার বলেন, শাহজাহান ভাই সাধারণ মানুষ, এই আন্দোলন তাদের হাত দিয়েই শুরু হয়েছে। তিনি একবার বলেছিলেন আমৃত্যু এই আন্দোলনের সাথে থাকবেন। তিনি হয়তো এই আন্দোলনের সফলতার মুখ দেখতে পারেননি। কিন্তু তার যে আত্মত্যাগ, অবদান এসব কিছুই আমাদের ভবিষ্যতের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে প্রেরণা যোগাবে।

Back to top button