অন্যান্য

সংবাদ সম্মেলনের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার মূল বক্তব্

আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে রাজধানীর সুন্দরবন হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরার সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বক্তব্য প্রদান করেন। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী রূপম।

উক্ত সংবাদ সম্মেলনের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার মূল বক্তব্য নিচে হুবুহু দেওয়া হলঃ

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
আপনারা জানেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দীর্ঘ ১৯ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। দীর্ঘ ১৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী হস্তান্তর; পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণসহ পুনর্বাসন; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ, চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। সুদীর্ঘ ১৯ বছরের মধ্যে চারটি রাজনৈতিক সরকার ও দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার- মোট ছয়টি সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসলেও কোন সরকারই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা অবগত আছেন যে, ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত জুম্ম জনগণ বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হতে অধিকতর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে স্বাধীনসত্তা ও স্বকীয় শাসনব্যবস্থা নিয়ে বসবাস করতো। পরবর্তীতে এ অঞ্চলটি ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে গেলেও প্রকৃতপক্ষে একটা সময় পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসকরা জুম্ম জনগণের স্বশাসন ব্যবস্থা তথা আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন হস্তক্ষেপ করেনি। ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে একটি জেলা হিসেবে ঘোষণা করার পর এই এলাকার শাসন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হলেও বস’ত জুম্ম জনগণের পৃথক শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা হয়।
ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য অনেক জেলার মতো ১৮৭৪ সালের তফসিলভুক্ত জেলা আইন মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকেও তফসিল জেলা ঘোষণা করে জুম্ম জনগণের পৃথক শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা হয় – যা পরবর্তীতে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির মাধ্যমে পাকাপোক্ত করা হয়। উক্ত শাসনবিধিতে বহিরাগত কোন ব্যক্তির পার্বত্য চট্টগ্রামে বিনানুমতিতে প্রবেশ ও স্থায়ী বসতিস্থাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। পরবর্তীতে ১৯১৯ সাল ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অন্যান্য অনেক অঞ্চলের ন্যায় ‘শাসন বহির্ভূত এলাকা’ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। পাকিস্তান শাসনামলেও ভারতের স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭-এ বর্ণিত আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কিত বিধান অনুযায়ী ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বলবৎ ছিল ও ১৯৬২ সালে উপজাতীয় অঞ্চলের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা হয়।
কিন’ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়নের ফলে জুম্ম জনগণের জীবন অত্যন্ত দূর্বিসহ হয়ে উঠে। সরকারি প্রশাসনের অবিচার ও নিপীড়ন এবং বহিরাগত ব্যবসায়ীদের একাধিপত্যমূলক চরম শোষণ, সমতলবাসীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ ও বসতি স্থাপন ও ভূমি জবরদখলের প্রেক্ষিতে জুম্মদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে এই নিপীড়নের মাত্রা চরম আকার ধারণ করে। সঙ্গত কারণে মহান বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলন দানা বাঁধে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও এ পরিসি’তির আরো অবনতি ঘটে।
১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, জাতীয় পরিচিতি এবং পৃথক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারের নিকট আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। কিন্তু জুম্ম জনগণের প্রবল দাবি সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসনব্যবস্থা নিয়ে কোন কিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের নাগরিকরা বাঙালি বলে অভিহিত হবেন মর্মে সাংবিধানিক বিধান গ্রহণের মাধ্যমে ভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারী জুম্ম জাতিসমূহকে বাঙালি হিসেবে অভিহিত করা হয়, যা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদের অধিবেশন বর্জন করেন। অপরদিকে জুম্ম জনগণের দাবি পূরণের পরিবর্তে সরকার একের পর এক দমন নীতি গ্রহণ করতে থাকে। তদুদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে দীঘিনালা, আলিকদম ও রুমায় তিনটি সেনানিবাস স্থাপন করা হয়। ১৯৭৫ সালে দেশে সামরিক শাসন জারী হলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে জুম্ম জনগণের উপর সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর অভিযান ও নির্যাতন জোরদার হয়ে উঠে। অতঃপর জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সাল হতে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে উঠে। জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘু করার হীনউদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সাল থেকে সরকারি পরিকল্পনাধীনে সমতল জেলাগুলো থেকে পাঁচ লক্ষাধিক বহিরাগত বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জায়গা-জমির উপর বসতি প্রদান করা হয়।
সশস্ত্র আন্দোলন অব্যাহত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বরাবরই রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের পথ উন্মুক্ত রাখে। এ প্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমানের সরকার শান্তি আলোচনার জন্য সীমিত উদ্যোগ হাতে নেয়। পরে ১৯৮৫ সালের ২৫শে অক্টোবর হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে পরিচিহ্নিত করে এবং রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানে ঐক্যমত্য হয়। জেনারেল এরশাদ সরকারের (১৯৮৩-১৯৯০) সাথে ৬ বার, বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের (১৯৯১-১৯৯৫) সাথে ১৩ বার এবং শেখ হাসিনা সরকারের (১৯৯৬-২০০১) সাথে ৭ বার অর্থাৎ মোট ২৬ বার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ধারাবহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান প্রদান করা। তদুদ্দেশ্যে চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস’া কায়েম করা, জুম্ম জনগণের জাতিগত অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশ করা, বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন প্রদান ও ভূমি সমস্যা নিষ্পত্তি করা, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস’দের পুনর্বাসন করা, জুম্ম জনগণের অর্থনৈতিক ও ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার বিধান করা হয়।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ৩ বছর ৮ মাস সময়ের মধ্যে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক চুক্তি মোতাবেক সংশ্লিষ্ট কতিপয় আইন প্রণয়নসহ কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থাপন, টাস্ক ফোর্স গঠন ও ভারত থেকে জুম্ম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, ৬৬টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্যতম। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তৎকালীন সরকার এগিয়ে আসেনি।
তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার (১৯৯৭-২০০১) শুধু চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে যায়নি, পাশাপাশি চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী অনেক কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
ক্স ১ সেপ্টেম্বর ২০০১ হতে সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারি করা হয়। যার বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়নসহ সকল ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও কর্তৃত্ব অব্যাহত রয়েছে।
ক্স ১৯ জুলাই ১৯৯৮ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ কার্যাদি বিভাগ থেকে সেটেলার বাঙালিদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস’ হিসেবে বিবেচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
ক্স তিন সার্কেল চীফের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলায় জেলা প্রশাসকরা স’ায়ী বাসিন্দার সনদপত্র ইস্যু করতে পারবেন মর্মে ২১ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এক অফিসাদেশ জারি করা হয়।
ক্স আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে ১৭ জুলাই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১’ জাতীয় সংসদে পাশ করা হয়, যেখানে চুক্তির সাথে অনেক বিরোধাত্মক ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এছাড়া তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সেটেলার বাঙালিদের দ্বারা জুম্মদের উপর বাঘাইহাট, বাবুছড়া, বোয়ালখালী-মেরুং ও রামগড়ে ৪টি সংঘবদ্ধ সামপ্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়। কিন’ এসব হামলায় দায়ী কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য’কে ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সমপ্রসারণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকায় বহিরাগতদের অন্তর্ভুক্তকরণ; বহিরাগতদের নিকট ভূমি বন্দোবস্তী ও ইজারা প্রদান; জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘু করার লক্ষ্যে নতুন করে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটানো ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বলেছিল যে, তারা ক্ষমতায় আসলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাতিল করবে। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাতিল করেনি। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ‘জেলা ও উপজেলা যুব উন্নয়ন কার্যালয়’ রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করে। তবে চুক্তি বাতিল না করলেও চার দলীয় জোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে নানাভাবে ক্ষুণ্ন করে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস’ার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
ক্স পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জুম্মদের মধ্য হতে মন্ত্রী নিয়োগ না করে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে রাখা হয়।
ক্স পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে একজন যোগ্য উপজাতীয় প্রার্থীকে নিয়োগ না করে একজন বহিরাগত অউপজাতীয়কে নিযুক্ত করা এবং জুম্ম স্বার্থ বিরোধী উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা হয়।
ক্স পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন না করে তৎকালীন এলজিআরডি মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রিপরিষদ কমিটি গঠন করে কালক্ষেপণ করা হয়।
ক্স নতুন ২৮,০০০ সেটেলার বাঙালি পরিবারকে রেশন প্রদান ও ১০,০০০ বহিরাগত বাঙালি পরিবারকে সাজেক এলাকায় পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র করা হয়।
ক্স প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তা দিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন’ নামে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সামপ্রদায়িক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও তার মাধ্যমে সামপ্রদায়িক তৎপরতা জোরদার করা হয়।
ক্স প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বান্দরবান জেলায় নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা, লামা, আলিকদম ও সদর উপজেলায় মায়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের স’ায়ী বসতি প্রদান করা ও তাদেরকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সর্বোপরি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে বহিরাগত মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনী ও সিভিল প্রশাসনের মাধ্যমে অত্যন্ত সুক্ষ্ম পরিকল্পনাধীনে বহিরাগত বাঙালি অনুপ্রবেশ ও বসতি প্রদানের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লঙ্ঘন করে পূর্বের মতো ২০০৬ সালে বহিরাগতদের অন্তর্ভুক্ত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। বান্দরবানের রাজভিলা, খাগড়াছড়ির ভূয়াছড়ি, মহালছড়ি ও মাইসছড়িতে ৪টি সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলাসহ জুম্মদের ভূমি জবরদখলের জন্য বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের মদদ দেয়া হয় এবং এলক্ষ্যে তাদেরকে নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তা প্রদান করা হয়।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
দেশের জাতীয় রাজনীতির এক সংঘাতময় অবস’ায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী সারা দেশে জরুরী অবস’া জারী করা হয়। ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সারা দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিসি’তি উদ্বেগজনক, অসি’তিশীল ও নিরাপদহীন হয়ে উঠে। এ সরকারের আমলে জরুরী অবস’ার সুযোগে জুম্ম জনগণের উপর ধর-পাকড়, জেল-জুলুম ও হয়রানি বৃদ্ধি পায়। এ সময় জনসংহতি সমিতি ও এর অঙ্গ সংগঠনের অর্ধ-শতাধিক নেতা-কর্মীসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত নেতৃস’ানীয় ব্যক্তিদেরকে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় অভিযুক্ত করা হয় এবং অনেককে মিথ্যাভাবে সাজা দেয়া হয়। জুম্ম জনগণকে তাদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করে বহিরাগত অভিবাসীদের বসতি স’াপনের কার্যক্রম জোরদার করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। জাতীয় পর্যায়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশংসনীয় সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও আগেকার রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতো সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে চরম উপেক্ষা করতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লঙ্ঘন করে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি’কে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে পদদলিত করে ২০০৭-০৮ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকায় অস’ায়ী ও বহিরাগত বাঙালীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
২০০৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়। শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ সাল থেকে আজ অবধি প্রায় ৮ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে কতিপয় বিষয় হস্তান্তর, ৩৫টি অস’ায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার, ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স’াপন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন ইত্যাদি চুক্তির কতিপয় বিষয় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে এসব উদ্যোগে ছিল ধারাবাহিকতা এবং দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
পক্ষান্তরে দেশ-বিদেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করতে সরকার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে’ বলে অসত্য বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। বস’ত ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের এই দায়সারা উদ্যোগ, চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে গড়িমসি, চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে অসত্য তথ্য প্রচার ইত্যাদি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সরকার জুম্ম জনগণসহ পার্বত্যবাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় চরমভাবে অনাগ্রহী। তাই সরকার কেবল চুক্তি বাস্তবায়নে তালবাহানা নয়, সেই সাথে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম-স্বার্থ পরিপন’ী কার্যক্রম অব্যাহতভাবে বাস্তবায়ন করতে থাকে। চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম-স্বার্থ পরিপন’ী কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
ক্স পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র জোরদার করা হয়েছে।
ক্স আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস’ার পরিবর্তে ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর নামে একপ্রকার সেনা শাসন ও কর্তৃত্ব জারি রেখে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে অথর্ব করে রাখা হয়েছে।
ক্স জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি প্রত্যর্পণের পরিবর্তে ঠেগামুখে স’ল বন্দর স’াপন, ঠেগামুখ-চট্টগ্রাম বন্দর সংযোগ সড়ক ও সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, সেনাবাহিনী কর্তৃক বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স’াপন, রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, বিজিবির বিওপি স’াপন, কাচলং-সীতা পাহাড় ভূ-গঠনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন ইত্যাদি তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
ক্স প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষাকে অবহেলিত অবস’ায় রেখে শিক্ষা প্রসারের নামে তথা চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে রাঙ্গামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স’াপনের মাধ্যমে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন’ী রাজনৈতিক কেন্দ্র স’াপন করার প্রক্রিয়া চলছে।
ক্স জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখলের উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং উগ্র জাতীয়তবাদী শক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদ দিয়ে কমপক্ষে ১০টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত করা হয়েছে।
ক্স জুম্মদের মধ্যে তাবেদার গোষ্ঠী সৃষ্টি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।
ক্স জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পূর্ণাঙ্গ পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠনের পরিবর্তে দলীয় সদস্যদের দিয়ে অন্তর্বর্তী পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করা হয়েছে এবং পার্বত্যবাসীর বিরোধীতা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী পরিষদের সদস্য-সংখ্যা পাঁচ থেকে ১৫ জনে বৃদ্ধি করে একতরফাভাবে ২০১৪ সালে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং তার মাধ্যমে অগণতান্ত্রিক ও দলীয়করণের ধারা আরো জোরদার করা হয়েছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের সকল সম্ভাবনা নস্যাৎ হতে চলেছে। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে নানাভাবে পদদলিত করে চলেছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস’ার মর্যাদা চিরতরে ক্ষুন্ন করার পাঁয়তারা চলছে। ফলে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিসি’তি উদ্বেগজনক ও নিরাপদহীন হয়ে উঠে।
সেনাশাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়োজিত সেনা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে চলেছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। অথচ ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তিন বাহিনীর সম্মতিতে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। অপরদিকে সন্ত্রাসী তল্লাসীর নামে নির্বিচারে ধর-পাকড়, মধ্যযুগীয় কায়দায় মারধর, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেল-হাজতে প্রেরণ, জনসংহতি সমিতির অফিস তল্লাশী ও ভাঙচুর ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ অব্যাহতভাবে চলছে। গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সেনা-বিজিবি-পুলিশী অভিযানে বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান ও বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের একজন সদস্যসহ জনসংহতি সমিতির ৩০ জন সদস্য-সমর্থক ও নিরীহ গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ৮৯ জনকে মারধর করা হয়েছে, ৫৮ জনকে সাময়িক আটক ও হয়রানি করা হয়েছে এবং জনসংহতি সমিতির তিনটি অফিসসহ ২৩টি ঘরবাড়ি তল্লাসী ও তছনছ করা হয়েছে।
আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে বহিরাগত মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের ছত্রছায়ায় সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক অত্যন্ত সুক্ষ্ম পরিকল্পনাধীনে বহিরাগত বাঙালিদের অনুপ্রবেশ ও বসতি প্রদানের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরুদ্ধে ২০০০ সালে জনৈক বদিউজ্জামান ও ২০০৭ সালে এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম কর্তৃক পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উগ্র সামপ্রদায়িক তৎপরতা ও সেনাশাসনের সুযোগে ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো সারাদেশের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সেটেলারদের মধ্যে ঘাঁটি গড়ে তুলছে।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় জুম্মদের আবাসভূমি ও ধর্মীয় স’ানসহ রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় ভূমি বেদখল এবং স্বভূমি থেকে তাদেরকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও আইন মোতাবেক জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার নিশ্চিত না করে বিজিবি ক্যাম্প স’াপনের নামে, পর্যটন কেন্দ্র স’াপনের নামে, রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণার নামে, ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হর্টিকালচার ও রাবার চাষের নামে ইজারা প্রদান করে হাজার হাজার একর জুম্মদের সামাজিক মালিকানাধীন জুমভূমি ও মৌজাভূমি জবরদখল করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পরও ভূমি জবরদখলের কারণে কেবলমাত্র বান্দরবান জেলায় আদিবাসী জুম্মরা তাদের ৩০টি গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। স’ানীয় সেনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সাজেকে পর্যটন কেন্দ্র স’াপন বা স’াপনের জন্য ভূমি জবরদখলের কারণে রুইলুই-এর দুটি ত্রিপুরা গ্রামের ৬৫ পরিবার, বান্দরবানের সেপ্রু পাড়ার (জীবননগর) ১২৯ ম্রো পরিবার, আলিকদম-থানচির ক্রাউডং পাহাড়ের (ডিম পাহাড়) দুই শতাধিক ম্রো পরিবার, বান্দরবানে বগা লেকের ৩১টি বম পরিবার গ্রামবাসী উচ্ছেদের মুখে রয়েছে এবং তাদের জীবনজীবিকা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ এবং পুলিশ প্রশাসনের পুলিশ সুপার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রায় সকলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী নন। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ জুম্ম জনগণের জীবনধারার প্রতি সংবেদনশীল নন। তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন’ী। ফলত: পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করা বহুলাংশে সম্ভবপর হচ্ছে না। এ কারণেই এ যাবৎ আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লঙ্ঘন করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস’াপনা, উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যাবলী চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৯৭ সালে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করা হলেও তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স’ানীয় নেতৃত্ব পুরোদমে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন’ী ভূমিকা পালন করে চলেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স’ানীয় শাখাসংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে একশ্রেণির জুম্মদের প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী ভূমিকা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস’ার অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেব তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হলেও আওয়ামীলীগের স’ানীয় নেতৃত্ব এসব পরিষদগুলোকে দলীয়করণ ও দুর্নীতির আখড়ায় এবং শাসকগোষ্ঠীর দালালী ও সুবিধাবাদী সংস’ায় পরিণত করে অথর্ব প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে। সারাদেশে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ তথা সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হলেও পার্বত্যাঞ্চলে সেই জঙ্গীবাদ বিরোধী কার্যক্রমকে ব্যবহার করা হচ্ছে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণের ন্যায্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে। চুক্তি বাস্তবায়নের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে অপপ্রচার চালিয়ে সেনা-বিজিবি-পুলিশসহ স’ানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পার্বত্য জেলার স’ানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র, দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক হয়রানি চালিয়ে আসছে। তারই অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামীলীগের প্রত্যক্ষ মদদে আঞ্চলিক পরিষদের দুইজন সদস্য, উপজেলা পরিষদের দুইজন চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান ও দুইজন সদস্য এবং একজন মৌজা হেডম্যানসহ জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সহযোগী সংগঠনের ১৩০ জন সদস্য-সমর্থক ও নিরীহ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের, তিনজন সদস্যকে খুন এবং অন্তত দেড় শতাধিক সদস্যকে এলাকাছাড়া করা হয়েছে।
দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে অনেক সোচ্চার হলেও এসব দল ও সমাজ নিজস্ব কর্মসূচী নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে এগিয়ে আসেনি। এযাবৎ আদিবাসী সংগঠনের উদ্যোগে আহুত কর্মসূচীতে যোগ দিয়ে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতি সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশের মধ্যে এসব দল ও সংগঠনের কর্মসূচী সীমাবদ্ধ রয়েছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ যেভাবে এগিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল সেভাবে নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে তাদেরকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। বস’ত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায়।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিসি’তি অত্যন্ত নাজুক। পার্বত্যবাসীরা, বিশেষত: জুম্ম জনগণ নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত এক চরম বাস্তবতায় মুখোমুখী হয়ে কঠিন জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। জুম্ম জনগণ এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিসি’তি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। বস’ত: পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে রক্ত-পিচ্ছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণ তথা পার্বত্যবাসীর অধিকার সনদ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অর্জিত হয়েছে। দেশের শাসকগোষ্ঠীর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি ও কালক্ষেপণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিসি’তিকে আবারও জটিলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার যে কোন ষড়যন্ত্র এবং জুম্ম জনগণের এই চুক্তি বাস্তবায়নের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের যে কোন চক্রান্ত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। বলাবাহুল্য, জুম্ম জনগণ তার অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে যে কোন বিকল্প পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে এবং তার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিসি’তির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে চুক্তি-পরিপন’ী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী যে কোন ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণ বরাবরের মতো সদা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বার্ষিকীতে আবারো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ইত্যাদিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন করা; আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে যথাযথভাবে হস্তান্তর করা; ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস’ায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার এবং স’ানীয় পার্বত্য পুলিশ বাহিনী গঠন করা; প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস’দের পুনর্বাসন করা, যথাযথভাবে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা ও সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন করাসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পূর্ব-ঘোষিত দশদফা কর্মসূচির ভিত্তিতে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহতভাবে চালিয়ে নেয়ার ঘোষণা করছে।
আপনাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

Back to top button