মতামত ও বিশ্লেষণ

মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬১ তম বর্ষপুর্তি ; সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষায় রাজনৈতিক অঙ্গীকারঃ পাভেল পার্থ ও মানিক সরেন

“নেরা নিয়ৗ নুরু নিয়ৗ
ডিঁডৗ নিয়ৗ ভিটৗ নিয়ৗ
হায়রে হায়রে ! মাপাক্‌ গপচ্‌ দ।
নুরিচ নাঁরাড় গৗই-কাডা,
নাচেল লৗগিৎ পাচেল লৗগিৎ
সেদায় লেকা বেতাবেতেৎ ঞাম রুয়ৗড় লৗগিৎ
তবে দেবন হুল গেয়া হো।”
( বাংলা অনুবাদ: স্ত্রী পুত্রের জন্য, জমি জায়গা বাস্তু ভিটার জন্য/হায় হায় এ মারামারি, এ কাটাকাটি।
গো-মহিষ, লাঙ্গল,ধন সম্পত্তির জন্য/পূর্বের মত সব আবার ফিরে পাবার জন্য, আমরা অবশ্যই বিদ্রোহ করব।)

মহান হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘঠিত হয় ১৮৫৫ সনে। গানটি তখনকার। এরকম অনেক গান ভারতের ভাগলপুর ডিভিশন এবং তৎকালীন বীরভূম জেলার গ্রামে গ্রামে সাঁওতালসহ নিম্নবর্গের জীবনে বিদ্রোহের উত্তাল তৈরি করেছিল। উপরোক্ত গানে আমরা দেখি নিজ পরিবার, জমি-জায়গা, সম্পদ ফিরে পাবার আকূলতা থেকে তৈরি দ্রোহকে সাঁওতালরা গানে রূপান্তরিত করেছে। আজকে এতো বছর পরেও যেন এই গানটির বাস্তবতা রয়েই গেছে। তাইতো আমরা দেখছি ব্রিটিশ শাসক, জমিদার, মহাজনদের মতো বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় বাহিনী, প্রশাসন, বিচার কাঠামো, আইন-আদালত আদিবাসীদের জমি-জঙ্গল-জলা কেড়ে নিয়ে অমানবিক ও অন্যায্য প্রান্তিকতায় ঠেলে দিচ্ছে। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক পালা বদল ও ভৌগলিক বিভক্তি আদিবাসী জীবন বার বার খন্ড-বিখন্ড করেছে। আদিবাসীরা দমেনি, থামেনি। জান দিয়ে স্বাধীন করেছে প্রিয় বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র অকৃতজ্ঞের মতো আদিবাসী জনগণকে অন্যায়ভাবে দূরে ঠেলে দাবিয়ে রেখেছে। আদিবাসী জনগণের উপর জুলুম আর জবরদস্তি জারি রেখেছে। রাষ্ট্রের বিচারহীন সংস্কৃতির ভেতর অস্বীকারের যাবতীয় জঞ্জাল মাড়িয়ে শত বাঁধা পেরিয়ে আজো আদিবাসী জনগণ বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতির রঙিন ডানা সমুন্নত রাখছেন। আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের মাতম তুলে কত না অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন কতজনে, কতভাবে। করুণ বিষয় হলো সেইসব অঙ্গীকার বারবার কোথায় যে হারায় আর মিলিয়ে যায় তার হিসাব রাষ্ট্রের কোনো কৌশলপত্র কী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আয়োজনে হদিশ করা হয় না। আমরা আজ বিস্তর কোনো ফিরিস্তি টানতে চাই না, আগপাছতলা আহাজারি গুলোও আজ ঘাঁটাবাছা করতে চাই না। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬১ বছরে দাঁড়িয়ে আজ স্পষ্টভাবে আবারো আদিবাসী সংশ্লিষ্ট অঙ্গীকারের বার্তাগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বলতে চাই এসব অঙ্গীকার সত্যিকারভাবেই রাজনৈতিক হয়ে ওঠুক। সাঁওতাল বিদ্রোহের মতই সাহসী আর মজবুত হয়ে দাঁড়াক।
কেন সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল?
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের কটক, ডালভূম, মানভূম, ছোটনাগপুর, পালামৌ, হাজারীবাগ, মেদনীপুর, বাকুরা, বীরভূম জেলায় সাঁওতালদের বসবাস বেশী ছিল। সেখানে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ করে বেশ শান্তিতেই সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেছিল। যে যতটুকু চাষাবাদ করতে পারে জমির উপর তার ভাগ ততটুকুই ছিল। আজকের মতো জমির কোন মালিকানার প্রয়োজন তখন ছিলনা। এই নিয়ে এক সাঁওতাল আর এক সাঁওতালের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করেছে এমনটাও কখনো হয়নি। এক ধরনের সমষ্টিগত মালিকানা এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও সৌহার্দ্যই ছিল সে সময়ের বড় দলিল। কিন্তু সাঁওতালদের এই সুখ-শান্তির উপর ব্রিটিশ সরকার ও তার দেশীয় দালালদের চোখ পড়ে যায়। জমিদারি প্রথা চালুর মধ্য দিয়ে জমির উপর খাজনা বসিয়ে দেয় ব্রিটিশ সরকার। দলে দলে ব্যবসায়ীরা ঐ অঞ্চলে ঢুকে পড়ে এবং ব্যবসার নামে সাঁওতালসহ অন্য আদিবাসীদের ঠকাতে শুরু করে। শুধু তাই নয় সুদখোর মহাজনদের খপ্পড়ে পড়ে সাঁওতালরা ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আর একবার যে ঋণ নিয়েছে সে কোনদিনই সেই ঋন পরিশোধ করতে পারেনি। ঋণের বোঝা চক্রবৃদ্ধি হারে শুধু বেড়ে গেছে। ঋণের দায় মেটাতে শেষ পর্যন্ত সাঁওতালদের ক্রীতদাসের জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন-
‘অধিকাংশ সাঁওতালেরই সামান্য ঋণ পরিশোধ করিবার মতও জমি ও ফসল থাকিত না। কোন সাঁওতালের পিতার মৃত্যু হইলে মৃতদেহের সৎকারের জন্য সেই সাঁওতালকে হিন্দু জমিদার বা মহাজনের নিকট হইতে কয়েকটি টাকা ঋণ করিতে হইত। কিন্তু ঋণের জামিন রাখিবার মত জমি বা ফসল না থাকায় সেই সাঁওতালটিকে লিখিয়া দিতে বাধ্য করা হইত যে, ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত সে ও তাহার স্ত্রী-পুত্র-পরিবার মহাজনের দাস হইয়া থাকিবে। ইহার ফলে পরদিনই সাঁওতালটি তাহার পরিবার লইয়া মহাজনের দাসত্ব করিতে যাইত। অবশ্য এ জীবনে তাহার ঋণ শোধ হইত না। কারণ, শতকরা তেত্রিশ টাকা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদের ঋণ কয়েক বৎসরের মধ্যে দশগুণ হইয়া যাইত এবং মৃত্যুর সময় সাঁওতালটি তাহার বংশধরের জন্য রাখিয়া যাইত কেবল পর্বতপ্রমাণ ঋণের বোঝা। যদি কোন ক্রীতদাস সাঁওতাল কখনও তাহার প্রভুর জন্য সমস্ত সময় কাজ করিতে অস্বীকার করিত, তাহা হইলে মহাজন তাহার আহার বন্ধ করিয়া এবং জেলের ভয় দেখাইয়া সাঁওতালটিকে বশে আনিত।
এর পাশাপাশি সাঁওতাল নারীদের ওপর ব্রিটিশ রাজপুরুষ ও জমিদার-মহাজনদের পাশবিক অত্যাচার ছিল নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। সে সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ঘটনা ছিল এরকম-
‘আমরা অবগত হইলাম যে রেলওয়ের কর্মচারীরা সাঁওতাল জাতির যুবতী স্ত্রীলোকদিগকে ধরিয়া বলাৎকার করিয়াছেন, কোনও কোনও স্ত্রীলোকদিগকে ধরিয়া পাঁচ-সাত দিবস আপনাদিগের নিকট রাখিয়াছেন, তাহাদিগের উদ্যান হইতে বল দ্বারা ফল কাষ্ঠাদি লইয়াছেন তাহার মূল্য দেন নাই, সাঁওতাল লোকদিগকে পরিশ্রম করাইয়াছেন অথচ মূল্য দেন নাই। বলবান জাতি এত অত্যাচার কেন সহ্য করিবেন?
এইধরনের ঘটনাগুলো শুধু সাঁওতালদের ক্ষেত্রেই ঘটেনি বরং সেখানকার সকল নিম্নবর্গীয় মানুষের উপরই এই অত্যচার জারি করা হয়েছিল । মূলত সেদিনের সেই জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবার জন্যই ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন চার ভ্রাতা সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব এবং তাদের দুই বোন ফুলো মুর্মু ও ঝানো মুর্মুদের আহ্বানে ৪ শতাধিক গ্রামের প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল ভারতের দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের ভগনাডিহি গ্রামে জমায়েত হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সরকার ও তাদের দেশীয় দালালশ্রেণী জমিদার, সুদখোর, মহাজন, ব্যবসায়ী, কণ্ট্রাকটার, পুলিশ-দারোগা, ভূমি অফিসারের কর্মচারী এবং বরকন্দাজদের জুলুম অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তির সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল। স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে ন্যায্যতার গণজাগরণ সৃষ্টি করে সাঁওতালসহ অন্য আদিবাসী নিম্নবর্গীয় মানুষেরা বিদ্রোহের শপথ পাঠ করেছিল।
ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের হাতেখড়ি
সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু সাঁওতালদের বিদ্রোহ বা শুধুমাত্র সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কোন বিদ্রোহ ছিলনা। এই বিদ্রোহকে অখন্ড ভারতের প্রথম ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে অভিহিত করলে নিশ্চয় ভুল হবেনা। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃত্ব ঠিক করেছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের দাবি দাওয়া ব্রিটিশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। সেই অনুযায়ি তারা ভগনাডিহি গ্রাম থেকেই পায়ে হেঁটে কলকাতা অভিমুখে যাত্রাও শুরু করেছিল। এর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সাঁওতালরাই প্রথম গণপদযাত্রা’র প্রবর্তন করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের ও নিম্নবর্গীয় মানুষের দুঃখ দুর্দশা না শুনেই বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে করে বিদ্রোহীরাও ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তীর-ধনুক হাতে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে প্রায় ৩০ হাজার সাঁওতাল নিহত হয়। ব্রিটিশ সরকারের বেশ কিছু অফিসারসহ দেশীয় দালালরা বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ দিলেও আধুনিক অস্ত্র বনাম তীর-ধনুকের অসম যুদ্ধে বিদ্রোহের অবসান ঘটে। বিদ্রোহী নেতৃত্বকে খুঁজে বের করে ফাঁসি দিয়ে বিদ্রোহ দমন করে ব্রিটিশ সরকার। সাঁওতাল বিদ্রোহকে অনেক লেখক বুদ্ধিজীবী মহল নানাভাবে নামকরণ করে এই ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিকতাকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে। “বাংলাদেশে ‘আরণ্য জনপদে’ নামে আদিবাসীদের নিয়ে বেশ নামকরা একটি বই আছে। গ্রন্থটির লেখক আবদুস সাত্তার ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘হাঙ্গামা’ বলে উল্লেখ করেছেন। কার্ল মার্কস তার ÔNotes on Indian History’ এ সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘গেরিলা যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১৩০০ সনে তার ‘ইংরাজের আতঙ্ক’ প্রবন্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হুলকে ‘সাঁওতাল উপবিপ্লব’ বলেছেন। ভারতীয় ইতিহাসকর দিগম্বর চক্রবর্ত্তীই সাঁওতাল সমাজের বাইরের কেউ, যিনি ১৮৯৫-৯৬ সালে লিখিত তার History of Santal Hul পুস্তকে হুলকে প্রথম হুল হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিলেন। সাঁওতাল বিদ্রোহেরই এক গর্বিত উত্তরাধিকার সিপাহি বিদ্রোহ, মুন্ডা-তেভাগা-নানকার আন্দোলনসহ আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামও এই ঐতিহাসিক হুলেরই স্পর্ধিত উচ্চারণ।
ইতিহাসের এক অনন্য কৃষক বিদ্রোহ
সাঁওতাল বিদ্রোহ ইতিহাসের এক অনন্য কৃষক বিদ্রোহও বটে। সেই সময়ে সাঁওতাল কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের মাধ্যমে ভূমির সাথে তাদের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ানো হয়েছিল। মূলত ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সাঁওতালসহ ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষকদের অধিকারে প্রথম আঘাত আসে। যার মধ্য দিয়ে কৃষকদের জমির একছত্র মালিক হয়ে ওঠে রাষ্ট্র। আদিবাসী জ্ঞান, ভূমির সাথে গড়ে ওঠা জনগণের ঐতিহাসিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সমষ্টিগত মালিকানার পরিবর্তে সৃষ্টি হয় ব্যক্তিগত মালিকানা। জমিদার-জোতদারদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে এদেশের সাধারণ কৃষক জনতা। তবে বৃটিশ সরকারের তৈরি করা ভূমি আইন ও খাজনা প্রথার মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া নিপীড়ণকে অস্বীকার করে সাঁওতাল বিদ্রোহের মতো কৃষকরা গড়ে তোলে একের পর এক বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহের শহীদ কৃষক-শ্রমিক জনতার নেতৃত্ব সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব-ফুলো-ঝানো মুর্মু’দের সংগ্রাম সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৬০-৬১ সালে নীল চাষিদের বিদ্রোহ, বর্তমান বাংলাদেশে (পাবনা ও বগুড়া) ১৮৭২ সালে ঘটে যাওয়া রায়ত অভ্যুত্থান, ১৮৭৫-৭৬ সালে দাক্ষিণাত্যের মারাঠা কৃষকদের অভ্যুত্থান, ১৯৪৬-৪৭ সালে বর্তমান বাংলাদেশের নাচোলের তেভাগা আন্দোলনসহ ইতিহাসের অন্যান্য কৃষক আন্দোলনও সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে প্রেরণা পেয়েছে। কিন্তু বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে কৃষক-শ্রমিক-আদিবাসী-নিম্নবর্গীয় জনগণের জমি প্রতিনিয়ত জবর দখল হয়ে যাচ্ছে। কেউ জাল দলিল তৈরী করে, মিথ্যা মামলা চাপিয়ে দিয়ে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে, দেশান্তরে বাধ্য করে, নারীদের প্রতি সহিংসতা করে এবং অনেকসময় হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে জমি-জঙ্গল-জলাধার জবর দখল করছে। বাদ যাচ্ছেনা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতো পবিত্র ভূমি। মানুষের মৃত্যুর শেষ ঠিকানা শ্মশান ভূমিও দখল হচ্ছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ বন বিভাগ এবং বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানিগুলোও ক্ষত বিক্ষত করছে পবিত্র ভূমিকে। যেখানে আদিবাসীদের জমিগুলোই ভূমি দখলকারীদের এক নম্বর টার্গেটে পরিণত হয়েছে। অথচ এই আদিবাসীরাই এদেশের শষ্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত অন্যতম জনশক্তি হওয়ার পরও জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হতে আজ নিঃস্ব এবং ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে।
লড়াই সংগ্রামের উত্তরাধিকার আদিবাসীরা বাংলাদেশে কেমন আছেন?
১৮৫৫ সালে আদিবাসীদের অবস্থা আর আজকে ২০১৬ সালে এসে সাঁওতালসহ বাংলাদেশের ৫৪টির অধিক আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় অবস্থার মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য নেই বললেই চলে। তখনো আদিবাসীরা শোষিত ছিল। এখনো তারা শোষিত। শাসকশ্রেণীর চেহারা বদলেছে কিন্তু শোষণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। তবে এক্ষেত্রে ভারতের আদিবাসীরা হয়তো কিছুটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষগুলোর উন্নয়ন বা মুক্তি যাই বলি না কেন ঠিক সেভাবে এখনো আসেনি। এখনও তাদের উপর চলছে নানা রকম জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যার মত জঘন্য ঘটনা। প্রতিনিয়ত ভূমি দখল ও হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে এ দেশের আদিবাসীরা। আদিবাসী নারীদের অবস্থাতো আরো ভয়াবহ। প্রচন্ড নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আদিবাসী নারীরা দিন পার করছে। প্রতিনিয়ত ক্ষেতে-খামারে, রাস্তা বা বিল্ডিং এর কাজ করতে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছে। কিন্তু কোনটারই বিচার হচ্ছেনা। পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে আদিবাসীদের মানবাধিকার। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আদিবাসীরা আশান্বিত হয়েছিল। কেননা ২০০৮ নির্বাচন পূর্ববতী তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের উন্নয়নের বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। যার মধ্যে ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষা করা। তবে দুঃখের বিষয় হলো সরকারের এই মেয়াদের পরে আবারো ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় থাকার পরেও সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে আন্তরিক নয়। তার উপর আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে আত্মপরিচয়ের দাবিকে অস্বীকার করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধীনতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে আদিবাসীদের আখ্যায়িত করেছে। সরকারের কেউ কেউ বলেছেন আদিবাসীদের উন্নয়নে এই সরকার অনেকটা আন্তরিক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা চেষ্টা করছেন। এর জন্য নাকি আরো সময় লাগবে। আমরা সত্যিই জানিনা আর কতদিন সময় লাগবে? পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং জাতীয় আদিবাসী পরিষদের মতো গণ সংগঠনগুলোই এখনো দ্রোহের আগুন জিইয়ে রেখেছে। হয়তো একদিন সেই আগুন শুধূ আদিবাসী নয়, এদশের গরীব কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে আবারো বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করবে। প্রতিষ্ঠিত করবে আদিবাসী আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি, গরীব খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিক জনতার ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি।
আদিবাসীদের জমি-জলা-জঙ্গল সুরক্ষায় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও বাস্তবতা
‘আমার মাটি আমার মা, কেড়ে নিতে দিবনা’; ‘ভূমি দস্যুদের বলে যাই, তোদের আর সময় নাই’; ‘খাতা কলমে মিল বন্ধ, সবার আছে জানা, সরকার কেন এই বিষয়ে হয়ে আছে কানা’; ‘এক দফা এক দাবি, ভূমি কমিশন কবে দিবি’;এইরকম অসংখ্য স্লোগানে স্লোগানে বারবার আদিবাসীরা নিজের জায়গা জমি সুরক্ষার জন্য সরকারের কাছে দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছে। রাজনৈতিক অনেক নেতৃত্ব, দল, সরকার আদিবাসীদের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। এদিকে একের পর এক জমি চলে যাচ্ছে আদিবাসীদের।
সমতলের আদিবাসী জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি স্বাধীন কার্যকর পূর্ণাঙ্গ ভূমি কমিশন। কারণ সমতল অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ কার্যত ভূমিহীন এবং তীব্র এক ভূমি অনিশ্চয়তার ভেতর কোনোরকমে টিকে থাকবার লড়াই করে যাচ্ছেন। জমি জিরাত ছিনিয়ে নেয়া, জবরদখল, উচ্ছেদ আর নানান উন্নয়নমূলক কর্মসূচি আদিবাসীদের ভূমি অন্যায়ভাবে দখল করছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে রাষ্ট্র আদিবাসীদের প্রতি বিমুখ। একটি ভূমি সমস্যারও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি। আলফ্রেড সরেন, গীতিদা রেমা থেকে শুরু করে প্রতিদিন সমতলের আদিবাসী গ্রামে ভূমি শহীদের সংখ্যা বাড়ছেই। চা বাগান থেকে শুরু করে গাইবান্ধার চিনিকলের আদিবাসী জমিন সবই উন্নয়নের মারদাঙ্গায় অবরুদ্ধ। সরকার আবার বিরোধপূর্ণ এসব ভূমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করতে চাইছে। শ্রীমঙ্গলের নাহার খাসি পুঞ্জিতে উচ্ছেদ নোটিশ দেয়া হয়েছে, মধুপুর শালবনে আবারো ইকোপার্ক করবার পাঁয়তারা চলছে, পাল্লাথল খাসি পুঞ্জি চলে যাচ্ছে অন্য রাষ্ট্রের দখলে, বৃহত্তর বরেন্দ্রভূমি জুড়ে আদিবাসীরা নিজ ভূমি থেকে প্রতিদিন উদ্বাস্তু হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আদিবাসীদের ভূমি নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোনোভাবেই কাংখিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সমুন্নত রাখা সম্ভব নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা নিরসনে প্রধান বাধা হয়ে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন না করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ জাতীয় সংসদে পাশ করা হয়। উক্ত আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে অনেক বিরোধাত্মক ধারা সন্নিবেশিত করা হয়। আইনের এসব বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনের জন্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ও ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৭ বছর এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে প্রায় ৭ বছর মোট ১৪ বছর ধরে একের পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু আজ অবধি উক্ত আইনের বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধিত হয়নি।আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের পূর্ববর্তী মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) একের পর এক সভা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালের জুন মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উক্ত আইনের ১৩ দফা সম্বলিত সংশোধনী প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। তদনুসারে আইনটি সংশোধনে আঞ্চলিক পরিষদের নানামুখী চেষ্টা সত্ত্বেও তা সফল হয়নি। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনের পর আবার নতুন করে এ আইন সংশোধনে আলোচনা শুরু হলে ৯ জানুয়ারি ২০১৫ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর ১৩-দফা সংশোধনী প্রস্তাব আবার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তদনুসারে জাতীয় সংসদের তৎসময়ে চলমান শীতকালীন অধিবেশনে উক্ত আইনের সংশোধনী বিল উত্থাপনেরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শেষ হওয়ার পর বাজেট অধিবেশনসহ জাতীয় সংসদের কয়েকটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেও বিলটি এখনো জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়নি। ফলে আইনটি এখনো অসংশোধিত অবস্থায় রয়েছে। বার বার ঐক্যমত্য হওয়া সত্ত্বেও এ আইনটি সংশোধন না হওয়া সত্যিই দু:খজনক ও উদ্বেগজনক।
২০১৫ সালে কমপক্ষে ৪৫টি আদিবাসী পরিবার নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে এবং ১৪০০টি পরিবার উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে ছিল, যাদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছিল ৬৫৭টি পরিবার। দখলকৃত ৫২১৬ একর ভূমির মধ্যে সমতলে ১১.৫ একর জমি সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তি দ্বারা দখল করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে বান্দরবানে আদিবাসী জুম্মদের জুম ও মৌজাভূমি বহিরাগতদের দ্বারা দখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রায় ১৩২৬.৯৯ একর ভূমি অবৈধ জবরদখল ও অধিগ্রহণের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ স্থল সীমান্ত চুক্তি ২০১৫ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে অনুমোদনের ফলে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাল্লাথল পুঞ্জির মোট ৩৬০ একর ভূমি ভারতের হাতে চলে যাওয়ার শংকায় প্রায় ৩৫০ টি খাসিয়া ও গারো পরিবার চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে। এতে করে তাদের জীবন জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
২০১৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ৩,৯১১ একর ভূমি সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তি কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং সেখানে ৮৪,৬৪৭ একর ভূমি জবরদখল ও অধিগ্রহণের জন্য প্রক্রিয়াধীন ছিল। বনবিভাগ কর্তৃক ৮৪,৫৪২ একর ভূমি রক্ষিত (রিজার্ভ) ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করেজুম্মদের জুম ও মৌজাভূমি দখলের প্রক্রিয়ার মধ্যেছিল। বিজিবি আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর ধারালঙ্ঘন করে ভূমি অধিগ্রহণ বা দখল করেছে। সমতলে বছরব্যাপী ১০২টি আদিবাসী পরিবার নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে এবং ৮৮৬টি পরিবার উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে রয়েছে, যাদেরমধ্যে রয়েছে সমতলের ৩০০ পরিবার। আদিবাসীদের ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে সমতল অঞ্চলের ৮৯টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ৬৪ টি আদিবাসী পরিবার ভূমিদস্যু কর্তৃক সংঘটিত আক্রমণের শিকার হয়েছে।
বর্তমান বাংলাদেশের সাঁওতাল সমাজ ও বিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি
যদিও সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধুমাত্র সাঁওতালদের ছিলনা তারপরেও ইতিহাসে ১৮৫৫-৫৬ সালে সংঘটিত এই বিদ্রোহটি সাঁওতাল বিদ্রোহ হিসেবেই পরিচিত। বিদ্রোহের নেতৃত্ব সাঁওতালদের হাতে ছিল বলেই হয়তো ইতিহাসে এমন নামকরণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের আদিবাসীদের সংখ্যা নিরূপণে সরকারগুলোর অনীহা এবং সাঁওতালসহ দেশের অন্যান্য আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করার উপর্যুপরি চেষ্টা থেকেই হয়তো বাংলাদেশ জন্মের এতো বছর পরেও এ দেশের আদিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। তারপরেও বিভিন্ন বেসরকারী তথ্যসূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ি সাঁওতালদের সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ধরা যেতে পারে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী জাতি হওয়ার পরেও সাঁওতালরা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মণিপুরী আদিবাসী জাতির তুলনায় আর্থ-সামজিকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে। বিশাল সাঁওতাল জনগণ বর্তমানে শিক্ষিত হলেও এ দেশের মূলধারার আদিবাসী আন্দোলনের সাথে এখনো সেভাবে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসকদেরই আরেক রূপ মিশনারীদের হাতে আজ বাংলাদেশের সাঁওতাল সমাজ অনেকটাই জিম্মি। সাঁওতালদের নিজস্ব ধর্মীয় পরিচয় এখনো অনুপস্থিত। যদিও খুব সম্প্রতি সরকার প্রভাবশালী ধর্মের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মকে সংবিধানে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নেতৃত্ব সিধু-কানু তাদের বিদ্রোহ সূচনার অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে সাঁওতালদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েছিল। বিদ্রোহের শুরুতে সাঁওতালদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সিধু-কানু ভগবানের নির্দেশ লাভের কথা প্রচার করেছিলেন এভাবে-
“একদিন রাত্রিকালে যখন সিধু ও কানু তাহাদের গৃহে বসিয়া চিন্তা করিতেছিলেন,….তখন সিধুর মাথার উপর একটুকরা কাগজ পড়িল, সেই মুহূর্তেই ঠাকুর (ভগবান) সিধু ও কানুর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর শ্বেতকায় মানুষের মত হইলেও সাঁওতালী পোশাকে সজ্জিত ছিলেন। তাঁহার প্রতি হাতে দশটি করিয়া আঙ্গুল, হাতে ছিল একখানি সাদা রঙের বই এবং তাহাতে তিনি কি যেন লিখিয়া ছিলেন। বইখানি ও তাহার সহিত বিশ টুকরা কাগজ তিনি দুই ভাইকে অর্পণ করেন। তারপর তিনি উপরের দিকে উঠিয়া শূন্যে মিলিয়া যান। আর এক টুকরা কাগজ সিধুর মাথার উপর পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে দুইজন মানুষ তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। এইভাবে একদিন নহে, সপ্তাহের প্রতিদিনই ঠাকুর আবির্ভূত হইয়াছিলেন।….বইয়ের পৃষ্ঠায় ও কাগজের টুকরাগুলিতে কতকগুলি কথা লিখিত ছিল। পরে শিক্ষিত সাঁওতালগণ তাহার অর্থ উদ্ধার করে। কিন্তু সিধু ও কানুর নিকট এর কথাগুলির তাৎপর্য কিছুমাত্র অস্পষ্ট ছিল না।”
এই ঘটনার পর অনতিবিলম্বে সিধু ও কানু তাঁহাদের গৃহসংলগ্ন উদ্যানে ঠাকুরের মূর্তি তৈয়ার করিয়া পূজার ব্যবস্থা করেন। ইতোমধ্যে তাঁহারা চতুর্দিকে শালবৃক্ষের শাখা প্রেরন করিয়া ঠাকুরের আবির্ভাবের কথা প্রচার করিয়া দেন। ঠাকুরের নির্দেশ শুনাইবার জন্য সকল সাঁওতালদের এক সমাবেশের দিন ধার্য করা হয়। যেটাকে আমরা ভগনাডিহি গ্রামে সহস্র সাঁওতালদের জমায়েত এবং যেখান থেকে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা বলে জানি। কিন্তু আজকের বাংলাদেশের সাঁওতালদের প্রেক্ষাপটে সেই ধর্মীয় বিশ্বাস অনেকখানিই হারিয়ে যেতে বসেছে। সাঁওতালদের ধর্মীয় আচার আচরণে যেমন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, ঠাকুরজিউ (ঈশ্বর) এরও বদল হয়েছে। সাঁওতালদের প্রথাগত বিচার কাঠামো আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। যেখানে ‘মৗঞ্জহিথান’ থাকছে না সেখানে মৗঞ্জহি ব্যবস্থাও আজ হুমকির সম্মুখীন। এর সাথে সাথে ঐতিহ্যগত বিবাহ পদ্ধতি (সিন্দরৗধান) এবং সাঁওতালদের অনেক ঐতিহ্য-সংস্কৃতিও আজ বিলীন হবার পথে। শুধু সাঁওতালদের ক্ষেত্রেই নয় এই জাতাভ্যিমানি রাষ্ট্র আদিবাসীদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য চর্চায় ও লালন পালনে এখনো সেভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। আশার কথা হলো প্রতিবছর সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস আসলে সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে একইসাথে আনন্দ ও বিদ্রোহের সুরধ্বনি আবারো জেগে ওঠে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ মাথা উঁচু করে বাঁচবার প্রেরণা
জমিদারি-মহাজনী শোষণ ব্যবস্থার মূলে আঘাত করেছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। প্রথম অবস্থায় মহাজন জমিদারদের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম শুরু হলেও অচিরেই এই অবস্থা সৃষ্টির মূলহোতা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধেই বিদ্রোহীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিলেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে ভুন্ডুল করে দিয়ে ইংরেজ সরকার ভেবেছিল পার পেয়ে যাবে। কিন্তু ইংরেজ সরকারের এই ষড়যন্ত্রকে ভুল প্রমাণিত করে সাঁওতালসহ গরীব নিপীড়িত কৃষক জনতা বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ইংরেজ সরকারের আধুনিক অস্ত্রের সাথে সামান্য তীর-ধনুক, লাঠি নিয়েই জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল। ইংরেজ সরকারের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহই ভারতবর্ষের মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য্য। যদিও ইতিহাস রচনাকারীরা বারবার আদিবাসী ও নিম্নবর্গীয় প্রকৃত ইতিহাসকে লুকানোর চেষ্টা করেছে এবং সাঁওতাল বিদ্রোহকে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করতে দ্বিধাবোধ করেছে। তারপরেও সাঁওতাল বিদ্রোহ স্বমহিমায় আজ উজ্জ্বলিত। তবে যে শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল আজকে সেই শ্রেণী শাসনের রূপ বদলালেও শোষন রয়ে গেছে। ব্রিটিশ শাসকরা পোশাক বদলেছে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে, ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সাঁওতালসহ অন্য আদিবাসী এবং নিপীড়িত, বঞ্চিত, কৃষক, শ্রমিক, নিম্নবর্গীয়দের উপর তাদের শোষন নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। নানা উপায়ে এক ধরনের অদৃশ্যমান উপনিবেশ তৈরি করে রেখেছে। তবে ইতিহাস বদলা নেয়, কৃষক-শ্রমিক-আদিবাসী জনতা প্রয়োজনে আবারো হুল (বিদ্রোহ) এর ডাক দিবে। সাঁওতাল বিদ্রোহের অনুপ্রেরনা আমাদের সকলকে যুগে যুগে মুক্তির স্বপ্ন দেখাবে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় রচিত আরেকটি সাঁওতালি একটি গান দিয়ে শেষ করছি। নিম্নোক্ত এই গানে ইংরেজ শাসকদের সৃষ্টি ‘বিদিন’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে। এই শব্দের মধ্য দিয়ে আজকের সাঁওতাল সমাজকেও ইংরেজরা বিভক্ত করে রেখেছে। তবে সাঁওতালরা কোনদিনই ব্রিটিশ এবং তাদের এই শেখানো শব্দকে ভালোভাবে নেয়নি। তাইতো সাঁওতালরা গান গেয়েছে:
‘সিধু-কানু হুল দয়
মাঁয়াম গাডা অৗতুয়েন
ইংরাজ সরকার আবো দিশৗম
মেতাঃবোনকো সাঁওতাল বিদিন’

(বাংলা অনুবাদ: সিধু-কানু বিদ্রোহ করেছে/ রক্তের নদী বয়ে গেল/ইংরাজ সরকার বলে আমাদের দেশ/আমাদের বলে সাঁওতাল নাস্তিক।
লেখক:
পাভেল পার্থ। লেখক ও গবেষক। [email protected]

মানিক সরেন; আদিবাসী সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী। [email protected]

Back to top button