মতামত ও বিশ্লেষণ

সাজেকের ভুলে যাওয়া বাংলাদেশী নাগরিকগণের খাদ্যাভাব

সাজেকে খাদ্যাভাব হওয়া নতুন বিষয় নয়। তবে তার মানে মোটেই এটা নয় যে তা অনিবার্য। সাজেকের অনেক বাসিন্দা হয়তো তাই মনে করে বসছে। তারা করতে পারে। বাস্তব ও করুন অভিজ্ঞতা থেকে। আমরা পারিনা।

সীমান্তবর্তী রেংখ্যং রিজার্ভ ফরেস্টের অধিবাসীদের কথা লিখতে গিয়ে তাদেরকে একবার “বাংলাদেশের ভুলে যাওয়া নাগরিক” (Forgotten Citizens) হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলাম। এই অভিদা কার্যকরভাবে সাজেকের মানুষের বেলায়ও বর্তায়।

সাজেকের বিশেষ প্রেক্ষিত

সাজেকের প্রশাসনিক, ভৌগলিক, প্রতিবেশগত, জনতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার ব্যাপারে বিস্তারিত না জানলেও মৌলিক ধারনা না থাকলে এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সহ যথোপযুক্ত উন্নয়ন সহায়তা দেয়া সম্ভব নয়। অন্তত মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের ক্ষেত্রে। আর স্বল্প মেয়াদের ক্ষেত্রেও কি ধরনের খাদ্য দ্রব্য কোন এলাকায় বেশী যথাযথ, প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে এবং সরবরাহের সুবিধা ও অসুবিধার প্রেক্ষাপটে কোন এলাকার জন্য কোন কৌশল অবলম্বন করতে হবে, এর জন্যেও স্থানানুসারে প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা বুঝতে হবে।

প্রশাসনিকভাবে একটি ইউনিয়ন হলেও (দেশের সর্ব বৃহৎ ইউনিয়ন) দেশের অন্যান্য অনেক ইউনিয়নের সাথে সাজেকের ভিন্নতা হল যে এর সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সংরক্ষিত বন বা রিজার্ভ ফরেস্ট। আর রিজার্ভ ফরেস্ট এর মানে হল, এতে কোন ধরনের ভূমির মালিকানা সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি দেয়া হয়না (যদিও আইনতভাবে তা করা যেতো)।

কেবল ইউনিয়নটির পূর্ব প্রান্তে, পর্বতাকীর্ণ আন্তর্জাতিক সীমান্ত ঘেঁষে, ছয়টি মৌজাতে সীমিতভাবে এলাকার মানুষের বন্দবস্তকৃত জমি রয়েছে। এখানেই রয়েছে পর্যটকদের পরিচিত “সাজেক ভ্যালি”।

সীমান্তের ওপারে আরও উঁচু পার্বত্য এলাকা হচ্ছে ভারতের মিজোরাম রাজ্য। এর রাজধানী, আইজল শহর (সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৩,০০০ ফুট উঁচুতে), সাজেকের পর্বতময় মৌজা এলাকাগুলো থেকে খুব বেশী দুরে নয়।

সাজেক উপত্যকা বা “সাজেক ভ্যালি” বলতে পর্যটকরা যা চেনে, তা হোল এই উঁচু মৌজা এলাকা (লংকর, রুইলুই, কংলাক, শিয়ালদাইলুই, তুইচুই ও বেটলিং নিয়ে), বিশেষ করে কংলাক এলাকাকে। তবে এখান থেকে উত্তর সীমানার বেটলিং আরও এক দেড় দিনের পায়ে হাটার রাস্তা। এখানে সনাতনী ধারায় পাংখো, ত্রিপুরা ও লুশাই জাতির মানুষেরা পরম্পরাভাবে থাকতো, এবং এখনো থাকে, যদিও এলাকাতে লুশাইরা খুব বেশী আর নেই। তারা বিগত কয়েক দশক ধরে মিজোরামে অভিবাসন করতে থাকে, কিছু পাংখো সহ (ভারতের মিজোদের সাথে লুশাই ও পাংখোদের ভাষাগত ও কৃষ্টিগতভাবে মিল রয়েছে)।

আসল “সাজেক ভ্যালি” রয়েছে অপেক্ষাকৃতভাবে কম পাহাড়ি ও স্বল্প উচ্চতার ভূমিতে, “মৌজা সাজেকের” পশ্চিমে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও দীঘিনালা উপজেলার সীমান্তে। এটাকে “রিজার্ভ সাজেক” বললে ভুল হবে না, কারন মৌজা সাজেককে বাদ দিলে সাজেক ইউনিয়নের বাকি অংশ পড়েছে কাজলং (kasolong) রিজার্ভ ফরেস্টে । এখানেই কাজলং (“কাসলং”) নদীর উপনদী, মাসালং ও লালুকালু প্রবাহিত হয়, যেগুলোর উৎস ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্য।

রিজার্ভ সাজেকে কিছু ত্রিপুরা সহ চাকমা বাস করে। অধিকাংশ এখন চাকমা, যাদের সিংহ ভাগ এসেছে ৮০ ও ৯০-এর দশকে, উদ্বাস্তু হয়ে, দীঘিনালা, বাঘাইছরি ও লংগদু উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে, তৎকালীন সংঘর্ষ ও বাঙালি অভিবাসন কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে। “রিজার্ভ সাজেক” এর মধ্যে সুপরিচিত স্থানের মধ্যে রয়েছে বাঘাইহাট বাজার, মাসলং, গঙ্গারাম, নন্দরাম, লালুকালু, উজ্জংছরি, ভুওছরি, ইত্যাদি।

সাজেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা আমাকে জানালেন যে খাদ্যাভাবে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীদের মধ্যে “মৌজা সাজেক” ও “রিজার্ভ সাজেক”, উভয় এলাকার মানুষই রয়েছে। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তার বেশ কিছু ফ্যাক্টর আপনারা এর মধ্যেই নিশ্চয় আঁচ করতে পেরেছেন। আমিও যে খুব বেশী জানি, তা কিন্তু না। সপ্তাখানেক পর ইউপি চেয়ারম্যান, এবং কয়েকজন ইউপি মেম্বার ও কারবারি সহ (পুরুষ ও নারী) আমরা রাঙামাটি শহরে পরামর্শ বৈঠকে বসবো। তখন আরও পরিষ্কারভাবে সমস্যাটির ব্যাপকতা বুঝতে পারবো বলে আশা করছি। তারপর রানী য়েন য়েন বা আমি অথবা দুজনেই আপনাদেরকে আরও বিস্তারিতভাবে এ বিষয় সম্পর্কে জানাতে পারবো, এফবির মাধ্যমে।

মৌজা সাজেক ও রিজার্ভ সাজেকের ভিন্নতা

মৌজা সাজেকের পর্বত এলাকায় সেচ-নির্ভর বাজারমুখী চাষাবাদের কোন সুযোগ নেই। এখানে পানীয় জলের ভীষণ সংকট। ১৯৮০-র দশকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পরামর্শে ও সহায়তায় বাঘাইহাট এলাকায় এফআইডিসির গাছের ও বাঁশের ডিপোতে সড়ক সংযোগ করে কাজলং রিজার্ভের গাছ ও বাঁশ নিধনের ফলে এলাকার পানি সংকট আরও তীব্র মাত্রায় চলে যায়। এছাড়া এলাকার একটি অংশ পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ এসছে (কংলাকে, বাঘাইহাট, মাসালং, গঙ্গারাম ইত্যাদি হয়ে) কিন্তু এলাকার অধিকাংশ গ্রাম ও খামার সড়ক নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ ফীডার সড়ক নেই বললেই চলে।

তথাকথিত remote, outlying, inaccessible, প্রত্যন্ত, ইত্যাদি এলাকার অন্যান্যের মধ্যে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একাধারে এসব এলাকা থেকে খেত-খামারের মালামালের বাজারজাতকরণের তীব্র সীমাবদ্ধতা। অন্যদিকে বাজার থেকে গ্রামে মালামাল স্থানান্তরের সমস্যা (এখানে রিকশা, ঠেলাগাড়ী, সিএঞ্জি নেই; রিজার্ভ সাজেকের সামান্য অংশে কেবল বছরের কয়েকমাসে মোটর চালিত বোট চলে; আর সাজেক নদী দিয়ে মালামাল স্থানান্তর করতে হলে তা ভারতের ভেতরের কর্ণফুলী হয়ে বাংলাদেশে পাঠাতে হয়)।

কাজেই যারা এসব বিষয় না বুঝে “উন্নতমানের” চাষাবাদ বা কুটির শিল্পের বা অন্য কোন শিল্প বা ব্যবসার কথা বলেন, তা যৌক্তিক কারনে এলাকাবাসীর কাছে “গাঁজা খোরের গল্পের” মত লাগতে পারে (পরে ব্যাখ্যা দেবো, কেন “তথাকথিত” বললাম)। এসব কোনটি বাস্তব-ভিত্তিক অথবা না, তা নির্ভর করবে উৎপাদিত পণ্যের আপেক্ষিক আকার ও আয়তন, ওজন, পচনশীলতা, বাজার মূল্য, ইত্যাদির ওপর।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ সাক্ষরের পূর্বে, ৯০-এর দশকে, অনুরূপ এক খাদ্য সংকটের সময় এলাকাতে হেলিকপ্টারে চড়ে, তৎকালীন সংসদ সদস্য দীপঙ্কর তালুকদার ও কিছু সরকারী কর্মকর্তার সাথে মৌজা সাজেকের লংকর এলাকায় গিয়েছিলাম। এমপি সাহেব যখন কিছু টাকা বিতরণ করলেন এক বর্ষীয়ান পাংখো হেডম্যান এমপি সাহেবকে বললেন, “স্যার, ভাত খাওয়া যায়, টাকাতো খাওয়া যায়না”।

তখন মৌজা সাজেক পর্যন্ত সড়ক পৌঁছাইনি। নিকটস্থ মাসলং বা বাঘাইহাট বাজার থেকে চাল কিনে “হেডলোড” করে আনা হলে চালের দাম দীঘিনালা, বাঘাইছরি, রাঙামাটি বা ঢাকার চেয়ে সাজেকে অনেক বেশী পড়তো। তাই হেডম্যান টাকার চাইতে চাল দেয়ার জন্যে পরোক্ষভাবে বললেন। আজ অবধি অন্যান্য “দুর্গম” এলাকায় সে অবস্থার খুব বেশী পরিবর্তন ঘটেনি, কারণ সাজেকের প্রধান সড়ক হয়ে গেলে ফিডার সড়ক ও রাস্তা তেমন একতা হয়নি।

আর রিজার্ভ সাজেকের বেশীর ভাগ অংশে পানীয় জল ও অন্যান্যভাবে প্রয়োজনীয় পানির সংকট অপেক্ষাকৃতভাবে কম হলেও, এখানেও পানির সরবরাহ সমস্যাপূর্ণ। তবে দুটো দিকে রিজার্ভ সাজেক এলাকার মানুষের অবস্থা মৌজা সাজেকের চেয়ে খারাপ। প্রথমত, তাঁদের কোন ভূমির অধিকার সরকার কর্তৃক গ্রাহ্য করা হয়না, কারন তারা “রিজার্ভ ফরেস্ট”-এ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এলাকার অধিকাংশ মানুষ এখানে এসেছে অন্য এলাকা থেকে, জীবনের ভয়ে, সম্বল-বিহীনভাবে, ৮০ ও ৯০-এর দশকে। তাঁদের সম্বল বলতে কাজ করার দুই হাত ও শরীর ছাড়া আর কিছু নেই।

রিজার্ভ সাজেকের এঁরা হলেন আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু। পার্বত্য চুক্তির বিধানানুশারে বহু বছর আগে ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ১৯৯৮ সনে একটি টাস্কফোর্স স্থাপিত হয়। উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা নির্ধারণ করতেই চলে গেছে দেড় যুগ! কেবল কয়েক মাস পূর্বেই কেবল নির্ধারিত হয় যে উদ্বাস্তু বলতে, ১৯৯৭ এর চুক্তি অনুসারে বোঝানো হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলের অভ্যন্তরে পরিস্থিতির শিকার হওয়া পাহাড়ি অধিবাসীরা। বাঙালি অভিবাসী বা “সেটেলার”-রা নয়। এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে উদ্বাস্তুদেরকে একটি দানা চাল ও এক ফোটা পানীয় জলও দেয়নি। দেয়নি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা, প্রাথমিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থান। দুরে থাকুক তাদেরকে তাদের স্ব স্ব ভিটামাটিতে পুনর্বাসন করবে! (আমি কিছুদিন আগে এক টেলিভিশনের টক শোও-তে এসব কথা বলেছিলাম)। কয়েক বছর আগে অ-পুনর্বাসিত ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীরা প্রধান মন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন দাবিনামা পেশ করেও তেমন কিছু হয়নি। উদ্বাস্তুদের বেলায়ও রাজনৈতিকভাবে কার্যকর লবি বা মিডিয়া ক্যাম্পেইন ছাড়া বেশী কিছু আশা করা যায়না।

২০০৮ সনের অভিজ্ঞতা

২০০৮ সনে তৎকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সুবাদে সাজেক এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম। মূলত দুটি কারনে। এক, এখানে সেনাবাহিনীর স্থানীয় কমান্ডারের পৃষ্টপোষকতায় বাঙালি অভিবাসনের ফলে ও অন্যান্য কার্যক্রমের ফলে স্থানীয়দের ভূমি ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যথাযথ কিনা তা জানতে। এবং, দ্বিতীয়ত, “ইঁদুর বন্যার” উপদ্রবের ফলে ক্ষয়-ক্ষতি দেখতে।
প্রথমোল্লিখিত বিষয়ে আরেকদিন বলবো। তবে ইঁদুর বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা দেখলাম ও জানলাম। অন্তত মৌলিকভাবে। সাজেক সহ অন্যান্য ইঁদুর বন্যা কবলিত এলাকার জন্য (বরকল, বিলেইছরি, রুমা, থাঞ্চি ইত্যাদি সহ) বিশেষ ত্রাণ ও “কাজের বিনিময়ে খাদ্য” প্রকল্পের মাধ্যমে সীমিত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়া হল। এতে তাৎক্ষনিকভাবে সহায়তা প্রদান করেন খাদ্য উপদেষ্টা ডঃ ম ম ম শওকত আলী।

সমস্যা আসলো দুই ক্ষেত্রে। এবং দুটিতেই আমি বহুলাংশে সমাধান দিতে পারিনি। একটি হল বরাদ্দ সমূহ যথাযথ গ্রহীতাদের হাতে পৌছুনোর আগে অনুদান বা অন্যান্য বরাদ্দ অন্যত্র চলে যাওয়া। “ভদ্রভাবে” বললে, কিছু স্থানীয় পাহাড়ি নেতা এবং কিছু বাঙালি সিভিল ও সামরিক কর্মকর্তার অ-সহযোগিতার কারনে সব অনুদান নির্ধারিত মানুষের কাছে পুরোপুরিভাবে পৌঁছানো সম্ভবপর হয়নি।

দ্বিতীয়ত সমস্যা আসলো জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (World Food Programme বা “WFP”) থেকে। WFP “নির্ভরযোগ্য” ও “স্বাস্থ্য-সম্মত” কায়দার বাইরে প্রস্তুতকৃত খাদ্য সামগ্রী দেবেনা। অর্থাৎ শুটকি ও নাপ্পি দেবেনা। কিন্তু এলাকার মানুষ কি শুধু ভাত খাবেন? অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডাল খাওয়ার অভ্যাস নেই। তেলও অনেকেই কম খান। সুতরাং আমিষ যোগানের জন্য শুটকি আর নাপ্পির চেয়ে যথাযোগ্য আর কি আছে? সীমিত শিকার ছাড়া মাংস পাওয়ার সুযোগ নেই। মৌজা সাজেকে মাছ ধরারও কোন সুযোগ নেই। মুরগী কয়জনেইবা পালে। আরে বাজার থেকে কিনে খাওয়ার খুব কম জনেরই অর্থ ছিল বা আছে।

এসবের কথা কেন বলছি? নিছক স্মৃতিচারণ করার জন্যে অবশ্যই নয়। এধরনের সমস্যা বর্তমানের সরকারী বরাদ্দের ব্যাপারেও মোকাবিলা করতে হতে পারে। সুতরাং আমাদের সজাগ থাকতে হবে এসব বিষয়ে। সাজেকের, এবং প্রয়োজনে থাঞ্চি, রুমা, বিলেইছরি ও অন্যান্য এলাকার খাদ্যাভাবের সমস্যার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের সমাধান আনতে এসব বিষয় নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে।

আমার সহধর্মিণী রানী য়েন য়েন অন্যান্য সচেতন নাগরিকদের সাথে মিলে সাজেকে ত্রাণ সরবরাহের জন্য দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী আদিবাসী বা জুম্মদের কাছ থেকে সহযোগিতা আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছেন (উনি আর আমি একই ইস্যুতে কাজ করলেও যার যার ঢঙে করি!)। তাঁকে বললাম, “সুগুনি (শুটকি) ও সিদোল (নাপ্পি) এর কথা ভূলোনা”। উনি বিরক্তের সূরে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি, বলতে হবেনা”।

এখন ফিরে আসি মূল বিষয়ে। সাজেকের খাদ্যাভাবের সমস্যা মোকাবেলার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এবং কোনটি কার দ্বারা।

স্বল্প মেয়াদের পদক্ষেপ

স্বল্প মেয়াদে বা তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজন হচ্ছে এলাকায় পর্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা। এবং এখানে মনে রাখতে হবে যে খাদ্যাভাবে আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন বয়োবৃদ্ধ, রোগাক্রান্ত, প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী ও প্রসূতি মা, পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত শিশু ও বিত্তহীন পরিবারের সদস্য (যাদের অনেকেই আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু এবং/অথবা ইঁদুর বন্যায় কবলিত পরিবারের সদস্য)। ১৯৯০-এর প্রথম দিকে দেবু দেওয়ান অ আইনা হিউমের নেতৃত্বে স্থানীয় এনজিও টংগ্যার একটি তদন্ত দলের প্রতিবেদনের ফলে সরকারী ও দাতা সংস্থার মহলে কিছু নড়াচড়া দেখা গেছিলো। তাও বোধ হয় হতো না যদি না পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত কিছু শিশুর ছবি দেখে কয়েকজন দাতা সংস্থার নারীদের উদ্যোগ না নেয়া হতো।

নাগরিক সমাজের করণীয়

প্রথমত, আমি মনে করি নাগরিক সমাজ নিজস্ব উদ্যোগে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে। বছর দশেক আগেও পাহাড়ি ও বাঙালী নাগরিক সমাজ এগিয়ে এসেছিলেন সাজেকের মানুষের জন্যে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে, দেশের অন্যত্র থেকে এবং প্রবাসী জূম্মোদের কাছ থেকে। এবারও তাই করতে হবে। প্রথমত রাণী য়েন য়েন ও তাঁর সাথে জড়িতদের তহবিলে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহবান জানাতে চাই। এছাড়া অন্যান্য ব্যক্তি, সংগঠন ও নেটওয়ার্ক থাকতে পারে। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মৌজা হেডম্যান ও গ্রামের কারবারি তো রয়েছেনই।

দ্বিতীয়ত, এটা মনে রেখে যে, রাষ্ট্র কর্তৃক গ্রহনকৃত কার্যক্রম সাধারণ নাগরিক সমাজের উদ্যোগের চেয়ে অনেক বেশী বৃহত্তর পরিসরে প্রভাব আনতে পারে, তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ পদক্ষেপ আনয়নের জন্যে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করতে হবে। নাগরিক সমাজের। এর ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে জড়িতরা – তারা স্থানীয়, জেলা, আঞ্চলিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হতে পারেন – নিজ উদ্যোগে বা অনুপ্রেরিত হয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন। এছাড়া এটা এমনিতেও রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেই মৌলিকভাবে পড়ে।

সাজেকের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলশণ চাকমা ও উপজেলা চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা সমর্থনযোগ্য। আমি শুনেছি যে রাঙামাটির জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমাও সরকার কর্তৃক ত্রাণ বিতরণের প্রক্রিয়ায় পরিবহনের খরচ মেটানোর বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

ইউপি চেয়ারম্যান সরকারের নিকট ৬০০ মেট্রিক টন খাদ্য বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। এতে এগিয়ে এসেছে ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৫ মেট্রিক টন বরাদ্দের ঘোষণা দিয়ে, এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ১০ মেট্রিক টন বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। শেষ খবর শুনলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও নাকি এক হাজার পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করছে বা করবে। তবে এসব অপ্রতুল ও প্রয়োজনানুসারে অ-পর্যাপ্ত। এ বিষয়ে এই দুই মন্ত্রণালয় – অর্থাৎ ত্রাণ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় – এর কাছে বরাদ্ধ বৃদ্ধির জন্য জোর দাবী জানাতে হবে।

কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয়েরও বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। ২০০৮-এ পার্বত্য চট্টগ্রামে ইঁদুর বন্যার পর এই মন্ত্রণালয় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহন করেছিল (যদিও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমার বিশেষ অনুরোধ জানাতে হয়েছিলো)। এখনো না পারার কোন কারন নেই। জাতিসংঘের WFP-এর বেলায়ও তাই।
২০০৮ সনে তৎকালীন খাদ্য মন্ত্রী ম ম ম শওকত আলী পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের স্বাভাবিক খাদ্য বরাদ্দের সাথে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রদান করেন।

এছাড়া জাতিসংঘের WFP-ও বিশেষ খাদ্য বরাদ্দ করেন। তবে তারা খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে শুটকি ও নাপ্পি যোগ করার ব্যাপারে আমার পরামর্শ গ্রহন করেনি, যেহেতু এটা নাকি জাতিসংঘের নিয়মাবলীর বাইরে। কাজেই এবার আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে যেই খাদ্য সামগ্রী সমূহ সরকারী বা জাতিসংঘের সংস্থারা দেবে না যেনে যেন নাগরিক সমাজের তরফ থেকে তা দেয়া হয়।

মধ্য মেয়াদের পদক্ষেপ

মধ্য মেয়াদের জন্য, অর্থাৎ আগামী ২-৫ বছর পর্যন্ত খাদ্য বরাদ্দ, কর্ম সংস্থান, এবং স্বাস্থ্য সেবা, পানীয় জলের সরবরাহ ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বিষয়ক টাস্কফোর্স বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হলে তার ম্যানডেট বদলাতে হতে পারে। অন্তত এবিষয়ে সরকারের রাজনৈতিক ও আর্থিক সমর্থন যোগানোর জন্য কাজ করতে হবে। সোশাল মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়া কোথাও এই টাস্কফোর্সের ভূমিকার বিষয় দেখা ও শোনা যায়না! রাজনৈতিক অঙ্গণেতো আরও বেশী না।

ত্রাণ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ও পার্বত্যাঞ্চলের বিশেষ প্রতিষ্ঠান সমূহকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে নাগরিক সমাজ এবং মিডিয়া থেকে চাপ না আসলে তেমন কিছু হবে বলে আমি মনে করিনা। কয়েকমাস পরে নীতিনির্ধারকেরা এসব বেমালুম ভুলে যাবেন।

বিশেষ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নিকট তার বাৎসরিক উন্নয়ন বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এর সাথে ভিজিডি, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি প্রয়োজনানুসারে বাড়ানোর দরকার। এবিষয়ে শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বিষয়ক টাস্কফোর্স তাদের নথি থেকে উদ্বাস্তু পরিবারের তালিকা স্থানীয় সরকার ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানকে পাঠাতে পারে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় তার কাজের বিনিময়ে খাদ্য (টিযআর) প্রকল্পের নীতিমালা সংশোধন করে সাজেক সহ সকল প্রত্যন্ত এলাকার জন্য, যথা বিলেইছরি, বরকল, লক্ষ্মীছরি, থাঞ্চি ও রুমা উপজেলার “প্রত্যন্ত” এলাকার জন্য বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা আগাম থেকে নিতে পারে।

রেংখং রিজার্ভ ফরেস্টের কথা আগে বলেছিলাম। ফরুয়া ইউনিয়ন বাদ দিয়ে এই রিজার্ভের অধিকাংশ এলাকাকে “বরথলি” নামক একটি নতুন ইউনিয়নের আওতায় আনা হয়েছে। এই ইউনিয়নের বাসিন্দাগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থানও সাজেকের ন্যায় অত্যন্ত নাজুক। নির্ভরযোগ্য মেথডলজি গ্রহন করে এসব এলাকায় আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এরাও সাজেকবাসীর ন্যায় দেশের সীমান্ত রক্ষাকারী নাগরিক। ভারত-বর্মা-বাংলাদেশের ত্রি-সীমানার নিকটের এক গ্রামের কারবারি, উনি ম্রো জাতির সদস্য, মাস দুয়েক আগে আমার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছিলেন। তাঁদের অবস্থা অত্যন্ত করুন। বরথলির চেয়ারম্যান -এর সাথে মাস দুয়েক বা তিনেক আগে দেখা হয়। তাঁকে কারবারিদের সাথে মিলে বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে উন্নয়নের কাজ করতে পরামর্শ দিয়েছিলাম (চেয়ারম্যান আতো মং এক সাহসী ও উদ্যোগী নেতা, যিনি পূর্বে ইউপি সদস্য ছিলেন ও এই দুর্গম এলাকায় বছর কয়েক আগে আমার সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি মারমা জাতির সদস্য)।

আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা

আমি আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা বা socio-economic survey-এর কথা আগেও বলেছি। দুর্ভাগ্যবশত Bangladesh Bureau of Statistics-এর আদমশুমারি বা Census Report-এ সহ অন্যান্য তথাবলীতে সাজেক সহ পার্বত্য এলাকার কোন নির্ভরযোগ্য ডাটা পাওয়া যায়না। এটা আশ্চর্যজনক। বিশেষ করে জাতিগত, অবস্থানগত ও অন্যান্য ভিন্নতার ক্ষেত্রে। জাতিসংঘ ঘোষণা দিয়েছে যে, বিশেষ করে আদিবাসী ও অন্যান্য সুযোগ-বঞ্চিত ও অধিকার-বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও উন্নয়নের অধিকার এগিয়ে নিতে হলে Disaggregated Data সংগ্রহ করা আবশ্যক। এবং Disaggregation হতে হবে জাতিগত (Ethnic), লিঙ্গগত (Gender) ও আর্থ-সামাজিক মর্যাদাগতভাবে (Socio-Economic Status)।

কোন একটি এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান জানার পরই কেবল উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহন করার রেওয়াজ বিশ্ব-জুড়ে কয়েক দশক ধরে চলছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সংস্থা ও এনজিওরা (বাংলাদেশে সহ) বেশ এগিয়ে। কিন্তু আমাদের সরকার এবিষয়ে যেন উপনিবেশিক আমলে এখনো ঘুমাচ্ছে! আর সাজেকে “উন্নয়ন” সংস্থার কার্যক্রমের বিষয় আসলেই “নিরাপত্তার” অজুহাত দেখিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী এবং/অথবা সরকারী গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ অধুনা বাধা সৃষ্টি করেন।

সে যাক, আবার ফিরে আসি আর্থ-সামাজিক সমীক্ষার বিষয়ে। সাধারণ পরিষদ সহ জাতিসংঘের একাধিক সংস্থার নীতিমালা ও সিদ্ধান্তে এবিষয় চলে এসেছে। তবে আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ জাতীয় নীতিমালা সমূহতে – যথা স্বাস্থ্য নীতি, শিক্ষা নীতি, ভূমি নীতি, বন নীতি, ভূমি ব্যবহার নীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, সংস্কৃতি নীতি – ইত্যাদিতে এসব সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তা সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রেক্ষিত ও আদিবাসী প্রেক্ষিত কোনটারই আমলে নেওয়া হয়নি (প্রশান্ত ত্রিপুরা ও ঊছাছা চাক এবিষয়ে বিষদ গবেষণা করে প্রতিবেদন লিখেছেন)।

আমি ২০০৮-০৯ এ পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে পার্বত্যাঞ্চলে উন্নয়ন বরাদ্দ বণ্টনের বেলায় সংশ্লিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করে আয়তন, জনসংখ্যা ও “অনগ্রসরতা” অনুসারে বরাদ্দ দিতে বাধ্য ছিলাম। কিন্তু “অনগ্রসরতা”-র কোন সংজ্ঞা ছিলনা। একটি কার্যকর সংজ্ঞা নিরূপণের নির্দেশ দিলাম। একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি অনগ্রসরতার সংজ্ঞা প্রদান করে (এই যুগ্ম সচিব এখন সচিব হয়েছেন)। কমিটি অনগ্রসরতার মানদণ্ড হিসেবে আটটি বিষয় চিহ্নিত করেঃ (১) যোগাযোগ ব্যবস্থা, (২) অনাবাদি জমি, (৩) শিক্ষার হার, (৪) বিদ্যুতায়ন, (৫) স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন, (৬) নিরাপদ পানি, (৭) মাথাপিছু বার্ষিক আয়, ও (৮) সমতলভূমির [আধিগম্যতা]। উপরোক্ত প্রত্যেকটি বিষয়ে সাজেকবাসী দেশের অন্যত্র অঞ্চল, ও এমনকি পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য এলাকা থেকে (বিলেইছরি, রুমা ও থাঞ্চির কিছু এলাকা ছাড়া) যে অনেক পিছিয়ে, এব্যাপারে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (“WFP”) এর মার্চ-এপ্রিল ২০১১ এর “A Rapid Food Security Assessment in Sajek” শীর্ষক সাজেকের খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে সাজেকের বাসিন্দাদের খাদ্য নিরাপত্তা সহ অন্যান্য উন্নয়নের সূচকের নাজুক অবস্থার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়। বিগত ছয় বছরে যে এই অবস্থার তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে তা ভাবার কোন কারন দেখি না।

WFP-র ২০১১-এর প্রতিবেদনে সাজেকের জনগোষ্ঠীকে বাঘেইছরি উপজেলার অন্যান্য এলাকার জনগোষ্ঠী থেকে অনেক বেশী দরিদ্র মর্মে চিহ্নিত করা হয়। ইঁদুর বন্যাকেও তৎকালীন নাজুক অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী করা হয়। কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাবের ক্ষেত্রে জুম চাষের উপর বাধানিষেধ, বাঁশের বিক্রির হ্রাসকরণ ও বাঁশের মূল্যের হ্রাসকরন, ইত্যাদির কথা বলা হয়।

WFP-র প্রতিবেদনে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে আক্রান্তদের মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে নারী-প্রধান পরিবার, ভূমিহীন ও দিন-মজুর, বৃহতাকৃতির পরিবার, বয়োজৈষ্ঠ ও কংলাক এলাকার ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দিন-মজুরগন। এই অবস্থার, উপরোক্ত মানুষজনের এবং সমগ্র এলাকার জন্য, বর্ষা মৌসুমে (মে থেকে সেপ্টেম্বর) আরও ভয়াবহ হবে মর্মে মতামত প্রদান করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে শিশুদের পুষ্টিহীনতা, সার্বিক স্বাস্থ্য, মাদের স্বাস্থ্য, ইত্যাদির ক্ষেত্রেও মারাত্মক তথ্য বের হয়ে আসে।
এর তিন বছর পূর্বের, ২০০৮ সনের Medecins Sans Frontieres (MSF) নামক আন্তর্জাতিক এনজিওর Food Security Assessment Report: Chittagong Hill Tracts, Sajek Union নামক প্রতিবেদনেও অনুরূপ তথ্য ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।
MSF-এর প্রতিবেদনে বলা হয় যে ইউনিয়নের ৭৯.৪৭% মানুষ খাদ্য অ-নিরাপত্তার শিকার; ১-৫ বছরের শিশুদের ৪৩.৮৫% পুষ্টিহীনতায় ভুগছে; ৮০.৮% মানুষ সমীক্ষার দুই সপ্তাহের মধ্যেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে, এবংএলাকার ৮৮.১% মানুষ অনিরাপদ ছড়ার বআঃ নদীর পানি ব্যবহার করে।
বিগত বছরের জুমের চাল বেশীর ভাগ পরিবারের ক্ষেত্রে শেষ হয়ে গেছে। জুমের ফসল পাওয়ার আরও অনেক মাস বাকী। অন্যদিকে বর্ষার আগমনের ফলে চলাচলে নানাবিধ অসুবিধা দেখা দেবে। যদিও এসব বিষয় আমি WFP ও MSF এর প্রতিবেদন সমূহের বিষয়ের আলোচনার সাথে জুড়ে দিয়েছি, এগুলো স্বল্প-মেয়াদী সমস্যার অংশ। তা আশা করি আপনারা আপনাদের মতো করে গুছিয়ে বুঝে নেবেন।

দীর্ঘ মেয়াদের পদক্ষেপ

দীর্ঘ মেয়াদে সাজেকের খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা সমূহ সমাধান করতে হলে উপরে মধ্য মেয়াদের অংশে আলোচিত সুপারিশসমূহ কার্যকরণের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে লবি ও অ্যাডভোকেসী করতে হবে। উপরে আলোচিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন ও খাদ্য বরাদ্দ ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

প্রথমের দিকে আমি “প্রত্যন্ত” শব্দ নিয়ে আকার-ইঙ্গিতে প্রশ্ন তুলেছিলাম। সাজেকের মানুষেরা তাদের আবাসভূমি বেছে নেওয়ার সময় দেশের রাজধানী ও যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে যে একদিন তারা অনেক দুরে অবস্থান করবেন, তা জানার কোন সুযোগ ছিলনা। তাদের কাছে মহানগরী ঢাকা “প্রত্যন্ত”” মনে হতে পারে। কাজেই তাদের সম্মতি ছাড়া রাজধানী ও রাস্তাঘাট কোথায় হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকলে তাদের এলাকার “প্রত্যন্ততাকে”দোষারোপ করা অন্যায়মূলক ও বৈষম্যমূলক। তারাও দেশের নাগরিক। এবং নাগরিক হিসেবে তারা খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা নিরাপত্তা সহ নাগরিক গণের সকল উন্নয়নের সুযোগ পেতে হকদার।

ভূমি অধিকারহীন রিজার্ভ ফরেস্ট বাসীদের ভূমি অধিকারকে শ্রদ্ধা করতে হবে। প্রতিবেশ-বান্ধব ভাবেও অনেক ধরনের চাষাবাদ করা যায়। আর দারিদ্র্য-পীড়িত অবস্থায় যদি রিজার্ভ সাজেকের মানুষেরা রয়ে যায়, তাতে এমনেও বন রক্ষা করা যাবে না। মৌজা সাজেক ও রিজার্ভ সাজেকের আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের স্থায়ী ও সাময়িক উভয় প্রকারের পুনর্বাসনের জন্য শরণার্থী ও উদ্বাস্তু বিষয়ক টাস্কফোর্সকে কার্যকর করতে হবে।

আর সর্বোপরি, মৌজা সাজেকের আদি বাসিন্দা-দের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করা খুবই জরুরি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এটা কলঙ্কজনক যে, এই অঞ্চলের পরম্পরাভাবে বসবাসকারী লুশাই ও পাংখোরা দেশ ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে এবং আরও অনেকে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে। এর মধ্যে কিছু ত্রিপুরা ও চাকমাও রয়েছে।

বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ মিলে এ ব্যাপারে কিছু করতে চাইলে করা যায় এবং তা কার্যকর করতে বা করাতে সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্ব রয়ে গেছে। তবে তা করতে হবে মনপ্রাণ দিয়ে। এই এলাকার মানুষ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে যা দিয়েছে তার তুলনায় কিছু পায়নি। ব্রিটিশ আমলেও না, পাকিস্তান আমলেও না এবং বর্তমানের বাংলাদেশ আমলেও না।

Sustainable Development Goals বা SDG-তে বলা হয়েছে যে কাউকে উন্নয়নের সুযোগ থেকে বাদ দেয়া যাবেনা। এটা যেন আমরা ভুলে না যায়। কারন বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিমণ্ডলে দেশের উন্নয়নের দ্রুত ধারার কথা প্রায়শই ঢোল পিটিয়ে বলে থাকে। কিন্তু তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে বেমালুম ভুলে যায়।

এমন দিন যেন না আসে যখন দেশের অন্যত্র অঞ্চলের পর্যটকরা কেবল সাজেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসবে, কিন্তু এলাকার প্রতিবেশ ও পরিবেশ রক্ষায় এলাকার মানুষের অবদান ভুলে যাবে বা আদৌ এ বিষয়ে কিছু জানবে না।। স্থানীয় মানুষের কৃষ্টি-ঐতিহ্য ছাড়া কোন অঞ্চলের সৌন্দর্য হল শ্মশানের ন্যায়। এতে এলাকার মানুষের আর্তনাদ ও বেদনা মিশ্রিত। তা বিনোদনের জন্য দুএকদিনের জন্য উপভোগ করা বে-নৈতিক ও মানবতাবিরোধী।

রাজা দেবাশীষ রায়ঃ চীফ চাকমা সার্কেল

Back to top button