জাতীয়

সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলার নিন্দা দেশের ২৭ বিশিষ্টজনের

আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা, অগ্নিসংযোগের নিন্দা ও নিরাপত্তার দাবি এবং নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের দমন করে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ২৯ জন শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক। আজ এক বিবৃতিতে বিশিষ্টজনরা এই আহ্বান জানান।

বিবৃতিদাতারা বলেন, “গত জুলাই থেকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনের নামে পুলিশের গুলিতে এবং অন্যান্যদের হামলায় পাঁচ শতাধিক মানুষের প্রাণ হারিয়েছেন যাদের বেশিরভাগই নিরস্ত্র শিক্ষার্থী, শিশু, নারী ও সাধারণ নাগরিক, কিছু পুলিশ বাহিনীর সদস্য এবং সংবাদকর্মী যারা তাদের পেশাগত দায়িত্বপালনের সময় নিহত হয়েছেন। নিহত ও আহত হওয়ার কোনো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী যিনি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার কার্যকাল শুরু করলেও গত দশ-এগারো বছর ধরে যেভাবে দেশ শাসন করেছেন তা তাকে ক্রমাগত এক স্বৈরশাসকে পরিণত করেছে এবং সব শেষে গত মধ্য জুলাই থেকে তিনি নিজেকে এক নিষ্ঠুর স্বৈর-শাসকের তালিকায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এর ফলেই বিগত দিনগুলিতে আমাদের অভাবনীয় শত শত মৃত্যুর মিছিল প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে।

আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হলে তিনি গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ লাখে লাখে রাজপথে তাদের উল্লাস প্রকাশ করেছেন। এত ব্যাপক হতাহতের দায় নিয়ে তার পদত্যাগের দাবি পূরণ হওয়ায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থী-জনতা একটি ঐতিহাসিক বিজয় হিসেবে দেখছেন। জাতির এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে সংগ্রামী ছাত্র-জনতাকে তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “নিঃসন্দেহে এটি আমাদের সামনে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু একশ্রেণির সুযোগ সন্ধানী মানুষ ও দুস্কৃতিকারী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই পরিস্থিতির শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে লুটপাট চালাচ্ছে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রিস্টান, আহমদিয়া সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের বাড়িঘরে হামলা করছে, অগ্নিসংযোগ ও শারীরিক নির্যাতনে লিপ্ত হয়েছে। একই সাথে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা লক্ষ করছি যে, দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় তারা বিভিন্ন থানা আক্রমণ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও দলিলপত্র লুটপাট ও বিনষ্ট করেছে।”

পুলিশের অনেক সদস্য বিগত দিনে নানা অন্যায়-অনাচার করেছেন, বিশেষত আন্দোলনের সময় তাদের অনেককে হত্যাকারী ও নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে উল্লেখ করে বিবৃতিদাতারা আরো বলেন, “এইসব হামলার সাথে হয়ত সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষের ক্ষোভ যুক্ত থাকতে পারে। তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়, সদ্য ক্ষমতাহারা হেলমেট বাহিনীর লোকজন এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক দুস্কৃতিকারী মহল যারা এদেশকে পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলাবিহীন জনপদে পরিণত করতে চায় এই আক্রমণ, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলোতে তাদের ইন্ধন রয়েছে বলে আমাদের আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ আছে।

বিবৃতিদাতারা ক্ষোভ ও উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, যে গত কয়েকদিনে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নড়াইল, মুন্সিগঞ্জ, নোয়াখালী, মেহেরপুর, ঢাকাসহ দেশের কমপক্ষে ৩৫টি জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা নন পঞ্চগড় ও রংপুর জেলায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা সংবাদপত্রের খবরে জানতে পেরেছি। একইসাথে রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ, চাপাইনবাবগঞ্জ ও পটুয়াখালীতে আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং জামালপুরে তৃতীয় লিঙ্গের (হিজরা) নাগরিকরাও আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে মানবেতর অবস্থায় দিনানিপাত করছেন। এই সকল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সকল জেলা ও অঞ্চলে যেকোনো সময় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন। এই অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কবৃন্দ, সেনাবাহিনীর প্রধান এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে তাদের বক্তব্যে এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধের কথা বলেছেন তারপরও আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, বাস্তবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হচ্ছে না। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিও তেমন দৃশ্যমান নয়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশে আইন-শৃঙ্খলা অমান্য করা, লুটপাটকে অবারিত করা এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় দাবি করে বিবৃতিদাতারা আরো বলেন, “এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে আমাদের কিছু জাতীয় স্থাপনা আক্রান্ত হয়েছে বিশেষত প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন যেটা এখন যাদুঘর সেটিও আক্রান্ত হয়েছে। এই হামলার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। কারণ মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় এবং মুক্তিযুদ্ধ যার নেতৃত্বে হয়েছিল তাকে অসম্মান করার অর্থ হলো মুক্তিযুদ্ধ ও ছাত্র-জনতার এই মহান বিজয়কে কলঙ্কিত করা, সেটি আমাদের প্রতিহত করতে হবে, সম্মিলিতভাবে এ ধরনের যে কোনো কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতে হবে।”

স্বাধীন সার্বভৌম এই রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রিস্টান, আহমদিয়া ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের ওপর হামলা, তাদের নিরাপত্তাহীনতা ও জনমনে ভয়-ভীতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া চলবে না দাবি করে বিবৃতিদাতারা  এই পরিস্থিতিতে আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিবৃন্দসহ, বৃহত্তর নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সকল বন্ধুদের আরো দৃঢ়ভাবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান এবং তাদের ওপর আক্রমণ প্রতিহত করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

বিবৃতিদাতারা মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান ও সেনাসদস্যদের কাছে নিম্নোক্ত আহ্বান জানান-

১. যে কোনো ধরনের অরাজকতা, সহিংসতা, হামলা, লুটতরাজের ঘটনা প্রতিরোধের জন্য কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ দেশব্যাপী সকল জেলা ও উপজেলায় সেনা মোতায়েন ও তাদের সদা সক্রিয় রাখা নিশ্চিত করতে হবে। জেলা প্রশাসন এবং মাঠ পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নিয়মিত আপডেট নেয়া জরুরি।
২. সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রিস্টান, আহমদিয়া ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের বাড়িঘর, দোকানপাটসহ সকল স্থাপনা, মন্দির, গীর্জাসহ সকল উপাসনালয়ের সুরক্ষা দিতে হবে। তার জন্য বিশেষ নির্দেশনা গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করতে হবে।
৩. মুক্তিযুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অসম্মান করার সকল অপতৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এর উস্কানী/ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষার্থী আন্দোলন নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্যদের প্রতি আহ্বান-
৪. শিক্ষার্থী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে তাদের বক্তব্যে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা প্রতিরোধ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জনসম্পদ সুরক্ষার বিষয়টি প্রতিনিয়ত বলতে হবে। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের এই বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি কার্যকর সুরক্ষায় তাদের স্বেচ্ছাসেবা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. এ সকল ব্যাপারে গণমাধ্যমের সোচ্চার ভূমিকা আরো জোরদার করতে হবে।
৬. সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষক ও অভিভাবক সমাজ, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনকে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা প্রতিরোধ, গণলুটপাট, থানা আক্রমণ এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবার যেকোনো প্রচেষ্টাকে ঐকবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন- সুলতানা কামাল, ড. হামিদা হোসেন, খুশী কবির, রাশেদা কে. চৌধুরী, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এড. জেড আই খান পান্না, সেলিম সামাদ,  ড. শাহনাজ হুদা, শিরীন হক, কাজল দেবনাথ,  এডভোকেট তবারক হোসেন,  এড. সুব্রত চৌধুরী, ড. সুমাইয়া খায়ের,  ড. ফস্টিনা পেরেইরা, শামসুল হুদা, মনীন্দ্র কুমার নাথ,  ব্যারিস্টার সারা হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, মাকসুদুল হক, তাসনীম সিরাজ মাহবুব, অধ্যাপক বীনা ডি কস্তা, সালেহ আহমেদ, সাইদুর রহমান,
ফারহা তানজিম তিতিল,  ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা, নাসের বখতিয়ার,হানা শামস আহমেদ, দীপায়ন খীসা, সদস্য, মুক্তাশ্রী চাকমা।

Back to top button