মতামত ও বিশ্লেষণ

সদ্য প্রয়াত কবি বেলাল চৌধুরীকে নিবেদিতঃ আমার প্রিয় বেলাল দা

স্বাগতম চাকমাঃ আজ প্রথম আলো পত্রিকার ‘শিল্প-সাহিত্য’ পাতাটি পড়তে গিয়ে নিজের অজান্তেই দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কারণ, লেখাগুলো ছিল আমার প্রিয় ‘বেলাল দা’, কবি বেলাল চৌধুরীকে নিয়েই। তিনি গত ২৪ এপ্রিল ২০১৮ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্তের অভিযাত্রায় সামিল হয়েছেন। তাই তাঁকে নিয়ে এখন অনেকেই লিখছেন, স্মৃতিচারণ করছেন। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিলো এই মহান বাউণ্ডুলে কবির সান্নিধ্য লাভের। তাঁকে, তাঁদেরকে নিয়ে আমারও অনেক স্মৃতি আছে। অনেক অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা পেয়েছি তাঁর নিজের এবং কোলকাতায় তাঁর বন্ধুদের কাছ থেকে।
আমাদের দুজনেরই ঘনিষ্ঠ এক জাপানী বন্ধু সাংবাদিক রিউ হাসিমৌতোর মাধ্যমে বেলাল দার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিলো সম্ভবত ১৯৮৮ সালে। ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে। সেই শুরু এবং এরপর থেকে তাঁর স্নেহ-সান্নিধ্য আমার অস্তিত্ত্বের অংশ হয়ে গিয়েছিল। একদিন তিনি বললেন, কয়েকটা কবিতা দাও, আমার ‘ভারত বিচিত্রা’য় ছেপে দেবো। তখন তিনি ওই পত্রিকার সম্পাদক। ঢাকার ধানমণ্ডিতে তখনকার ভারতীয় হাইকমিশনের দুটো অফিস ছিল। তার একটিতে বসতেন আমাদের সবার প্রিয় কবি ও সম্পাদক বেলাল চৌধুরী, আমার বেলাল দা। কবির নির্দেশ মেনে একদিন সাহস করে ও ভয়ে ভয়ে গিয়ে তিন চারটি কবিতা তাঁর হাতে তুলে দিলাম। কিছুক্ষণ দেখে বললেন, ঠিক আছে, পর্যায়ক্রমে ছাপবো। এরপর আমি কোলকাতা চলে যাই। একদিন ভারসিটির ক্লাস শেষে ফিরে দেখি, আমার নামে সরকারি কোনও

বেলাল চৌধুরী
বেলাল চৌধুরী
দপ্তরের একটি চিঠি এসেছে। চিঠি খোলার পর আমার তো আবেগে-উল্লাসে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। দেখি, দূতাবাসের এক কর্মকর্তার চিঠিসহ ভারতের কেন্দ্রীয় ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র ১০০ রুপীর একটি চেক। ‘ভারত বিচিত্রা’য় আমার একটি কবিতা ছাপা হয়েছে, তাই এই সম্মানী। এর আগেও অন্য কয়েকটি পত্রিকায় আমার কিছু কবিতা ছাপা হয়েছিলো, কিন্তু কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই। তাই বেলাল দা’র এই উপহার ও স্বীকৃতি আমার কাছে যেন নোবেল প্রাপ্তির আনন্দের চেয়ে মোটেও কম কিছু ছিলোনা। ওই চেকটি ব্যাঙ্কে না ভাঙিয়ে আমি ল্যামিনেট করে এখনও পরম যত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। এখন বুঝি, বেলাল দা তখন আমার মতো এক অর্বাচীন বোহেমিয়ান আদিবাসি/পাহাড়ি ছেলেকেও কীভাবে অনুপ্রেরণা, সাহস যুগিয়ে নিজেদের মুক্ত অসীম কাব্যজগত ও সৃষ্টিশীলতার সাথে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলেন। তবে আমি পরবর্তীতে তাঁর এই স্বীকৃতির মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি, আমার একটি মূল্যবান পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়াসহ নানা ঝামেলায় লেখালেখিতে অনিয়মিত হয়ে পড়ার কারণে। একদিন ইকবাল রোডে ‘পাক্ষিক অনন্যা’র অফিসে দেখা হলে তিনি একপ্রকার ধমকের সুরেই বললেন, ‘কই, তোমার লেখা কই, কবিতা কই? তাড়াতাড়ি আমার অফিসে এসে কিছু লেখা দিয়ে যেয়ো। ইদানিং যোগাযোগ রাখনা কেন?’ সেটিই আমাদের শেষ দেখা। তখন তিনি দৈনিক ইত্তেফাক এর সাথে যুক্ত। সেবারও কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি বলে এখন অন্তরের অন্তঃস্থলে গভীর বেদনা অনুভব করি।
কবি বেলাল চৌধুরীর সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমি আর স্টুডেন্ট ভিসার জন্য ভারতীয় দূতাবাসের সামনে গণলাইনে গিয়ে দাঁড়াতাম না। আমার ছোট ভাইও তাই। বেলাল দার সাথে অফিস কক্ষে আড্ডা দিতে দিতেই ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত পেতাম। একদিন তেমনি এক আড্ডায় নানা কথার ফাঁকে পাহাড়ের অতি উপাদেয় করণবারি চাকমাদের ‘দচুনি’র প্রসঙ্গও উঠে এলো। আগে কখনো খেয়ে দেখেছেন কিনা জানতে চাইলাম। উনি বললেন, জীবনে কতো অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে হজম করে ফেললাম, আর তুমি এই প্রশ্ন করছো? ওটা তো আসলে অমৃতই। শক্তিদার (কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়) ‘কক্সবাজারে সন্ধ্যা’ কবিতাটি পড়েছো? ওখানে শুরুতেই যে ‘ব্ল্যাকডগ’ এর কথা বলা আছে, সেটি আসলে আমাদের ‘দোচুয়ানি’ই ছিল। কোনও ব্ল্যাকডগ, স্লাগদগ ওখানে ছিলনা, হা হা হা—। সে কি নির্মল হাসি ও সরল স্বীকারোক্তি বেলাল দার! উল্লেখ্য, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওই বিখ্যাত কবিতাটি আমি আর তরুণ স্যার মিলে (পশ্চিমবঙ্গের আরেকজন খ্যাতিমান কবি ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর তরুণ সান্যাল) ইংরেজিতে অনুবাদ করে একদা আমার সম্পাদনায় কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দি চাকমা ভয়েস’ নিউজলেটারে ছেপেছিলাম। বেলাল দাকেও যথাসময়ে ওই অনুদিত কবিতা এবং পত্রিকাটির কপি পাঠিয়েছিলাম।
লেখককে বেলাল চৌধুরীর চিঠি
লেখককে বেলাল চৌধুরীর চিঠি
এর বছর দুয়েক পর একদিন আমি ঢাকায় ফিরে এলে বেলাল দাকে ফোন দিই। তিনি জানালেন, লাতিন আমেরিকার কোন এক বিখ্যাত লেখকের বইয়ের অনুবাদ নিয়ে তাঁর এখন বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। বললেন, আগামীকাল দুপুরের দিকে হোটেল সোনারগাঁতে এসো। ওই বইয়ের লেখক ও প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নাকি আসবেন। গিয়ে দেখলাম, তিনি লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছেন। আমরা কফি খেতে খেতে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম, কারণ অতিথিরা আসতে একটু দেরি করছিল। এই ফাঁকে তিনি তাঁর কিছু অনুবাদ আমাকে পড়ে শোনালেন, আমিও ভয়ে ভয়ে কিছু মতামত দিলাম। তখন এরশাদ সাহেবের শাসনামল। আলোচনার এক ফাঁকে এরশাদ সাহেবের কাজের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি প্রচণ্ড ক্ষোভে (তবুও খুব শালীন তার বহিঃপ্রকাশ) বলতে লাগলেন, এই প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের ভালো ও শুভ সব কিছুকেই যেন ধ্বংস করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এয়ারপোর্টের সামনের রাস্তার দেয়ালে ও চারপাশে তিনি যে ম্যুরাল, ভাস্কর্য ও সাজসজ্জা করিয়েছেন, সেটি না এরাবিক, না ওয়েস্টার্ন, না ওরিয়েন্টাল। কী রুচি মানুষের! এতো ভালো পরামর্শ দিলাম, তাদের কেউই কিছু শুনলোনা। আমি সেদিন বেলাল দার আক্ষেপ, দুশ্চিন্তায় এবং বিক্ষুব্ধ চোখে মুখে দেশ নিয়ে তাঁর গভীর বেদনা ও হতাশার ছবিই দেখেছিলাম (যা পরে আমাকে লেখা একটি চিঠিতেও ফুটে উঠেছে)।
আমি কোলকাতা থেকে কালেভদ্রে ঢাকায় এলে তিনি তাঁর প্রিয় শহরের গল্প শুনতে চাইতেন। তাঁকে অফিসে গিয়ে বা ফোনে কোলকাতার গল্প শোনাতাম। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। মাঝে মাঝে বেশ নসটালজি্কও হয়ে যেতেন। কোলকাতায় সুনীলদা’র সান্নিধ্যে (প্রথিতযশা কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) আমাদের ক’জন বন্ধুর ঘটে যাওয়া একটি রহস্যময় ঘটনার কথা তাঁকে ফোনে ও চিঠিতে জানিয়েছিলাম। কিন্তু সেই রহস্যের সঠিক ও সুস্পষ্ট উত্তর কারও কাছে পাইনি। হয়তোবা সব কবি ও কবিতার মধ্যেই রহস্যময়তা নিজেই একটি রহস্যঘেরা গুপ্ত শক্তি হিসেবে বিরাজ করে বলেই পৃথিবীতে মাঝে মাঝে এমন সব ঘটনা ঘটে। সুনীলদা’র ডিকটেটকৃত এবং আমার স্বহস্তে লেখা সেদিনের কবিতাটি এখনও আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি। অন্য একদিন নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লিখবো।
তখন চিঠির যুগ ছিল, ইন্টারনেটের নয়। আমি চিঠি লিখতাম, তিনিও লিখতেন। একসময় বাস্তবতার, ব্যস্ততার কারণে চিঠি লেখালেখি একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। তবে মাঝে মাঝে ফোনে যোগাযোগ হতো। আমার ছোট ভাইকে বলতাম, ঢাকায় গেলে অবশ্যই বেলাল দা’র সাথে যেন সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করে। আমার এলোমেলো বোহেমিয়ান জীবনদর্শন বা অসাবধানতার কারণেও আমি নিজের জীবন থেকে অনেক মূল্যবান সময়, সম্পদ, চিঠিপত্র বা সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেছি। সে কারণে বেলাল দা, আমার বাবা, আদিবাসী লেখক-চিন্তাবিদ যামিনী দাদু, সাংবাদিক-লেখক ওবায়দুল হক, আমার কিছু বিদেশী বন্ধু এবং কলেজ জীবনের শিক্ষকসহ অনেকের আমাকে লেখা মূল্যবান চিঠি আমি অবলীলায় হারিয়ে ফেলেছি, যাঁদের সাথে আমার একসময় নিয়মিত একটা বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ ছিল। অবশ্য আজ অতীতের আনন্দ-বেদনার কিছু স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে অবশেষে বেশ কষ্টে বেলাল দার একটি চিঠি আবিস্কার করে ফেললাম। ১৯৯৪ সালের ৪ জুলাই তারিখে আমাকে লেখা একটি চিঠি, যার অনেকটা অংশ হয়তোবা কালের জলের ঝাপটায় এখন কিছুটা ঝাপসা হয়ে গেছে।
শামীম আপার (দেশের স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক) মনে আছে কিনা জানিনা। একদিন টেলিফোনে নানান কথার ফাঁকে বেলাল দা’র একটি ব্যক্তিগত/পারিবারিক সমস্যার কথাও উঠেছিল, যা নিয়ে আমিও খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ আমার নিজের পরিবারেও আমি সেরকম একটি দুর্বিষহ সমস্যার সমাধান করেছিলাম, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কষ্টের বিনিময়ে। শামীম আপাকে কিছু তথ্য জানালেও বেলাল দা’কে সরাসরি এ বিষয়ে কোনও পরামর্শ দেওয়ার সাহস আমি সঞ্চয় করতে পারিনি। কারণ, তিনি নিজে কখনও আমাকে ওই সমস্যার কথা জানান নি। আমি জানতাম, মন্ত্রী-আমলা-সিপাহি-শান্ত্রীসহ নানা স্তরে বেলাল দা’র অঢেল যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক। এপার ওপার দুই বাংলায় তাঁর বিশাল ও সুপ্রতিষ্ঠিত ভক্তকুল। তবুও চেয়েছিলাম, সঠিক ঠিকানা খুঁজে পেয়ে যেন তাঁর ওই সমস্যার সঠিক সমাধান হয়। পরে শুনলাম, সঠিক সমাধান হয়ে গেছে।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল, নিজের প্রকাশিতব্য প্রথম কাব্যগ্রন্থে একমাত্র বেলাল দা’ই প্রথম আশীর্বাণী দেবেন, মুখবন্ধ লিখবেন। মাত্র কিছুদিন আগে বন্ধু, সহকর্মী, প্রকাশক ও কবি বিলু ভাইকেও সে কথাই জানিয়েছিলাম। কিন্তু সেটি আর হলোনা। বেলাল দা আমাকে কোন কিছু না বলেই হুট করে চলে গেলেন। আমার প্রিয়তমা স্ত্রী প্রতিভা চাকমা বহুদিন ধরেই আমাকে তাগাদা দিচ্ছিলেন, এতদিন ধরে বলছো, কিন্তু বেলাল দা’র কাছে লেখাটা আনতে যাচ্ছনা কেন? তাহলে কী আমার স্ত্রীর অবচেতন মন বুঝতে পেরেছিল যে, বেলাল দা আর বেশিদিন আমাদের মাঝে থাকবেন না? তিনি বেশ অনেকদিন যাবত আমাকে এই তাগাদা দিয়ে আসছিলেন। বহুদিন আগে আমি নিজেও বেলাল দা’কে বলেছিলাম, আপনার একটি লেখা নেবো আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্য। তিনি বলেছিলেন, সব কবিতা একসাথে করে একদিন নিয়ে এসো, দেখে লিখে দেবো। আমার নিজের আলসেমি ও অবহেলায় কী যে অমূল্য একটি সম্পদ আমি হারিয়ে ফেললাম, তা আজ অশ্রুসিক্ত হৃদয় দিয়ে গভীরভাবে অনুভব করতে পারছি, বেলাল দা!
অনেক সময় আমি পাহাড়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত নিয়েও তোমার সাথে আলোচনা করেছিলাম। তুমি অতি সরলপ্রাণ ও নিখাদ একজন কবি মানুষ। তাই বলেছিলে, পাহাড়ের সব কবিকে নিয়ে একটি কবি সম্মেলনের আয়োজন করতে। তুমি এমন আয়োজনে যথাসাধ্য সহযোগিতা করবে। পাহাড়ের অর্ধেক মানুষ যদি কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তাহলে ওখানে আর সংঘাত হানাহানি থাকবেনা – এই ছিল তোমার উপলদ্ধি ও পরামর্শ। এখন ভাবছি, একমাত্র তোমার কবিসত্ত্বাই হয়তো পাহাড়ের সমস্যাটির গভীরতা সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছিল। অহিংসা, প্রেম, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, প্রজ্ঞা ও ক্ষমার চাষাবাদ ছাড়া পাহাড়ের সহিংসতার কোন সমাধান নেই। এবং কবিতার মাধ্যমেই সেসব প্রেম ও অহিংস দ্রোহের বাণী ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তোমাকে যতোটুকু জেনেছি, তোমার মতো অহিংস, মানবতাবাদী, পরোপকারী, নির্মোহ, স্বাধীন মানুষ ও কবি আমি আর একজনকেও বাংলাদেশে আমার চেনাজানার পরিসরে খুঁজে পাইনি, বেলাল দা। বরং দেখেছি, চেনাজানা প্রতিটি মানুষ যেন কোন না কোনও মাত্রায় হিংসা, প্রতিহিংসা লালন করছে (পরিচিত দু’জন বাদে)। তুমি কীভাবে এর ব্যতিক্রম ছিলে জানিনা। কোলকাতায় অবশ্য ঠিক তোমার মতোই নিঃস্বার্থ পরোপকারী, অহিংস মানবপ্রেমী অনেকজনকে পেয়েছিলাম। গভীর সান্নিধ্যে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ সম্মানে ভূষিত আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক তরুণ সান্যাল, অধ্যাপক শান্তিময় রায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ডঃ জয়ন্ত রায়, ডঃ পঞ্চানন সাহা, ডঃ স্বপ্না ভট্টাচার্য, অধ্যাপক হোসেনুর রহমান, লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন, শতরূপা সান্যাল প্রমুখের মহানুভবতা ও নিঃস্বার্থ পরোপকারিতাকে। এছাড়া ছিলেন অহিংসা ও মানবসেবার প্রতিমূর্তি মাদার তে্রিজাসহ আরও অনেকেই। বাংলাদেশের সব মানুষ ও কবি যদি তোমার মতোই হতো, তাহলে আজ পার্বত্য অঞ্চলসহ সারা দেশে কোনও অশান্তি, কোনও মৌলবাদ ও সহিংসতা থাকতো না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই সমান নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করতো। তাই তোমার নিজের এবং তোমার মতো কবিদের শত সহস্র বছর ধরে বেঁচে থাকাটা আবশ্যক ছিল, এদেশকে সব অর্থে সমতাপূর্ণ করে গড়ে তোলার জন্য। তবে আমি বিশ্বাস করি, দেহত্যাগ করলেও কবিরা কখনো মরেনা, তাদের চেতনাপ্রবাহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়না। তাই তুমিও হয়তো এই পৃথিবীর আলো-হাওয়া-জলে, আকাশে, অন্তরীক্ষে অস্তিমান হয়ে আমাদের উপর নিয়ত আলো ও আশীর্বাদ বর্ষণ করে যাচ্ছ। এই নশ্বর পৃথিবী থেকে তোমার প্রস্থানের সময় আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি বলে আমায় ক্ষমা করো বেলাল দা। তোমার সুচিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক ব্যর্থতাকেও আপন মহিমায় ক্ষমা করে দিয়ো। কারণ আমি জানি যে, এই রাষ্ট্র, সরকার, জনগণ, বন্ধুমহল ও শুভাকাঙ্খীরা আরও একটু সদয়, সচেষ্ট হলেই তোমাকে ইউরোপ-আমেরিকা না হোক; অন্তত সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা ইন্ডিয়ার কোনো একটি উৎকৃষ্ট হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতো। তার চেয়ে বরং তোমার তিরোধানের অনুষ্ঠানকেই তারা বড় করে সাজিয়েছে বলে দৃশ্যত প্রতীয়মান হয়। ইদানিং মৃত্যু পরবর্তী এহেন আয়োজন ও বক্তৃতাবাজি যেন আমাদের কৃত্রিম নগর-সমাজের একটি হালফ্যাশন বা অপরিহার্য নৈমিত্তিক সংস্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেলাল দা, আজ তোমার চিঠি আবারও পড়ে দু’ফোঁটা অশ্রুজলে আমার মতো করে তোমাকে স্মরণ করলাম। তোমাকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানালাম। তুমি তোমার মতো করে বুঝে নিও। দূর অন্তরীক্ষে, মহাকাশে, তারাদের সাথে মিশে তুমি ভালো থেকো, কবিতা লিখে যেয়ো, যেমনটি আমায় লিখতে বলতে সবসময়। আমি, আমরা কেউই কোনোদিন তোমাকে ভুলবোনা। তোমাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। তোমার প্রিয় জন্মভূমি ও বিচরণভূমি এপার ওপারের দুই বাংলাও চিরদিন তোমায় মনে রাখবে। প্রিয় বেলাল দা, দূর মহাকাশের নীলাভ অনন্ত অপারে তুমি ভাল থেকো। আমার প্রণাম নিও।
(বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ শেষের দুটি প্যারায় আমি বেলাল দাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছি, যা আমি সব সময় করতাম। এটি কোলকাতার/পশ্চিমবঙ্গের রীতি। ঘনিষ্ঠজনদের ‘তুমি’ বলে ডাকাটাই রেওয়াজ ওখানে। আমি সুনীলদাকেও (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) প্রথম পরিচয়েই ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছিলাম। বেলালদা পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত রীতিতেই বেশি অভ্যস্ত ছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অনেক ছাত্র-ছাত্রী পশ্চিমবঙ্গে পড়তে যায়। ওখানে গিয়ে তাদেরকে দুই বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণ ও সংস্কৃতিতে বিরাজিত সুক্ষ কিছু ভিন্নতার কারণে প্রথম দিকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়, যা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি। এই ‘আপনি-তুমি-তুই’ও তেমন একটি সমস্যা। ওখানে সহপাঠীদেরকে প্রথম পরিচয়েই সবাই ‘তুমি’ সম্বোধন করে, কেউ ‘আপনি’ বলেনা। এরপর কথা বলতে বলতেই সেটি সহজে ‘তুই’তে রূপান্তরিত হয় (প্রায় ক্ষেত্রে)। আর বাংলাদেশে সাধারণত কিশোর কিশোরীরা পর্যন্ত অপরিচিত হলে একে অপরকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে থাকে। দুই বাংলায় সম্বোধনের এই পার্থক্য সমবয়েসীদের মধ্যেকার সম্পর্ক বা বন্ধুত্বকে কতটুকু প্রভাবিত করে, কিংবা সম্পর্ককে কতটুকু কৃত্রিম বা গভীরতর করে; তা নিয়ে কোনো গবেষণা আছে কিনা জানিনা। তবে আমার বিশ্বাস, বেলালদা এবং আমি দু’জনেই কোলকাতান রীতিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম, যদিও তাঁকে চিঠি লিখতে গিয়ে প্রথম দিকে আমি ‘বাঙাল’ রীতিই অনুসরণ করেছি। যাহোক, এখানে স্মৃতি-স্মারক হিসেবে আমাকে লেখা বেলাল দা’র একটি চিঠি সংযুক্ত করলাম। সবাইকে অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।)
স্বাগতম চাকমা, লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

Back to top button