সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি প্রদানে সরব থাকলেও প্রকৃত বাস্তবায়নে নেই, অভিযোগ জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধির
বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একের পর এক প্রতিশ্রুতি প্রদানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে সরব থাকলেও দু:খজনকভাবে সেই প্রতিশ্রুতি প্রকৃত বাস্তবায়নে নেই। জনসংহতি সমিতি ও দেশের নাগরিক সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের সাথে অব্যাহতভাবে সংলাপ চালিয়ে আসলেও এখনো পর্যন্ত কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট ভবনে গত ১৯ জুলাই ২০১৬ অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা” শীর্ষক বাংলাদেশ সেমিনারে এই বক্তব্য তুলে ধরেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি মঙ্গল কুমার চাকমা। লর্ড সভার সদস্য লর্ড কারলাইলে এবং হাউস অব কমন্সের সদস্য মিজ আনে মেইন-এর যৌথ সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সেমিনারে জনসংহতি সমিতি তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা একজন আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এমপি, মৎস্য ও পশুসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ এমপি; জাতীয় পার্টি থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রী ড. আনিসুর রহমান মাহমুদ; এবং বিএনপি থেকে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা সবি উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারটি ব্রিটিশ পার্র্লামেন্টের আইন ও প্রবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনার শুরুর প্রাক্কালে প্রয়াত লর্ড এ্যাভেবুরির স্মরণে কয়েক সেকেন্ড নিরবতা পালন করা হয়। আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষাবিদ, ব্রিটিশ সংসদ সদস্য, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ প্রায় ৬০ জন লোক উপস্থিত ছিলেন।
জনসংহতি সমিতির পক্ষে মঙ্গল কুমার চাকমা তাঁর বক্তৃতায় বলেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে ১৯৯৭ সালে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলীর মধ্যে অন্যতম একটি দিক। এই বিষয়টি স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি সংক্রান্ত অধিকারের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে স্বীকৃত রয়েছে। সংস্কৃতি ও পরিচিতির প্রতি সংবেদনশীল উন্নয়নকে সামগ্রিক উন্নয়নের টেকসই পদ্ধতি হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে যা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদের উপর তাদের সমষ্টিগত অধিকার, নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ ও স্বশাসন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা ও এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে সরকার তথা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চলেছে। উদাহরণ হিসেবে, খাগড়াছড়ি জেলায় গুইমারা উপজেলা, রাঙ্গামাটি জেলায় সাজেক থানা ও বড়থলি ইউনিয়ন সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে অগোচরে গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, ঠেগামুখে স্থল বন্দর স্থাপন, সেনাবাহিনী কর্তৃক বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, বিজিবির বিওপি স্থাপন ইত্যাদি উন্নয়ন কার্যক্রমসহ অনেক উন্নয়ন কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে যেগুলো জুম্ম জনগণের সংস্কৃতি ও পরিচিতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, যদিও জনসংহতি সমিতির পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দল, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ক্ষেত্রে জনসংহতি সমিতির সাথে কখনোই আলোচনা করা হয় না। এমনকি জাতীয় বাজেটের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রণয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শ করা হয় না। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো উপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার উন্নয়ন ধারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রয়েছে। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক এখনো আত্ম-নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন ধারা পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে উঠেনি। উপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার উন্নয়নের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম-অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ক্ষুন্ন হতে বসেছে, যে বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বীকৃতি ও গ্যারান্টি প্রদান করা হয়েছে। অধিকন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি যা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে তাদের নিজেদের প্রতিনিধি নিজেরাই নির্বাচিত করার যে রাজনৈতিক অধিকার রয়েছে সেই অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার সামিল। তাই উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ভূমিকাকে একপ্রকার প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। উপরন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো, অন্যান্যের মধ্যে যেমন- সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনো পার্বত্য পরিষদগুলোতে হস্তান্তর করা হয়নি। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা অনেকটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায় যদি সেখানে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বশাসন ও সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী অধিকার না থাকে এবং সেই উন্নয়ন কার্যক্রম যদি জুম্ম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও জীবনধারার উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
বিগত ১৯ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনকে অকার্যকর করে রাখার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ভূমি সম্পর্কিত সংংঘাত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ২০০৯ ও ২০১৩ সালের ইউপিআরে এবং আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর বিরোধাত্মক ধারাসমূহ সংশোধন করেনি। এই আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনের জন্য ২০১১ এবং ২০১৫ সালে দুইবার সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৩-দফা সংশোধনী প্রস্তাবাবলী সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলেও এখনো তদনুসারে জাতীয় সংসদে পাশ করা হয়নি। সারাদেশে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনাবলী ঘটছে সেগুলো অধিকাংশই হচ্ছে প্রথাগতভাবে পরিচালিত ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ ভূমি স্বত্ব, ভোগদখল ও প্রবেশাধিকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভূমিদুস্যদের ভূমি বেদখল ও হয়রানির ফলে কেবলমাত্র বান্দরবান পার্বত্য জেলায় আদিবাসীরা তাদের ৩০টি গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়েছে। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্ম-অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে উদ্বেগজনকভাবে প্রতিনিয়ত বাঙালি মুসলমানদের রাজনৈতিক অভিবাসন চলছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অধিকাংশ ধারা (৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা) বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করা হচ্ছে। বস্তুত এখনো এক-তৃতীয়াংশ ধারা (৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা) বাস্তবায়িত হয়েছে। তার অর্থ হলো এখনো চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারার অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। জনসংহতি সমিতি ও দেশের নাগরিক সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের সাথে অব্যাহতভাবে সংলাপ চালিয়ে আসলেও এখনো পর্যন্ত কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একের পর এক প্রতিশ্রুতি প্রদানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে সরব থাকলেও দু:খজনকভাবে সেই প্রতিশ্রুতি প্রকৃত বাস্তবায়নে নেই।
অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, পার্বত্য পরিষদগুলোতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর প্রাধান্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসার জন্য যুক্তরাজ্য সরকারসহ সকল উন্নয়ন সহযোগী এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানান জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি মঙ্গল কুমার চাকমা।
উক্ত সেমিনারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্রাড এডামস, দক্ষিণ এশীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্বাস ফয়েজসহ বিভিন্ন আলোচকদের বক্তব্যে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট, সভা-সমিতি ও বাক-স্বাধীনতা হরণ, গুম-হত্যা, ক্রস-ফায়ার, সংখ্যালঘু-আদিবাসী নির্যাতন, জঙ্গী তৎপরতা, জঙ্গী মোকাবেলায় সরকারের অদক্ষতা ইত্যাদি বিষয়গুলো উঠে আসে। পক্ষান্তরে সরকার পক্ষ সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জঙ্গী মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপসমূহ তথ্য সহকারে তুলে ধরে।