সময়ের টানাপোড়েনঃ দীপায়ন খীসা
সময় বিষয়টা বদ্ধ গোলমেলে। তারপরেও সবকিছুই সময় দিয়ে চলে। এই চলার মধ্য দিয়ে আবার সময় বহেও যায়। কথায় বলে স্রোত আর সময় ফিরে আসেনা। দুটোই বহমান। কারও সময় জ্ঞান খুবই টান টান। আবার অনেকে সময় নিয়ে বেশ আয়েশী। কার সময় কিভাবে কাটে সেই বিষয়টা বের করা বেশ জটিল। সময় নিয়ে কিছুটা আলাপচারিতার একটা প্রয়াস চলটি রচনা।
সময় নিয়ে নানান জনের নানা মত। সময় চলে গেলে হয়ে যায় অতীত। আবার এই অতীত কখনও কখনও ইতিহাস হয়ে উঠে। অনেকে আবার এই সময়কে নানান কালে বা যুগেও ভাগ করেন। যেমন উপমহাদেশের চলতি শাস্ত্র মোতাবেক এাতা যুগ, সত্য যুগ ও কুলি যুগের কথা আমরা জানি। আবার ইতিহাসবিদরা বলেন প্রাগহৈতিহাসিক, মধ্য যুগ, আধুনিক যুগ। কিংবা প্রস্তর যুগ, বরফ যুগ ইত্যাদি। মার্কসীয় সমাজ বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন আদিম সাম্যবাদ, দাস সমাজ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ এটাই হচ্ছে সমাজ বিকাশের ক্রম। হাল নাগাদ উত্তর আধুনিকতা বলে একটা বিশেষ কালের কথাও আমরা জানতে পারি। তবে সময় গণনা বা বর্ষ গণনার আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে খ্রীস্টীয় সন। এই হিসেবে খ্রীষ্ট পূর্ব কিংবা চলতি খ্রীস্টাব্দ হচ্ছে সময় নির্ধারণের মানদণ্ড।
আমার বিচরণভূমির ক্ষেত্রটা খুবই ছোট। পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। তারই দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চল হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই পার্বত্য চট্টগ্রামেই আমার বেড়ে উঠা। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কিংবা পরিণত বয়সের এই আমি সবটাই পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়সের সম-সাময়িক যে প্রজম্ম সে প্রজম্মের যারা পার্বত্য এলাকার জীবনকে দেখেছে তাদের কাছে জীবন খুবই দুঃস্বপ্নের। মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগে বা যুদ্ধকালীন যাদের জম্ম পাহাড়ের জনপদে তারা বড় হয়েছে আরেক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। ৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ দুই যুগের অধিক পাহাড়ে যুদ্ধ জারি ছিল। সেই যুদ্ধের মধ্যে জীবনকে খোঁজা সত্যিই কঠিন ব্যাপার। মাথায়, কাঁধে কিংবা পিঠে সংসারের বোঝা নিয়ে নিত্য ছুটে চলত পাহাড়ের মানুষ। লক্ষ্য একটু নিরাপদ জীবন।
সেই প্রজম্মের একজন হিসেবে জীবনকে দেখেছি। শৈশব পেরিয়ে স্কুলের চৌকাঠ মাড়িয়ে কলেজের আঙ্গিনায় নতুন জীবন সন্ধান করেছি। পাঠক্রমের পাশাপশি অন্যান্য জ্ঞান অর্জনের জানালাগুলো খুলে দেখার কাজেও মনোনিবেশ করতে প্রচেষ্ঠা চালিয়েছি। কখনও ফেলুদা, কখনওবা প্রফেসর শংকু কিংবা জুলভার্ন-এ ডুবে যাওয়া। সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা আর ওয়েস্টার্ন কাহিনী পড়ে টেক্সাস-এর ট্রেইল ধরে কতবার ঘোড়া ছুটিয়েছি। দুস্য বনহুর, দুস্য পাঞ্জা, মাসুদ রানার কথা না বললেই নয়। ধীরে ধীরে ইস্পাত, মা, দুনিয়া কাঁপানো দশদিন এ চোখ বুলানো। আবার হুমায়ন আহমেদও থাকতেন সাথে। একটু একটু করে প্রগতি প্রকাশন-এর সাথে পরিচয় হতে থাকে। সমাজতন্ত্রের অ-আ-ক-খ সিরিজ নাড়াচাড়া করতে থাকি।
সোলস, ফিডব্যাক এর গানে তারুণ্যের ঝংকার তুলেছি, আবার ভুপেনও মনে গেঁথে নিতে শুরু করেছি। সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, টারজান সিরিজগুলির জন্য বিটিভি-র সামনে বসে থেকেছি। কিন্তু দি রুটস আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। নিগ্রোদের শেকল পড়ানো, তাদের দাস জীবন আর বিদ্রোহ আমার যুবা মনে নিদারুণ নাড়া দিয়ে যায়। এইভাবে একই সময়ের মধ্যে থেকেও মানুষ নানা টানাপোড়েনে জীবনকে খুঁজে নেয়। ছাত্র জীবনের শেষের সময়গুলোর একটা বড় অংশ কেটেছে কারাগারে। জীবনের প্রথম কারাবরণ ডিগ্রী পড়াকালীন সময়। প্রায় দেড় বছরের অধিক কারাজীবন। তার পর আরও ৩বার কারাগারে যেতে হয়েছে। তবে প্রথম কারাবরণটাই জীবনকে আমূল বদলে দেয়। নতুন এক জীবনে সমর্পিত করি। মার্কসীয় দর্শনের হাত ধরে জুম্ম জনগণের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে সমর্পণ করার অনুশীলনে যুক্ত হয়ে যাই।
এইভাবে বদলে যায় মানুষ। বদলে যাওয়া মানে চিন্তায় সৃজনশীল হওয়া। সমাজ বদলের সৈনিক হয়ে উঠা। তবে প্রায়ই মানুষ মনে করে তার অতীতই হচ্ছে স্বর্ণযুগ। তারা নষ্টালজিয়ায় হারিয়ে যায়। কিন্তু মানুষ তো ভবিষ্যত বিনির্মাণ করে। অনেকে হা হুতাশ করেন নতুনদের দিয়ে কিছু হবেনা। কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখি এই নতুনদের মাঝে। এই আমিও তো নিত্য নতুনকে বরণ করছি। কম্পিউটারে লিখছি। লেখাটাও ইমেইল-এ পাঠাবো। মোবাইল আর সেলফিতে আমিও হারিয়ে যাই। ফেসবুকে নিত্য নতুন স্ট্যাটাস তো জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে।
আমার ভালো লাগে যে আদর্শে আমি নিজেকে সমর্পিত করেছি সেই আদর্শে এখনও অনেক তরুণ হাটছে। বহু তরুণ মার্কসীয় সমাজ বিজ্ঞানের পাঠ নিচ্ছে। সময়কে প্রগতির পথে চালিত করছে বহু যুবা। নষ্ট সময়ের কাছে পরাজিত হয়নি এই রকম বহু যুবাকে আমি চিনি। পাহাড়ী জনপদে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, হালের নগর জীবনে অগণিত তারুণ্য বজ্রনিনাদ কণ্ঠে এখনও জীবনের জয়গান গেয়ে যাচ্ছে। ভোগবাদকে পরাজিত করার নিরলস প্রচেষ্ঠায় সমর্পিত তারুণ্যই গড়বে সুন্দর আগামী। এইভাবে সময়ের টানাপোড়েনের মধ্যে পাহাড়ী জনপদে তৈরী হতে থাকবে আগামীর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের মুখপাত্র কেওক্রডং-এ ৯ আগষ্ট ২০১৬ প্রকাশিত নিবন্ধ।