সাঁওতালদের হারিয়ে যাওয়া গান গুলো কে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই- সেঙ্গেল

দেশের উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল আদিবাসীদের জনপ্রিয় গানের দল সেঙ্গেল। সেঙ্গেল সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহি গানের পাশাপাশি নিজেদের লেখা আধুনিক সান্তাল গান এবং বাংলা ঝুমুর গানে নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রের সাথে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রনে ভিন্ন ধারার পরিবেশনার জন্য ইতোমধ্যে সাঁওতাল ছাড়াও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাদের গানের কথায় যেমন রয়েছে প্রেমের বহি:প্রকাশ তেমনি রয়েছে সান্তালদের শোষন ও নির্যাতনের দ্রোহের আগুন।
ব্যান্ডের পরিচালক ও লীড গিটারিস্ট জন হেমব্রম জানালো, সেঙ্গেল শব্দের বাংলা অর্থ “আগুন”। সেঙ্গেল বলতে দীপ্তিময় একটি শিখাকে বোঝায় যা একটি সম্ভাবনার প্রতিক।
আজ ২৬ জুন জনপ্রিয় ব্যান্ড সেঙ্গেল এর ৯ বছর পূর্তি। এই সূদীর্ঘ পথচলা সম্পর্কে আইপিনিউজ ভার্চুয়াল মাধ্যমে কথা বলেছে সেঙ্গেল ব্যান্ডের সদস্যদের সাথে।
ব্যান্ডের যাত্রাঃ ব্যান্ডের শুরুটা ২০১১ সালে। তৎকালীন সদস্যরা একেক জন একেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিল। রঞ্জিত কিস্কু রাজশাহী কোর্ট মিশন পাড়ায় বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অংশটা পরিচালনা করত। জন হেমব্রম স্কুল জীবন থেকেই টুকটাক গীটার বাজাত । ২০০৯ সালে রাজশাহীতে কলেজে পড়তে আসলে বড় ভাই জেমস হেমব্রম তাকে অনুপ্রানিত করে। তার বড় ভাইয়ের সাথে রঞ্জিত ও অঙ্কুর হোড় মিউজিক করত বলে তাদের সাথে পরিচয় হয় জন হেমব্রমের। পরে বাংলা ব্যান্ড প্রকৃতিতে যোগ দিয়ে জন মিউজিকে উন্নতি করতে থাকে। তার মাথায় আসে সান্তাল শিক্ষার্থীদের নিয়ে সান্তালী ব্যান্ড করলে মন্দ হয় না। সন্তোষ সরেন ইতো মধ্যে বেজগীটার শিখছিল, তাকে প্রস্তাব করতেই সে সম্মতি দেয়। অংকুর ড্রামস বাজাতো আর ভোকাল হিসেবে ছিল রঞ্জিত। মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত একটি ধর্মীয় সম্মেলনে প্রথম পারফর্ম করে সেঙ্গেল। সেখানে পরিচয় হয় জোসিয় হেমব্রমের সাথে যে কিবোর্ড বাজিয়ে ছিল এবং সান্তালী ব্যান্ড নিয়ে তার সম্মতি ছিল। এভাবেই জন, রঞ্জিত, সন্তোষ, যোশিয় ও অংকুর হোড়দেও নিয়ে মোটামুটি দাড়িয়ে যায় সান্তাল ব্যান্ড সেঙ্গেল।
সেই সময় দিনাজপুর, কাকনহাট ও রাজশাহীতে বেশ কয়েকটি স্টেজ পারফর্ম করে সেঙ্গেল। বিভিন্ন স্টেজ পারফর্মে মাঝে মাঝে যুক্ত হতেন জেমস হেমব্রম, জামেস মার্ডী ও সুজন বেনেডিক্ট তির্কী। তাদের কাছে সেঙ্গেলের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
ব্যান্ডের পথচলায় বাধাঃ সেঙ্গেল ব্যান্ডের বেশ কয়েক বার খারাপ অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। একবার সেঙ্গেল গেছে স্টেজ শো করতে এক জায়গায়। গিটার, প্যাড ও কিবোর্ড দেখে দর্শকরা ঘোর আপত্তি জানিয়েছিল। সাধারণ জনগনের ধারণা ছিল আমরা সান্তাল ঐতিহ্যবাহি গানকে নষ্ট করব। আমাদের স্টেজ থেকে নামিয়ে দিতেও কিছু লোক উদ্যত হয়েছিল। তাদের অনেক বোঝানোর পর গান শুরু হলে পর এই দর্শকরাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছে। আমাদের ব্যান্ড দলের ঐতিহ্যবাহি গানের উপস্থাপনা দেখে পরবর্তিতে দর্শকরা আমাদের বাহবা জানিয়েছে।
সেঙ্গেলের নতুন শুরুঃ ২০১৪ সালে পড়াশোনা শেষ হওয়ার কারনে সন্তোষ ও অঙ্কুর রাজশাহী ছেড়ে চলে যায় এবং রঞ্জিত চাকুরির জন্য ঢাকা চলে যাওয়ায় একা হয়ে পড়ে জন। ব্যান্ড ভাঙ্গার উপক্রম হয়েছিল প্রায়। বেশ কয়েকটি বছর স্থবির হয়ে পড়ল ব্যান্ডের সকল কার্যক্রম। এই দুঃসময়ে রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির সান্তালী গানের প্রশিক্ষক মানুয়েল সরেনের সাথে জনের পরিচয় হয়। মানুয়েল সরেন সেই সময় বিটিভি ও এটিএন বাংলা টিভির জন্য গান রচনা ও গান পরিবেশন করতেন। জন মানুয়েল সরেন কে প্রস্তাব দেয় সেঙ্গেলে যোগ দেবার জন্য এবং তিনি তা সাগ্রহে গ্রহন করেন। ঠিক এই সময়টাতেই রঞ্জিত ঢাকা থেকে রাজশাহী ফিরে আসলে সেঙ্গেলের পালে হাওয়া লাগতে শুরু করে। এরপর দলে যুক্ত হয় সাকাম সুব্রত মার্ডি। সুব্রত দীর্ঘদিন ধরেই মিউজিকের সাথে যুক্ত ছিল। সুব্রত দলে সাঁওতালদের তালযন্ত্র মাদল বাজাচ্ছিল। পরে কয়েকটি স্টেজ শোতে অংশ গ্রহন করে ড্রামার ইমন মুরমু। সে ঢাকায় একটি দলের সাথে নিয়মিত প্রোগ্রাম করে এবং মিউজিক কে সে পেশা হিসেবে নিয়েছে। ইমনের যোগদান সেঙ্গেলকে একটি দৃঢ় অবস্থান এনে দেয়। সর্বশেষ সেঙ্গেলে যোগ দেন রাজশাহী কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক সামসন হাঁসদা। তিনি কয়েক বছর থেকে বাঁশি বাজানো শিখছেন এবং বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীর সংগীত পরিচালক ও প্রখ্যাত বংশিবাদক আব্দুস সালামের কাছে বাঁশির তালিম নিচ্ছেন। সামসন হাঁসদার যোগদান পরিপূর্ণ সেঙ্গেলে শেষ তুলির আচড়ের মত। এভাবেই ধীরে ধীরে সেঙ্গেল ব্যান্ড পরিণত হয় সান্তালদের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল হিসেবে।
সাঁওতাল গানের বৈচিত্রঃ দলের কিবোর্ডিস্ট ও ভোকাল মানুয়েল সরেন মনে করেন সান্তাল সমাজের ছেলে মেয়েরা এমন একটি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হয় যেখানে রয়েছে ৪৯টি ভিন্নভিন্ন সুরের মুর্ছনা। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, পরব-পার্বন, ফসল লাগানো, প্রকৃতি বর্ণনা, শিকার সব ক্ষেত্রেই রয়েছে একেক রকমের গান। সান্তালদের রক্তে গান ও আনন্দের ধারা বহমান।
ব্যান্ডের লক্ষ্যঃ সাঁওতালদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী গান গুলো কে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। এর পাশাপাশি সাঁওতাল গানকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সেঙ্গেল ব্যান্ডের লক্ষ্য।
ব্যান্ডের বর্তমান কার্যক্রমঃ রঞ্জিত কিস্কু বলেন,ঘরবন্দী দর্শকদেও কথা ভেবে আমরা প্রায় ফেসবুক লাইভ আসছি। এই লাইভ অনুষ্ঠানে আমাদের সাথে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ,ভারত ও নেপালের সাঁওতালদের জনপ্রিয় সংগীত ও অভিনয় শিল্পীরা। আগামী ৩০শে জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস উপলক্ষে সেঙ্গেল ব্যান্ডের আয়োজনে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের শিল্পী ও অভিনেতা অভিনেত্রীদের নিয়ে একটি ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত লাইভে সেঙ্গেল ব্যান্ডের সাথে সান্তালী সিনেমার প্রখ্যাত অভিনেতা লক্ষণ সরেন, অভিনেত্রী আহেলা টুডু, বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী টম মুরমু ও জনপ্রিয় মিউজিক ভিডিও অভিনেতা ইশারাজ মুরমু, সন্তোষ সরেন (সহকারী কমিশনার, কাস্টম এক্সাইস ও ভ্যাট বিভাগ) অংশগ্রহণ করবেন।
এছাড়াও সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী গানগুলো সংগ্রহ করার কাজ করছে। এর পাশাপাশি নতুন গান তৈরির কাজও হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেঙ্গেল ব্যান্ডের ৪ টি মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।
এ্যালবাম প্রকাশঃ ব্যান্ডের প্রথম অডিও এ্যালবাম এই বছরের ৩০ জুন সাঁওতাল হুল দিবসে প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির জন্য এই বছর আর এ্যালবাম প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছেনা। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ্যালবাম প্রকাশের সময় জানিয়ে দেওয়া হবে।
ব্যান্ডের বর্তমান সদস্যঃ – রঞ্জিত কিস্কু-ভোকাল, মানুয়েল সরেন- ভোকাল ও কিবোর্ড, সাকাম সুব্রত মার্ডী- মাদল ও কাহন, সামসন হাঁসদা-বাঁশি, ইমন মুর্মু-ড্রামস, ফ্রান্সিস মার্ডী- কিবোর্ড ও অক্টোপ্যাড এবং জন হেমব্রম-গীটার।