জাতীয়

‘সরকারের প্রতিশ্রুতি ও আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুর বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

‘সরকারের প্রতিশ্রুতি ও আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুর বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক আলোচনা সভা আজ ২০ মার্চ ২০১৭ তারিখ বিকাল ৩টায় দি ডেইলি স্টার সেন্টারের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক যৌথ উদ্যোগে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সম্মানিত সদস্য ও আদিবাসী নারী নেত্রী সুলেখা ম্রং এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য শিরীন আখতার; উইমেন সাপোর্ট ও ইনভেস্টিগেশন ইউনিট, ডিএমপি এর ডেপুটি কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন; বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাস পুরকায়স্থ; মহিলা অধিদপ্তরের হালিমা বেগম প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা এবং আলোচনা সভার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ও কাপেং ফাউন্ডেশনের সদস্য ফাল্গুনী ত্রিপুরা। সভাটি পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাবেক তথ্য কমিশনার প্রফেসর ড. সাদেকা হালিম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বপ্ন ছিল এই দেশ হবে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলে সমান অধিকার ভোগ করবে। এরফলে স্বাধীনতা পরবর্তী এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার অনেকগুলো আন্তর্জাতিক আইন অনুস্বাক্ষর ও সহমত পোষণ করেছে। নীতিগতভাবে সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রতিকারের জন্য অনেক কিছু কাজ করছে কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে কিছু বাধা বা সমস্যা রয়েছে।
গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের ঘটনায় তিনি বলেন, মানবাধিকার কমিশন ঐ ঘটনায় মর্মাহত হয়েছে। দেশের নাগরিকের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে এটা অনেক বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন। তবে আমি জানাতে চাই সরকার নিজে এ ঘটনা কখনই ঘটায়নি। স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য এ ঘটনা সংঘটিত করেছে বলে আমরা অনুসন্ধানে পেয়েছি। আজকে সাঁওতালরা তীর ধনুক নিয়ে নিজেদের বাড়ি ঘর পাহারা দিচ্ছে যেটা সত্যিই আমাদের সকলের জন্য লজ্জার। গাইবান্দার উক্ত ঘটনায় উচ্চ আদালত স্বউদ্যোগে খুব গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে। আমরাও চেষ্টা করছি যাতে আদিবাসীদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ঘটনার ন্যায্য বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
তিনি আরো বলেন, দেশের সাধারণ জনগণের সাথে পাহাড়ী ও সমতলের আদিবাসীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিল। জীবন দিয়েছিল। কিন্তু এটা ভাবতে অবাক হতে হয় যে কেন পাহাড়ে সেনাবাহিনী থাকবে? এটাও স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। আদিবাসীদের ভূমি অধিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষের ভূমির অধিকার সহজাত অধিকার। যে যে জমিতে চাষবাস করবে বসবাস করবে অবশ্যই সে জমিতে তার অধিকারকে স্বীকার করতে হবে। আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারকে আমাদের বুঝতে হবে ও স্বীকৃতি দিতে হবে।

শিরীন আখতার বলেন, শুধু আদিবাসী নারী নয় দেশের সকল নারীর প্রতি সহিংসতার সকল ঘটনাগুলোর মূল উৎস কোথায়? তা আমাদের খুজে বের করতে হবে। গত ৪৬ বছরের এই বাংলাদেশে অনেক আবর্জনা তৈরি হয়েছে সেগুলোকে দূর করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় কাজ করতে হবে। নারীদের প্রতি সহিংসতার ঘটনায় বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, সরকার অনেক ভালো ভালো আইন পাশ করলেও সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে সঠিক ফলাফল আমরা পাচ্ছিনা। যেকোন ধরনের সহিংসতার ঘটনার বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেই সময়ের দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যাচ্ছে। এখন যদি কোন একটি ছোট ঘটনায় অনেক সময় লাগে তাহলে কিভাবে হবে? তাই এই সময়ের দীর্ঘসূত্রিতা অবশ্যই কমাতে হবে এবং সরকারীভাবে মনিটরিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও তিনি বলেন, আমাদের মনোজগতের পরিবর্তনও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে খুব জরুরী একটি বিষয়।

ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আমি নিজে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য হয়ে দেখেছি নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা যেন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। যা খুবই দুঃখজনক। আমি নিজে ঢাকা মেট্রোপলিটন এর ৪৯টি থানার ভিকটিম সাপোর্ট এর সেন্টারের দায়িত্বে আছি। প্রতিদিনই এখানে নারীরা সহিংসতার শিকার হয়ে আসছেন।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু পুলিশ একা এই কাজে সফল হবেনা। এখানে সব ধরনের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ফলে অনেকসময় দেখা যায় আমরা কষ্ট করে কোন জামিন অযোগ্য অভিযুক্তকে গ্রেফতার করলেও তারা আইনের ফাক দিয়ে জামিন নিয়ে বের হয়ে যায়। এখানে তখন আমাদের কিছু করার থাকনো।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে যতগুলো আইন আছে তা মনে হয় পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। কিন্তু আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা, সবকিছু মিলিয়ে আমরা ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করতে পারছিনা। আদিবাসীদের সাথে মূলধারার মানুষদের যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য সেগুলো বোঝাপড়ায় আমাদের সকল সরকারী বিভাগ, সাধারণ জনগণকে একই প্লাটফর্মে এসে আলোচনা করে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে বলে তিনি বলেন।

রাখী দাস পুরকায়স্থ বলেন, প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর নারীরা অনেক বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি লালন করছে ও সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। কিন্তু আমরা বেশীরভাগ সময় তাদের বেঁচে থাকার লড়াই-সংগ্রামকে বুঝতে পারিনা। সরকারের অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও আজকে বলা হচ্ছে তারা সেগুলো জানেনা। তাহলে তাদেরকে জানানোর ব্যবস্থা কে করবে? যেটুকু তারা জানেন সেটার বাস্তবায়ন কতটুকু? এটা ঠিক যে আদিবাসীদের জীবন ধারা আমাদের মতো নয়, তাই আমাদের মতো করে যে বিচার ব্যবস্থা সেটাতেও তারা ভরসা করতে পারেননা। এসমস্ত বিষয়কে আমলে নিয়ে আমাদেরকে দেশের সকল জনগণকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেগুলো যথাযথ বাস্তবায়নেরও দাবি করেন তিনি।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের হালিমা বেগম বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে নারীদের সহিংসতার রোধে বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু অনেক নারী জানেন না কোথায় গেলে তারা ন্যায্য বিচার পাবেন। তাই সরকারের সুযোগ সুবিধাগুলো নারীদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে। তিনি ১০৯ নম্বর উল্লেখ করে বলেন, এই নম্বরে ফোন করে বিনা খরচে নারীরা তাদের প্রতি সহিংসতার ঘটনার তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে পারে। এর পাশাপাশি সহিংসতার ঘটনাগুলোর বিচারিক কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে উপযুক্ত প্রমানাদি সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ আমাদের বিচার ব্যবস্থার মধ্যে কিছু দীর্ঘসূত্রিতা থাকার কারণেও অনেক সময় প্রমানাদি নষ্ট হয়ে যায় এবং তা ন্যায্য বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

বাগদা ফার্ম থেকে আগত সাঁওতাল নারী রুমিলা কিস্কু বলেন বাগদা ফার্মে সাঁওতালদের উপর হামলার ঘটনায় আমাদের পুরুষদের চাইতে আমরা নারীরা বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। এখনো আমরা ঐ ঘটনার বিচার দেখছিনা। আজকেও ৩৬ জন আদিবাসী গোবিন্দগঞ্জে তাদের উপর মিথ্যা মামলার ঘটনায় জামিন নিতে গিয়ে ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যারা অপরাধ করছে সরকার তাদেরকে গ্রেফতার করছেনা উল্টো আমরা যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি আমাদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে।

সাদেকা হালিম বলেন, এ দেশে নারীদের সহিংসতার ঘটনার কোন সিস্টেমেটিক তথ্য নেই। তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে এই ধরনের একটি ডেটাবেজ তৈরির জন্য আহ্বান জানান এবং দেশের সকল নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকারের কাছে দাবি জানান।

আলোচনা সভার মূল প্রবন্ধে ফাল্গুনী ত্রিপুরা যেসব সুপারিশ তুলে ধরেন তাহলো: আদিবাসী নারীর সকল মানবাধিকার নিশ্চিত করা; আদিবাসী নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা বন্ধে দ্রুত ও কার্যকর হস্তক্ষেপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা; আদিবাসী নারী ও শিশুর উপর সহিংসতার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা; সহিংসতার শিকার আদিবাসী নারী ও শিশুদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা প্রদান করা; নারী উন্নয়ন নীতিমালায় আদিবাসী নারীদের জন্য আলাদা একটা অধ্যায় রাখা এবং সকল ধরনের নীতিমালা গ্রহনের পূর্বে আদিবাসী নারী নেতৃবৃন্দের পরামর্শ গ্রহণ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা এবং এলক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করা; সমতলের আদিবাসীদের বেহাত হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা; আদিবাসী নারীদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা; আদিবাসী মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু কমানোর লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা; ভূমি ও সম্পত্তির উপর আদিবাসী নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং বন, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করা; শিক্ষা কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের জন্য কোটা নিশ্চিত করা এবং বিধবা ও বয়স্ক ভাতা নিশ্চিত করা; জাতীয় সংসদে অঞ্চলভিত্তিক এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আদিবাসী নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
এছাড়াও মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, অলিভিয়া হেমব্রম, সন্তোষিত চাকমা বকুল, নমিতা চাকমা, গৌরাঙ্গ পাত্র, সোহেল হাজং প্রমুখ।

Back to top button