ষড়যন্ত্রের কারাজীবনঃ চিংলামং চাক
বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার হীন উদ্দেশ্যে জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা ও সাজানো মামলা দায়ের করার ষড়যন্ত্র জোরদার করেছে। কোন ঘটনা ঘটলেই সেই ঘটনার সাথে জড়িত করে গণহারে জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদেরকে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে পরিচিহ্নিত করে ঢালাওভাবে অপপ্রচার চালাতে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা, সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন জনকে চাপ দিয়ে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করতে বাধ্য করা হয়। তিন পার্বত্য জেলায় উন্নয়নের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, টে-ারবাজি, পার্বত্য জেলা পরিষদের তৃতীয় ও চতুর্থশ্রেণি পদে নিজরবিহীন নিয়োগ-বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্বৃত্তায়ন, সর্বোপরি আওমালীলীগ সরকারের ৯ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় জনমানুষের চরম অসন্তোষকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হীনউদ্দেশ্যে স্থানীয় সেনা-পুলিশের যোগসাজশে আওয়ামীলীগ সম্প্রতি সংঘটিত ঘটনায় জনসংহতি সমিতিকে জড়িত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
গত নভেম্বর ২০১৭ থেকে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ এবং সেনা-পুলিশের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করা হচ্ছে। অন্যদিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ গভীর রাতে তিন উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে তল্লাসী অভিযান পরিচালনার নামে নিরীহ গ্রামবাসীদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ঘরবাড়ি তল্লাসী, মারধর ও গ্রেফতার করে চলেছে। তিন উপজেলায় ১৪৬ জন (নাম উল্লেখ করে) এবং ১০৫-১২৩ জন অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে ৬টি ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে। ৭ ডিসেম্বর থেকে এযাবৎ বিলাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের একজন মেম্বরসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ এবং ৪২ জনকে মারপিট ও হয়রানি করা হয়। কমপক্ষে ১০৯টি ঘরাবাড়ি তল্লাসী ও এসব ঘরবাড়ির জিনিসপত্র তছনছ করা হয়েছে। এতে করে এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বান্দরবান পার্বত্য জেলায় অনেক আগে থেকে সেনা-পুলিশের যোগসাজশে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সহযোগী সংগঠনের সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদেরকে হয়রানি করা, দুর্বল করা এবং এলাকাছাড়া করার ষড়যন্ত্রে মেঠে উঠে। গত ২০১৬ সালে জনসংহতি সমিতির সদস্যসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের, নিরীহ গ্রামবাসী ও জনসংহতি সমিতির সদস্য-সমর্থক ৩০ জনকে গ্রেফতার, ৫৯ জনকে সাময়িক আটক ও হয়রানি, ৮৯ জনকে মারধর এবং জনসংহতি সমিতির প্রায় দেড় শতাধিক সদস্যকে এলাকাছাড়া করা হয়।
যেমন গত ১৪ জুন ২০১৬ বান্দরবানে মংপু মারমা অপহরণকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বান্দরবানে অবস্থানরত সিনিয়র নেতা সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন, কে এস মং, জলি মং, ক্যবা মং, উছো মং, শম্ভু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা সহ ৩৮ জন ও অজ্ঞাতনামা ১৫/২০ জনের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে মামলা দায়ের করে এবং শুধু মংপু মারমা অপহরণ মামলা করে ক্ষান্ত না হয়ে পরপর আরো ৩টি মিথ্যা ও সাজানো মামলা দায়ের করে। মোট মামলা সংখ্যা ৪টি দাঁড়ায়। এতে আমাকে দুটি মামলায় আসামীভুক্ত করে। ৪টি মামলায় প্রায় শতাধিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। সকলে ফেরারী জীবন যাপনের এক পর্যায়ে আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে জামিনে মুক্ত থেকে আইনকে সম্মান করে আদালতে হাজিরা দিতে থাকি।
উল্লেখ্য যে, ৪টি মামলার মধ্যে একটি মামলা খারিজ হয়ে যায়। আমরা সকলে আদালতে হাজিরা দিয়ে মামলা চলাকালীন খারিজ হয়ে যাওয়া মামলার আসামী সকলকে পুন:রায় আসামীভুক্ত করে আরেকটি সাজানো মামলা দায়ের করা হয়। গত ১৫ নভেম্বর ২০১৭ বান্দরবান জেলার রাজবিলায় সংঘটিত এক তুচ্ছ ঘটনা পরিকল্পিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, যুব সমিতি এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্র ও শাখাসমূহের সদস্যদের ষড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যাভাবে জড়িত করে মো: আবদুল আলীম নামক ভাড়ায় চালিত জনৈক মোটর সাইকেল চালক কর্তৃক ২৪ জনের বিরুদ্ধে বান্দরবান সদর থানায় চাঁদাবাজি ও হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগ এনে এক মামলা দায়ের করা হয়। উক্ত মামলায় আমি জলি মং, ক্যবা মং ও শম্ভু কুমার তঞ্চঙ্গ্যাসহ ২৪ জন ও অজ্ঞাতনামা ১০/১৫ জনকে আসামী করা হয়। তার মধ্যে জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সহযোগী সংগঠনের কর্মী ছিলাম ১৮ জন। প্রসঙ্গক্রমে উক্ত ঘটনায় রাজবিলা পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ ও মামলার বাদী উভয়ে সুনির্দিষ্টভাবে প্রথম থেকে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বলে দাবী করেছেন। কিন্তু কিভাবে ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলো তাঁদের সাথে এলাকাবাসী এবং প্রত্যক্ষদর্শীরাও হতবাক হয়েছেন। এমনকি মো: আবদুল করিম মামলাটি করেননি বলে ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এফিডেফিটও করেছেন।
আইনকে শ্রদ্ধা করে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে গত ২০ নভেম্বর ২০১৭ তারিখ আত্মসমর্পণ পূর্বক জামিনের আবেদন করা হলে তিনজন যথাক্রমে রোয়াংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান ক্যবা মং মারমা, নোয়াপতং ইউপি চেয়ারম্যান অংথোয়াইচিং মারমা ও নোয়াপতং ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শম্ভু কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে জামিনে আমলে নিয়ে বাদবাকী ১৫ জনকে জেলে প্রেরণ করে। আমাদের ১৫ জনকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে লাইন করে কোমরে রশি বেঁধে কোর্টের লকআপে নিয়ে যাওয়া হলো। তখন দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিট। আদালতের লকআপে প্রায় চার ঘন্টার অধিক থাকতে হয়েছিল। আমাদের পার্টির সিনিয়র কর্মীরা আমাদের ১৫ জনের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলেন এবং আমাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করতে আসলেন। অপরদিকে আমাদের কর্মীরা উচ্চ আদালতে আপিলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ৪ টা ৩০ মিনিটে আদালত সেলে দু’জন পুলিশ ঢুকে সবাইকে চেক করলেন এবং সকলের প্যান্টের বেল, ম্যানিব্যাগসহ সবকিছু বাইরে থাকা কর্মীদের হাতে দিয়ে দেয়া হলো। এর পরপরই আবার জোড়া জোড়া করে হ্যান্ডকাপ পড়ানো হলো এবং পূর্বের ন্যায় সবাইকে লাইন করে রশি বেঁধে আদালতের সেল থেকে বের করে আদালতের প্রাঙ্গণে থাকা জেলখানার গাড়ীতে উঠানো হলো। আদালত থেকে জেলখানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়া হলো।
আমাদের গাড়ী বহরের সামনে পিছনে দুটি পুলিশের স্কট গাড়ী ও ডিবি পুলিশের মোটর বাইকের বহর একইভাবে সামনে পিছনে ২০টির অধিক নিরাপত্তার বেষ্টনিতে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। কিছু কর্মী বলাবলি করছিল- ‘আমাদেরকে ভিআইপি মর্যাদায় পুলিশের নিরাপত্তা দিয়ে জেলাখানায় নিয়ে যাচ্ছে’। আদালত থেকে জেলখানা বেশি দূর নয়, তাই দশ মিনিট পর জেলখানার গেইটে পৌঁছানোর পর জেল গেইটে ঢুকানো হলো এবং জেল গেইটম্যান পূর্বেকার মতো সিআইডি’র মাধ্যমে পরপর সকলকে পুন:চেক করে নিলেন। পরবর্তীতে জেলখানার ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। তখন প্রায় সন্ধ্যা ৪:৩০ ঘটিকার মতো হবে। জেলখানা রুমে ঢুকানোর আগে দায়িত্বরত হাবিলদার ফাইল ফাইল বলে আবার গুণে নিলেন। ফাইল অর্থ ৪ জন করে লাইন বসানো হয় এবং গণনা করা হয়। গণনা ঠিকঠাক হওয়ার পর আবার কিছুদূর নিয়ে গিয়ে মূল জেলখানা প্রাঙ্গণে ফাইল করে দ্বিতলা বিশিষ্ট চিম্বুক ও মেঘলা ভবনের চারটি রুমে ৪/৫ জন করে ঢুকানো হলো। তখন দেখি যে, জেলখানার শত শত আসামী উৎসুক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এবং যারা পরিচিত লোক তারা যে যাকে চিনে কুশল বিনিময় করতে আসলেন। তখন দেখলাম আমরা যে ১৫ জন সকলের মধ্যে জেলাখানার অনেকের সঙ্গে পূর্বেকার পরিচিত লোক। কারণ আমরা একদিকে সংগঠক অপরদিকে সকলে বান্দরবানের লোক। তাই সকলের সাথে পরিচিত হতে তেমন সময়ের প্রয়োজন পড়েনি এবং জেলজীবন খাপ খাইয়ে নিতে তেমন সময় লাগেনি। ঠিক ৫ টায় আসামী সবাইকে যার যার রুমে ঢুকার জন্য ঘন্টা ধ্বনি পড়লো। সাথে সাথে সকলে স্ব স্ব রুমে ঢুকে পড়লাম এবং ফাইল করে গণনার পর হাবিলদার বাইরে থেকে রুমে তালা দিয়ে চলে যান। অত:পর শুরু হলো জেলজীবন।
আমার সাথে সহকর্মী অজিত তঞ্চঙ্গ্যা, বিঞ্চু চাকমা ও পাসেস বমকে চিম্বুক ভবন একতলা রুমে রাখা হয়। পাসেস বম মাস খানেক আগেও জেলখানায় এসেছিল। সেই সুবাদে রুমের মেডসহ অধিকাংশ জেলবন্দীদের সাথে পরিচয় ছিল। তাই চার জনের থাকার বন্দোবস্ত করতে তেমন সময়ের প্রয়োজন হয়নি। আমাদের রুমে ৭০ জনের অধিক জেলবন্দী ছিলাম। একজনের থাকার জন্য মাত্র ১৮ ইঞ্চির মতো পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ। রাত্রে আমরা চার জনে ভাত খাইনি। কারণ আদালত সেলে থাকার সময় প্রায় তিনটার দিকে দুপুরের ভাত খেয়েছি। তাই ক্ষিদে নেই বললে চলে। আমরা যে রাতে ভাত খাইনি সংবাদটা কিভাবে যেন জেল কর্তৃপক্ষের নিকট চলে যায় এবং হাবিলদার এসে জানতে চাইলেন-আমরা কেন ভাত খাইনি। আমরা উত্তরে বললাম ‘আমাদের ক্ষিদে নেই তাই খাচ্ছি না’। অত:পর হাবিলদার চলে গেলেন। ২০ নভেম্বর হতে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত জেলে থাকার কিছু অভিজ্ঞতা নি¤œরূপ-
১. প্রতিটি রুমে জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব প্রাপ্ত একজন মেড, একজন রাইটার। এই দু’জনের কাজ হচ্ছে স্ব স্ব রুমে শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও জেলবন্দীদের ভাল-মন্দ দেখাশুনাসহ জেল কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করা। মেডের দায়িত্ব হচ্ছে সকলের থাকা খাওয়া ও রুমের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা এবং রাইটারের কাজ হচ্ছে প্রতিদিন গণনার সময় ও রাত্রে কে কে পাহারার দায়িত্ব বন্টন করা। মেড ও রাইটার উভয়ের সমন্বয়ে রুমের তত্ত্বাবধান করে থাকেন।
২. জেলখানার দৈনিকসূচি: দৈনিক তিন বার ফাইল করে গণনা করা হয়। সকাল ৫ টায় সকলকে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে গণনার জন্য চারজন করে লাইন সাজিয়ে ফাইল করতে হয়। দুপুর ভাত খাওয়ার আগে এবং বিকাল ৫ টায় রুমে তালাবদ্ধ করার আগে ফাইল করে থাকে। সবরুমে ফাইল করার পর যদি গণনা টিক হয় তাহলে একটা ঘন্টাধ্বনি দেয়া হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত ঘন্টাধ্বনি পড়বে না ততক্ষণ সকাল ও দুপুর ক্ষেত্রে কেউ রুম থেকে বের হওয়া যাবে না। বিকাল ৫ টার ফাইল তো বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। সুতরাং সারারাত আর বের হওয়ার সুযোগ নেই।
৩. সকাল ৭ টায় জনপ্রতি একটি করে আটারুটি ও গুড়, দুপুর ১২ টার আগে ভাত ও বিকাল ৫ টার পূর্বে রাতের খাবার ভাগ করে দেয়া হয়। সকালে জেলবন্দীদের যাকে যে কাজে দায়িত্ব দেয়া হবে সেই কাজ করতে হয়। যেমন ঃ রুম পরিস্কার, উঠোন পরিস্কার, রান্না-বান্না, লাকড়ী চিড়ানো ইত্যাদি। দৈনিক একবার গোসলের ব্যবস্থা। সকাল ১০ টায় সকলকে একসাথে গোসল সেরে নিতে হয়। যাদের কোর্টে হাজিরা দিতে যেতে হবে তাদের জন্য সকালে গোসল ও ভাতের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। সপ্তাহে তিন/চার বার মাছ, এক বার মাংসের ব্যবস্থা ও ডিম খাবার দেয়া হয়। অন্যদিনগুলো সবজি। প্রতিটি বেলায় ভাত পরিমাণ মতো বরাদ্দ থাকে। মাছের টুকরো দিয়ে মোটামোটি খাওয়া যায়। কিন্তু মাংসের দিনে খাওয়ার কষ্টকর। কারণ মাংসের টুকরোর পরিমাণ হচ্ছে একটি আংকুরের মতো।
৪. রাত ১০ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া ও পালাক্রমে রাত্রে পাহারা দিতে হয়। পাহারা দেয়ার কারণ হচ্ছে রুমের ভিতরে যেন কেউ কাউকে কোন ধরনের ক্ষতিকারক কাজ করতে না পারে এবং পালিয়ে যেতে না পারে। অপরদিকে রুমের বাইরে কারা পুলিশরাও পালাক্রমে পাহারায় রত থাকে। যেদিন জেলে ঢুকবে তার পরের দিন জেল কর্তৃপক্ষ ছবিসহ আইডি কার্ড করে নেয়। যেখানে নাম, ঠিকানা, উচ্চতা ও শরীরের চিহ্নিত দাগ উল্লেখ থাকে। জেলমুক্ত হওয়ার পর উক্ত কার্ড অনুসারে যাচাই-বাছাই করে জেলমুক্ত করা হয়।
৫. দৈনিক সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজনদের দেখা সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করে থাকে। সকাল ও বিকালে দু বার দেখা বাজার বসে। যারা আসামীকে দেখতে আসে তারা যদি কোন খাবার জিনিস বা কাপড়-চোপড় দিয়ে যায় তাহলে ডেকে ডেকে যার যার জিনিস দিয়ে দেওয়া হয়। তা হচ্ছে দেখা বাজার। অপরদিকে জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মনোনীত এক দোকানদার সকাল ৬:০০টা হতে দুপুর ১২:০০টা এবং বিকাল ৩:০০টা হতে ৪:৩০ মি. পর্যন্ত চায়ের দোকান করে থাকে। আসামীদের স্ব স্ব নামে পিসি কার্ড হয়ে থাকলে সেই পিসি কার্ড দিয়ে বাজার করা যাবে। আসামীদের হাতে নগদ টাকা রাখা নিষেধ। তাই টাকা জমা হলে পিসি কার্ড যুক্ত হয়ে যায়। পিসি কার্ড এক প্রকার ব্যাংকের চেকও বলা যায়।
৬. সকাল ৫ টা হতে সন্ধ্যা ৫ টা পর্যন্ত জেলখানার রুমে বা প্রাঙ্গণে ঘুরাফেরা করে বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা অথবা কেরাম খেলা করে সময় কাটানো যাবে এবং সন্ধ্যা ৫ টা হতে ভোর ৫ টা পর্যন্ত রুমের ভিতরে তালাবদ্ধবস্থায় থাকতে হয়। অর্থাৎ ১২ ঘন্টা রুমের ভিতর এবং ১২ ঘন্টা রুমের বাইরে থাকা যায়। প্রত্যেক রুমে টিভি ও ১টি পত্রিকা রয়েছে। লাইব্রেরী থেকেও বই সংগ্রহ করে বই পড়া যায়।
৮. জেলখানার ফাইল দুই ধরনের- (১) গণনার ফাইল, (২) ঘুমানোর ফাইল। ঘুমানোর ফাইল আবার তিন ধরনের। যেমন- সাধারণ ফাইল হচ্ছে পা সোজা করে ঘুমানো যাবে। ইলিশ ফাইল হচ্ছে সোজা করে ঘুমানো যাবে না, অর্থাৎ “দ” আকারে ঘুমাতে হবে, সোজা করে নয় এবং কেচি ফাইল হচ্ছে- এক জনের পায়ে অপর জনের পা মিশিয়ে ঘুমাতে হবে। কোন ধরনের নড়াচড়া করার সুযোগ নেই। রুমে যখন শতাধিক আসামী হবে তখন ইলিশ ফাইল ও কেচি ফাইল করা হয় বাধ্য হয়ে।
জেলখানায় দুটি ভবনে প্রায় তিন শতাধিক আসামী ছিলাম। তার মধ্যে ৭০/৮০ জন পাহাড়ি হবে। জেলখানার পুলিশ ও আসামীরা সকলে জানেন যে, আমরা রাজনৈতিক মামলার কারণে হাজতে রয়েছি। সেই কারণে আমাদের কাউকে কোন কাজে দায়িত্ব দেয়া হয় নাই এবং সকলে সম্মান করেন। অনেকে আমাদের কাছে নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। এক প্রকার বলা যায় ১৫ জনই জেলখানা দখলে রেখেছি। যেহেতু আমরা রাজনৈতিক সংগঠক কর্মী সেই কারণে আমাদের কাজই হচ্ছে যেখানে যায় সেখানে রাজনৈতিক কাজ করতে হয়।
জেলখানায় অন্তরীণ থাকার সময়ে অনেকজনের সাথে আলাপের মধ্য দিয়ে জানা গেল কে কি কারণে জেল খাটছে। অধিকাংশ আসামী সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক শত্রুতার প্রতিহিংসার কারণে জেল খাটছেন। আর কম সংখ্যক আসামী সত্যিকার অপরাধের কারণে জেল খাটছেন। যেসব আসামী প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের কারণে জেল খাটছেন তাদের কাছে অনেক ক্ষোভ প্রকাশ পায়। অপরদিকে যারা সত্যিকারের অপরাধ করে জেল খাটছেন এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামী তারাই বেশির ভাগ রুমের ভিতরে ধর্ম-কর্ম, প্রার্থনা করে থাকেন। জেলখানায় যতদিন ছিলাম ততোদিন যাকে যেভাবে পাই সেভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে, সমাজের মধ্যে মানুষে মানুষে যতদিন নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ, বৈষম্য ও সকল প্রকার ভেদাভেদ থাকবে ততোদিন দেশে ও সমাজে শান্তি ফিরে আসবে না এবং দেশ পরিচালনার সরকার যতদিন গণতান্ত্রিক ও সুশাসন ব্যবস্থা হবে না ততোদিন সরকার যে দলই গঠন করুক না কেন দেশে শান্তি ফিরে আসবে না।
২০ নভেম্বর ২০১৭ হতে ২৬ নভেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত সাত দিনের জেলজীবন কাটিয়েছিলাম। ২৬ নভেম্বর বান্দরবান জেলা জজকোর্টে আমাদের জন্য জামিন চাওয়া হলো এবং জজ সাহেব আমাদেরকে জামিনে মুক্তি দিলেন। সেদিন জামিন নামার ফরম বিকাল ৫ টার দিকে জেল কর্তৃপক্ষের নিকট দেরিতে পৌঁছানোর কারণে আর বের হওয়া সম্ভব হয়নি। পরের দিন ২৭ নভেম্বর সকাল ১০ টায় জেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে ছেড়ে দেন। টানা সাত দিনের পর মুক্তমনে খোলা আকাশ, শহর ও লোকজনের সাথে দেখা করার সুযোগ পাই। জেল গেইট থেকে আমাদের সকলকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানালেন এবং ক্ষুদ্র পরিসরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানও হলো। উল্লেখ্য যে, ২৬ নভেম্বর জেলখানা থেকে জজ কোর্টে নেয়ার সময় এবং কোর্ট থেকে জেলখানায় নিয়ে আসার সময় পূর্বের ন্যায় পুলিশের কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যবস্থা করা ছিল।
পরিশেষে আমার কারাজীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন হচ্ছে, যেদিন জেলখানার প্রথম রাত্রের দিন। সেদিন রাত্র ৯ টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ করে রাত্র ১২ টার দিকে ঘুম থেকে চেতন হয়। তখন থেকে আর ঘুম হয়না। ঘুম যাওয়ার অনেক চেষ্ট করেছি কিন্তু কোন মোটেই আর ঘুম আসলো না। কারণ শুধু ভাবতে থাকি যতদিন জেলমুক্ত হবে না ততদিন অন্যরুমে থাকা কর্মীভাইদের সাথে দেখা হবে না এবং খোলা আকাশও দেখার সুযোগ হবে না। মাঝে মাঝে জানালার ফাঁকে খোলা আকাশ দেখার চেষ্টা করি। আমার অবস্থা রুমের মেড খেয়াল করে বললেন, আংকেল কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা? কোন সমস্যা হলে তাকে যেন বলি। তখন আমি শুধু বললাম, না কোন সমস্যা হচ্ছে না। পরের দিন সকালে ফাইল করার পর যখন রুম হতে বাইরে যাবার সুযোগ হলো, তখনই আমার সারা রাত্রের ভুলের কান্ড কারণে নিজে নিজে যে শাস্তি পেয়েছি তা ভাবতে লাগলাম। সেদিন থেকে আর খাওয়া ও ঘুমানো কোন ধরনের আর সমস্যা হয়নি।
জেল থেকে মুক্ত পাবার পর বাড়িতে গেলাম। আমার মা ও পরিবারের লোকেরা আমার অপেক্ষায়রত ছিলেন। আমি হাসতে হাসতে সাতদিনের জেলের থাকা খাওয়ার কোন ধরনের যে সমস্যা হয়নি তা মাকে শুনালাম। তখন মা শুধু বললেন, তুমি কষ্ট পেয়েও কষ্টের কথা বলছো না, তোমার মাকে কষ্টের কথা বলে কষ্ট দিতে চাচ্ছো না তাই না? তখন আমি বললাম, সত্যিই মা জেলে কষ্ট পায়নি। কারণ সমাজ ও জাতির জন্য কাজ করলে কতজনের কত ধরনের জেলজুলুম হয় তার কোন ইয়ত্তা নেই।
চিংলামং চাক, কৃষি ও ভূমি বিষয়ক সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।