মতামত ও বিশ্লেষণ

শাসক মহলের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ভূমিকা প্রসঙ্গেঃ সজীব চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইতিমধ্যে ১৯টি বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, খোদ ক্ষমতাসীন মহলের মধ্যে এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশাসনের অভ্যন্তরে অনেককে চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। একদিকে দীর্ঘ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই পার্বত্য অঞ্চলে সেনা কর্তৃত্ব বিরাজ করছে, চলছে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ, ভূমি বেদখল ও স্বভূমি থেকে জুম্মদের উচ্ছেদসহ ক্ষমতাসীন দলের সীমাহীন দুর্নীতি, দলীয়করণ ও গণবিরোধী অপতৎপরতা এবং জুম্ম জনগণের উপর অব্যাহত শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র। ফলে পার্বত্য অঞ্চলের সামগ্রিক অবস্থা জটিল আকার ধারণ করেছে। জুম্ম জনগণ নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের কথা ও কাজে অসঙ্গতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে অদ্যাবধি সরকারের নীতিনির্ধারকরা ‘চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক, এই সরকারের আমলেই চুক্তির পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা হবে’ ইত্যাদি বক্তব্য বা অঙ্গীকার ব্যক্ত করে চলেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার পক্ষ থেকে ‘চুক্তির অধিকাংশ বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে’, ‘চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে’ বলে দাবি করা হচ্ছে। বলাবাহুল্য সরকারের এ দাবি মোটেও বাস্তবসম্মত ও সত্য নয়। যদিও গাণিতিক হিসাব দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের অবস্থাকে তুলে ধরা বাস্তবসম্মত নয়, তথাপি জনসংহতি সমিতি তার প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি বাস্তবায়িত হয়েছে। আর অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে ৩৪টি ধারা এবং আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে ১৩টি ধারা।
চুক্তির বিভিন্ন ধারা বাস্তবায়ন প্রশ্নে সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে যে অসঙ্গতি রয়েছে তার মাত্র দুটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো- চুক্তির ‘ক’ খন্ডের যে ৪টি ধারা রয়েছে সেগুলো ‘সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে’ বলে সরকার পক্ষ দাবি করেছেন। এই ৪টি ধারার মধ্যে ১নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পাহাড়ি (উপজাতি) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা ও তা সংরক্ষণের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই বিধান অনুযায়ী, পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের কোন আইনী বা প্রশাসনিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে নানা কায়দায় একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহতভাবে বহিরাগতদের অভিবাসন যেমনি ঘটছে, অপরদিকে পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য বা মর্যাদা ক্ষুণœ হতে বসেছে। অপরদিকে ২নং ধারায় “যথাশীঘ্র ইহার বিভিন্ন ধারায় বিবৃত ঐকমত্য ও পালনীয় দায়িত্ব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন, বিধানাবলী, রীতিসমূহ প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন আইন মোতাবেক করা হবে” মর্মে বিধান রয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী ১৯৯৮ সালে তিন পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯ সংশোধন করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য জাতীয় ও বিশেষ আইনগুলো এখনো অসংশোধিত অবস্থায় রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, বাংলাদেশ পুলিশ আইন, বন আইন, স্থানীয় সরকার পরিষদ (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা) আইন, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ডেপুটি কমিশনারের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংক্রান্ত বিধিবিধান ইত্যাদি সংশোধন করা হয়নি। সুতরাং এসব ধারাগুলো ‘সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে’ বলে দাবি করা কোনভাবে সঠিক হতে পারে না।
বস্তুত চুক্তি স্বাক্ষরের পর সুদীর্ঘ ১৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও, এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ ৮ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নে সরকারের কোন আন্তরিক উদ্যোগ দেখা যায় না। চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহের একটিও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, পার্বত্য সমস্যার অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমি সমস্যার একটি ভূমি বিরোধও নিষ্পত্তি হয়নি; একজন আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুও পুনর্বাসন করা হয়নি; দীর্ঘ ১৯ বছরেও আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি ও নির্বাচিত পরিষদ গঠন করা যায়নি; সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেয়া এবং এই লক্ষে সময়-সীমা নির্ধারণ করার বিধান থাকলেও এখনো তিন শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প ও ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসন প্রত্যাহার করা হয়নি; জেলা পরিষদে এখনও সকল বিষয় হস্তান্তর করা হয়নি, যেগুলো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অনেক বিষয় চুক্তি অনুযায়ী যথাযথভাবে হস্তান্তর ও কার্যকর করা হয়নি। বস্তুত চুক্তির অন্যান্য মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রাখা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়াদি জাতীয় পর্যায়ে সম্পাদনার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে। একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠনের বিধান করা হয়। বস্তুত জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখাশোনা করার কথা পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু দু:খজনক যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে হিসেবে পার্বত্যাঞ্চলের জনগণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভূমিকা পালন করার কথা, সে হিসেবে ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। বরঞ্চ প্রায় ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। কয়েকটি উদাহরণ দিলে তা স্পষ্ট হবে বলে প্রতীয়মান হয়।
পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে গত ২১ ডিসেম্বর ২০০০ পার্বত্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক চুক্তি ও চুক্তির আলোকে প্রণীত পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনকে লংঘন করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় জেলা প্রশাসকগণের পাশাপাশি তিন সার্কেল চীফগণও চাকরি সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র ইস্যু করতে পারবেন’ মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই নির্দেশনা প্রত্যাহারের জন্য বার বার দাবি জানানো সত্ত্বেও তা এখনো পর্যন্ত জারি রয়েছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে কেবল সার্কেল চীফরাই স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের বিধান রয়েছে।
২১ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ‘পার্বত্য সন্ত্রাসকে মুসলিম বাঙ্গালী বসতি স্থাপনকারীদের জঙ্গীবাদ হিসেবে চিহ্নিতকরণের অপচেষ্টা’ বিষয়ক এক গোপনীয় সার্কুলার জারি করে সেটেলার বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক তৎপরতাকে আড়াল করা ও মদদ দেয়ার চেষ্টা করা হয়। অপরদিকে ২৮ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে “‘উপজাতীয়’ সম্প্রদায়গুলোকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করার অপতৎপরতা প্রসঙ্গে” শীর্ষক সার্কুলার জারি করে জুম্ম বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। শেষোক্ত সার্কুলারে ‘বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান, বিদেশী সংবাদ মাধ্যম, জাতিসংঘের আড়ালে থাকা খ্রিস্টান রাষ্ট্রসমূহ এ সকল ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় তাদেরকে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়তায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে’ বলে বানোয়াট, কল্পনাপ্রসূত ও ভিত্তিহীন বক্তব্য তুলে ধরা হয়।
গত ৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘শান্তিচুক্তি পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অনুষ্ঠিত সভা’য় পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেছেন, “অধিকাংশ চুক্তি ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হলেও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) স্বীকার করেন না। উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের বিরোধিতার কারণে গত ২২ বছরেও তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি।…” ইত্যাদি। উক্ত সভায় ‘জেএসএস-এর কাছেও অবৈধ অস্ত্র রয়েছে’ বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। এভাবে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা চুক্তি বিরোধী এবং চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন মহলে বিদ্বেষমূলক ও নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে থাকেন যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইহার সপ্তদশ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘রেগেক্ষ্যয়ং’ নামে একটি প্রকাশনা বের করে। প্রকাশনাটি সম্পাদনা করেছেন স্বয়ং মন্ত্রণায়লয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। বেশ কিছু স্বনামধন্য লেখকের লেখা রয়েছে। কিন্তু এরকম একটি প্রকাশনায় বিস্ময়করভাবে (নাকি উদ্দেশ্য-প্রণোতিভাবে) গুইমারা রিজিয়ানের কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ তোফায়েল আহমেদ, পিএসসি লিখিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি এবং উন্নয়নের স্বপ্ন ও বাস্তবতা’ নিবন্ধটিও রয়েছে, যাতে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন, পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যা ও বাস্তবতা, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের ইতিহাস, আন্দোলন ও অধিকার সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তিকর, অসম্মানজনক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক মতামত ও বক্তব্য রয়েছে। যা জুম্ম জনগণের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে সৃষ্ট পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনায় এ জাতীয় বিভ্রান্তিকর ও জুম্ম বিরোধী লেখা প্রকাশযোগ্য হতে পারে না।
এভাবে অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায় যেখানে পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইতিবাচকভাবে ভূমিকা পালনের পরিবর্তে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ভূমিকায় থাকতে বেশি দেখা যায়। মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৯৫% জন কর্মকর্তা-কর্মচারী পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী নয়। বলাবাহুল্য, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক বিষয়ে সংবেদনশীল নয় ও নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা আজ অবধি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন যা বিধি-বহির্ভুত ও যুক্তিসঙ্গত নহে। এক ব্যক্তি দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে উন্নয়নের নামে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে তা বলাই বাহুল্য।
ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্বের চুক্তি বিরোধী ভূমিকা
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে ক্ষমতাসীন দলের পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদীরা। আর শুরু থেকে এদের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন দীপঙ্কর তালুকদার, বীর বাহাদুর উশৈচিং, কল্পরঞ্জন চাকমা ও তাদের সুবিধাভোগী পাহাড়ি-বাঙালি সাঙ্গপাঙ্গরা। শুরু থেকে তাদের তৎপরতা দেখা যায় চুক্তির স্বাক্ষরের ফলে সৃষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান, উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ইত্যাদি পদসমূহে তাদের আসীন হওয়ার দালালীপনা ও অপতৎপরতা, আর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদে নিজেদের আজ্ঞাবহ অনুসারীদের পুনর্বাসনের হীন ষড়যন্ত্র। অপরদিকে দিবারাত্রি জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও বিভ্রান্তিকর নানা বক্তব্য প্রদান করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করা।
প্রকৃতপক্ষে তারা মুখে চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললেও কাজেকর্মে কার্যকর কোন ভূমিকা দেখা যায় না। বরঞ্চ তাদের ভাবটা যেন চুক্তি বাস্তবায়িত হলে নিজেদেরই পিতৃপুরুষের সম্পত্তি খোয়া যাচ্ছে! তাই জনসংহতি সমিতি যখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে অভিযোগ করে, বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দেয় এবং চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানায়, তখনি তারা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের চেয়ে অতিউৎসাহী হয়ে ‘চুক্তির অধিকাংশ বিষয় বা চুক্তির ৯৮% ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে’, ‘সব হবে, ধীরে ধীরে হবে, হচ্ছে’, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে জনসংহতি সমিতি ও সন্তু লারমা মিথ্যাচার করছেন’, ‘অনেক দেশে এ ধরনের চুক্তি পুরাপরি বাস্তবায়িত হয়নি’ বলে চিৎকার জুড়ে দেয়। যেন জনসংহতি সমিতি তাদের কাছেই দাবি জানাচ্ছে! আর নিজেদের আসন ঠিক রাখার চিন্তায় ঘন ঘন ‘চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক’ বলে প্রলাপ করতে থাকেন। নিজেদের তোষামোদী ধ্যানে অন্ধ হয়ে তারা ভুলে যান যে, প্রধানমন্ত্রীর উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই জনসংহতি সমিতি ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
উল্লেখ্য যে, চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করার কাজ। বলাবাহুল্য, চুক্তির আগে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে প্রায় ৭২ হাজার জুম্ম ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার লক্ষাধিক জুম্ম পরিবার স্ব স্ব বাস্তুভিটা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে ও মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। চুক্তির অব্যবহিত পরে জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু পুনর্বাসন টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসেবে দীপঙ্কর তালুকদার এমপিকে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী তিনি আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তালিকা প্রস্তুত ও পুনর্বাসন করার কথা থাকলেও জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে ১৫ মে ২০০০ অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের অবৈধ একাদশ সভায় একতরফাভাবে ৩৮,১৫৬ সেটেলার বাঙালি পরিবারকেও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে ঘোষণা দেন। যা চুক্তির সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
বলাবাহুল্য, চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রগতির প্রশ্নে দীপঙ্কর তালুকদার ও বীর বাহাদুর বাবুরা এ পর্যন্ত চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন বা চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের জন্য তাদের তরফ থেকে কোন প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ নিতে, সরকারের নিকট দাবি জানাতে বা এনিয়ে কোন আন্দোলন-কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। অথচ পার্বত্যবাসীর স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হলেও তারা সরকারি যে কোন কার্যক্রম বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে উঠে। জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালালে বা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা দিলে তার বিপরীতেই তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যসহ তারা সদা তৎপর ও সরব থাকেন। বস্তুত তারা যে অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন তাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দ্রুত বা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন তাদের কাছে জরুরী বিষয় নয়। চুক্তি বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতন্ত্র বিকশিত হবে, পাহাড়ি-বাঙালি সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন হবে, চুক্তি অনুযায়ী বিশেষ শাসনব্যবস্থা জোরদার হবে, তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক সমস্যার সমাধান হবে, সাথে সাথে সাম্প্রদায়িক, সুবিধাবাদী ও ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের নোংরা রাজনীতির অবসান হবে -সেকারণেই তারা চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে উৎসাহী নয় বলে প্রতীয়মান হয়।
দীপঙ্কর তালুকদার ও বীর বাহাদুর বাবুরা চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে একেবারে নীরব। কিন্তু জনসংহতি সমিতি ‘চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি’ বলে অভিযোগ তুললেই তাতে তারা পাল্টা আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। সেকারণে তারা চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে একপ্রকার একপাশে সরিয়ে রেখে প্রায় প্রতিদিন ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী’ ইত্যাদি উদ্দেশ্য-প্রণোদিত আখ্যা দিয়ে জনসংহতি সমিতিকে কাবু করার চেষ্টা জোরদার করছে, জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের দমন-পীড়ন চালিয়ে ও মিথ্যা মামলায় জড়িত করে এলাকাছাড়া করার চেষ্টা করছে। আর এজন্য তারা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তা বাহিনী ও সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে, প্রকারান্তরে চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
আরও উল্লেখ্য যে, জামাত-বিএনপি ও মৌলবাদী গোষ্ঠী ১৯৯৭ পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের সময় যেভাবে বলেছিল ‘চুক্তি সম্পাদিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম (ফেনী পর্যন্ত) বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে’ সেই অপপ্রচারের সাথে তাল মিলিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের অনেকে প্রচারনা চালাচ্ছেন যে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র চলছে’ ইত্যাদি। যেমন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু গত বছরের মার্চে সংসদেই বলেছেন, ‘পার্বত্যাঞ্চলকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সন্তু লারমা।’ এসমস্ত কায়েমী স্বার্থবাদীরা যারা মনেপ্রাণে সাম্প্রদায়িক ও জাতিবিদ্বেষী তারা দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছেন কিন্তু এই অঞ্চলের আদিবাসী জুম্মদের অধিকারের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা-সহানুভুতি নেই। সে কারণে সরকারি দলে সংশ্লিষ্ট থেকেও এনারা কার্যত জুম্ম বিরোধী ও চুক্তি বিরোধী ভূমিকাতেই সদা তৎপর থাকেন। জুম্মদের আন্দোলন ও অধিকারের কথা, এমনকি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবির কথা উঠলেই তেনারা দেশ গেল, বাঙালি মুসরমানেরা অধিকার হারাল, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ইত্যাদি বলে চিৎকার করে উঠেন এবং তথাকথিত দেশ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে উঠেন।
পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের চুক্তি বাস্তবায়নে নির্লিপ্ত ভূমিকা
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ জুম্ম জনগণের আন্দোলনের অন্যতম ফসল এবং পার্বত চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারপরও এই পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা প্রায়ই চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে থাকেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে এবং চুক্তি অনুযায়ী এই পরিষদটি কার্যকরকরণে খোদ পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের মধ্যে কোন উদ্যোগ ও তৎপরতা দেখা যায় না। তাদেরকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে অহস্তান্তরিত বিষয়/বিভাগসমূহ হস্তান্তরে সরকারের সাথে দেনদরবার করতেও দেখা যায় না। বরঞ্চ পার্বত্য জেলা পরিষদের এখতিয়ার খর্ব করে কোন বিষয়/বিভাগ হস্তান্তর করা হলে তাতে তারা দেনদরবারের পরিবর্তে সুবোধ বালকের মতো হস্তান্তর সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর প্রদান করতে দেখা যায়।
পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন অনুযায়ী ‘আঞ্চলিক পরিষদ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড সমন্বয়সাধণ করাসহ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন ও ইহাদের উপর অর্পিত বিষয়াদি সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করিবে’ মর্মে বিধান থাকলেও এবং এ বিষয়ে ১০ এপ্রিল ২০০১ মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ হতে ‘আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর যথাযথ অনুসরণ এবং পার্বত্য জেলার উন্নয়ন কর্মকান্ডের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন’ এর পরিপত্র জারী করা হলেও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা অনুসরণ করছে না এবং নানাভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বিরোধী কাজে জড়িত থাকেন।
এমনকি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদমর্যাদা যে কেড়ে নেয়া হয়েছে তা উদ্ধারে তাদেরকে তৎপর হতে দেখা যায় না। ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক মনোনীত এসব অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদসমূহের জনগণের কাছে কোন দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নেই। এসব পরিষদগুলো এযাবৎ আর্থিক দুর্নীতি, দলীয়করণ ও দুর্বৃত্তায়নের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
সরকারের বেসামরিক আমলাদের কর্তৃক চুক্তিবিরোধী ভূমিকা
চুক্তির অব্যবহিত পরে তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান পরিলক্ষিত হলেও সাম্প্রতিককালে বেসামরিক প্রশাসনে চুক্তি বিরোধী ভূমিকা ও সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও জুম্মদের বিষয়ে যথাযথ ও বস্তুনিষ্ঠ ধারণা না থাকায় দেশের, বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত বেসামরিক আমলা তথা ডিসি, এসপি, ইউএনওসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং জুম্ম জনগণের সংস্কৃতি ও অধিকারের প্রতি যথাযথ আচরণ ও ভূমিকা পাওয়া যায় না। সামগ্রিকভাবে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং এই অঞ্চলের আদিবাসী জুম্মদের আন্দোলন ও তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় বলে প্রতীয়মান হয়।
মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ কর্তৃক ‘আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক পার্বত্য জেলার আইন-শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করা’র জন্য পরিপত্র জারী করা হলেও পার্বত্য জেলার ডিসি, এসপিরাসহ সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ তা অনুসরণ করেন না। ফলে চুক্তি ও আইন অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য জেলার আইন-শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করতে পারছে না। বস্তুত ডিসি, এসপিরাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিশেষ শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা তারা এখনও তোয়াক্কা করেন না। তারা আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদকে উপেক্ষা করেই সাধারণ প্রশাসন থেকে শুরু করে ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকেন।
চুক্তি অনুযায়ী সার্কেল চীফগণ কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের বিধানকে লংঘন করে ২০০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘ডেপুটি কমিশনাররাও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দিতে পারবেন বলে যে নির্দশনা দেয়া হয়েছিল তা তারা এখনও অনুসরণ করে চলেছেন। এমনকি তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারগণ পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নন এমন অউপজাতীয় ব্যক্তিদেরকেও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দিয়ে চলেছেন। এর বদৌলতে অস্থায়ী বহিরাগত ব্যক্তিরা অবৈধভাবে ভূমি বন্দোবস্তসহ চাকরি ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে যাচ্ছে এবং জুম্ম জনগণকে বঞ্চিতকরণসহ সংখ্যালঘুতে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ২০ জুলাই ও ১৮ আগস্ট ২০০৯ যথাক্রমে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বান্দরবান জেলায় অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ইজারার মধ্যে যে সমস্ত ভূমিতে চুক্তি মোতাবেক কোন রাবার বাগান ও উদ্যান চাষ করা হয়নি সেসমস্ত ইজারা বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উক্ত সিদ্ধান্তের আলোকে বান্দরবান জেলায় সর্বমোট ৫৯৩টি প্লট বাতিল করা হয় এবং লীজ বাতিলকৃত প্লট সরকারের দখলে আনা হয়। কিন্তু উদ্বেগজনকভাবে বান্দরবান পার্বত্য জেলা প্রশাসন দুর্নীতির মাধ্যমে লীজ বাতিলের দু’ মাসের মাথায় বাতিলকৃত প্লটগুলোর মধ্যে প্রায় অধিকাংশ প্লট পুনরায় বহাল করে থাকে।
গত ২৬-২৮ জুলাই ২০১১ তারিখে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে একতরফাভাবে (১) “ভূমি রেকর্ড সংশোধনে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহারের লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, ১৯৮৯ এর ৬৪(১)(ক) ধারা সংশোধন করে ‘পূর্বানুমোদনের’ স্থলে পরিষদের ‘অনাপত্তি’ গ্রহণের বিষয়টি সংযোজন করতে হবে’। (২) “পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের দায়িত্ব প্রদানের বিধান সম্বলিত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ এর ৬৫ ধারাটি বিলোপ/বাতিল করতে হবে”- মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বলাবাহুল্য, ডিসিদের কর্তৃক গৃহীত উক্ত উভয় সিদ্ধান্তই পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন এর সাথে সাংঘর্ষিক।
গত ১ নভেম্বর ২০১২ খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এর সহকারী কমিশনার (গোপনীয় শাখা) অঞ্জন কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক পত্রে ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা’ এর পরিবর্তে ‘খাগড়াছড়ি’ ব্যবহার/লেখার এক নির্দেশনা জারী করা হয়। উক্ত পত্রে ‘বিষয়: জেলার নাম শুদ্ধভাবে লিপিবদ্ধকরণ প্রসঙ্গে’ উল্লেখ করে বলা হয় যে, ‘উপর্যুক্ত বিষয়ের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, প্রজ্ঞাপন নং- এমইআর/জেএ১১/৭৬/৮৩-৩৪৮, তারিখ ১৩ অক্টোবর ১৯৮৩ খ্রি: মোতাবেক ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা’ এর পরিবর্তে সরকারি সবক্ষেত্রে ‘খাগড়াছড়ি’ ব্যবহার/লেখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ জনসংহতি সমিতি ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা প্রশাসন কর্তৃক এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক ‘পার্বত্য জেলা’ শব্দসমূহ বাদ দেয়ার প্রচেষ্টাকে এই অঞ্চলের বৈশিষ্টপূর্ণ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার উপর আঘাত হানার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে’ উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ জানায়। জনসংহতি সমিতির প্রতিবাদের মুখে পরে উক্ত নির্দেশনা প্রত্যাহার করা হয়।
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি জনসংহতি সমিতি ও এর সহযোগী সংগঠন কর্তৃক বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রেও ডিসি, এসপিদের পক্ষ থেকে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। এতে সভা-সমিতি ও মত প্রকাশ করার সাংবিধানিক অধিকারকে যেমনি খর্ব করা হচ্ছে, তেমনি চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
সামরিক আমলাদের কর্তৃক চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক ও জুম্মবিরোধী ভূমিকা
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি তিন বাহিনীর সম্মতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অবশ্যই সেনাবাহিনীর এই ভূমিকা ও অবস্থান পাহাড়ি-বাঙালি অধিকাংশ মহলে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে সেনাশাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক, আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়োজিত সেনা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে চলেছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে।
অনেক ক্ষেত্রে আশির দশকের শুরুর দিকে অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে যে ‘আমরা কেবল ভূমি চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ নয়’- এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা এখনও অব্যাহত রয়েছে বলে বিবেচনা করা যায়। ফলে নানা ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের দমন-পীড়ন-উচ্ছেদের যন্ত্র হিসেবেই ভূমিকা পালন করে চলেছে। ফলে শিক্ষা, চিকিৎসা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সময় তাদের যে ইতিবাচক ভূমিকা তাও এই দমনপীড়নমূলক ও একতরফা ভূমিকার কারণে ম্লান হয়ে যায়। যেহেতু এখনও ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে সেনাশাসন বলবৎ রয়েছে এবং চুক্তি অনুযায়ী অধিকাংশ সেনাক্যাম্প ও সেনাকর্তৃত্ব প্রত্যাহার করা হয়নি তাই এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক আমলাদের ভূমিকার তেমন কোন ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পরও স্থানীয় সেনাকর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ হতে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছরে সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক জুম্ম জনগণের উপর অন্তত ১৯টি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। যে হামলায় অন্তত ১১ জন নিরীহ জুম্ম নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫২৩ জন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫ জন নারী-শিশু, বাড়িঘর ভস্মীভুত হয়েছে ১৩৫০টি এবং লুটপাট হয়েছে অন্তত ১০৮২টি বাড়ি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাহ্যত সিভিল প্রশাসন বলবৎ থাকলেও অপারেশন উত্তরণের বদৌলতে কার্যত: সেনাবাহিনীই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাস্তাঘাটে চেকপোস্ট বসিয়ে সেনাবাহিনী পূর্বের মতো যাত্রীবাহী বাস-লঞ্চ থেকে শুরু করে সকল প্রকার যানবাহন তল্লাসীসহ গ্রামাঞ্চলে তল্লাসী অব্যাহত রেখেছে। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতেই সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের উপর একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ৬নং সিদ্ধান্তে “পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ২৪ পদাতিক ভিডিশনের সাথে পারস্পরিক সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ দায়িত্ব পালন করবে” এবং ১০নং সিদ্ধান্তে “পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবেশ পথে যেসব চেকপোস্ট রয়েছে সেগুলোকে আরও সক্রিয় করতে হবে”। যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বেসামরিকীকরণের অংশ হিসেবে সেনা, এবিপিএন, আনসার ও ভিডিপির সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান রয়েছে এবং তারই আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ চেকপোস্ট তুলে নেয়া হয়েছে, সেখানে আবার নতুন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবেশ পথে চেকপোস্ট সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া চুক্তি বাস্তবায়নের অনুকূলে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
উদ্বেগের বিষয় যে, সাম্প্রতিককালে সেনা-বিজিবি-পুলিশ কর্তৃক সন্ত্রাস দমনের নামে বা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে গ্রামে-শহরে ও বাড়িঘরে সামরিক অভিযান, তল্লাশী, ধরপাকড়, আটক, হয়রানি, মারধর, গ্রেপ্তার, মিথ্যামামলায় জড়িত করণ, হুমকী প্রদান, জুম্মদের একান্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হস্তক্ষেপ ইত্যাদি জোরদার করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশী টার্গেটের শিকার হচ্ছে চুক্তির পক্ষের জনসংহতি সমিতি, যুব সমিতি, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সদস্যরা এবং জনসংহতি সমিতি ও চুক্তি সমর্থক নিরীহ গ্রামবাসীরা। এধরনের সেনা-বিজিবি-পুলিশী অভিযানে গত ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জনসংহতি সমিতির সদস্যসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং নিরীহ গ্রামবাসী ও জনসংহতি সমিতির সদস্য-সমর্থক ৩০ জনকে গ্রেপ্তার, ৫৯ জনকে সাময়িক আটক ও হয়রানি, ৮৯ জনকে মারধর এবং জনসংহতি সমিতির প্রায় দেড় শতাধিক সদস্যকে এলাকাছাড়া করা হয়েছে। নজিরবিহীনভাবে জনসংহতি সমিতির বান্দরবান জেলা কার্যালয়সহ কয়েকটি উপজেলা কার্যালয়ে তল্লাশী চালানো হয়েছে এবং সমিতির দাপ্তরিক দলিলপত্রসহ কার্যালয়ে টাঙানো দলীয় নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের ছবি পর্যন্ত তছনছ করে দেয়া হয়েছে, যাতে অত্যন্ত বৈরী মানসিকতার পরিচয় মেলে।
এমনকি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে ও ব্যক্তিগত বিষয়েও সেনাবাহিনী অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে এবং অনধিকার চর্চা করছে। গত ২৯ মে ২০১৬ রাঙ্গামাটি জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলায় আয়না চাকমা (১৭) তার বাড়ি থেকে বিলাইছড়ি বাজারে এসে বিবাহিত দোকানদার শিহাব উদ্দিন নামক এক ব্যক্তির দোকানে প্রবেশ করার পর ঐ দোকানদারের সাথে আয়নার অসামাজিক সম্পর্কের জের ধরে বাজার এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হলে তা সামাজিক সালিশের মাধ্যমে সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু সমস্যাটি সামাজিকভাবে সমাধানের প্রক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ আয়না চাকমার মা-বাবার মত না থাকা সত্ত্বেও আয়না চাকমাকে দিয়ে বিলাইছড়ি থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে স্থানীয় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও যুব সমিতির কয়েকজন সদস্যকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করতে বাধ্য করে। শেষ পর্যন্ত স্বল্প বয়সী এই নারীকে চাপ দিয়ে মা-বাবার কাছ থেকেও দূরে সরিয়ে নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে গত ২০ নভেম্বর ২০১৬ রাঙ্গামাটি জেলাধীন লংগদু উপজেলা সদরস্থ তিনটিলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দুপুরের দিকে পার্শ্ববর্তী মেয়োনি (মাইনি) সেনা জোন থেকে একদল সেনাসদস্য উপস্থিত হয় স্কুলের শিক্ষকদের কক্ষে। এসেই তারা একটি তথ্য ছক বা অনেকটা নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের মত প্রশ্নপত্র শিক্ষকদের হাতে ধরিয়ে দেয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে সেগুলোর উত্তর দিতে বলে। এতক্ষণ ধরে যে শিক্ষকগণ স্কুলের ছাত্রদের পরীক্ষা নিয়েছেন, এখন তাদেরকেই আবার সেনাসদস্যদের কাছে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করানো হয়। এসময় সেনাসদস্যরা কম্পিউটারে কম্পোজ করা প্রশ্নপত্রে ‘আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস জানেন কি? -হ্যাঁ বা না, পার্বত্য চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তারের জন্য কোন নৃগোষ্ঠী আগে এসেছে?, ১৯৮২ সালে বাঙালিরা আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয়েছে কি না হয়নি?, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে এই চুক্তিটি যথাযথ কিনা? -হ্যাঁ বা না; প্রশ্নঃ আপনি নিজেকে কী মনে করেন- ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি না আদিবাসী?; প্রশ্নঃ বিবাহ প্রথা কেমন হওয়া উচিত? একই জাতির মধ্যে না ভিন্ন জাতির মধ্যে? ইত্যাদি প্রশ্ন করেন। সবশেষে অনেকটা থলে থেকে বেড়াল বেড়িয়ে আসার মত একমাত্র এবং সর্বশেষ (জঘন্যও বলা যেতে পারে) মৌখিক প্রশ্নটি আসে এভাবে- ‘চাকমা মেয়েরা বাঙালি বিয়ে করলে আপনাদের আপত্তি আছে কি না?’ এভাবে বর্তমানে এমন কোন বিষয় নেই যাতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করছে না। বিভিন্ন উপজেলায় জনসংহতি সমিতির কর্মীদের নাম-গ্রাম থেকে শুরু করে ওজন-উচ্চতাসহ ব্যক্তিগত সব বিষয়ে তথ্য প্রদানের জন্য নানাভাবে চাপ দিচ্ছে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা।
গত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬ জোন অধিনায়কের পক্ষে উপ পরিচালক (এমও) অরিজিত কুন্ডু কর্তৃক সদর দপ্তর বরকল জোন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যদের তথ্য চেয়ে জনসংহতি সমিতিকে এক চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। ‘ব্যক্তিগত কার্ড প্রস্তুত করণ প্রসংগে’ লেখা ওই চিঠিতে সদর দপ্তর রাঙ্গামাটি রিজিয়নের রাঙ্গামাটি সেনানিবাস পত্র নং ২৩.০১.৯৩১.১৩৬.০১.১৪৮.০১.১৮.১২.১৬ তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ (সকলকে নহে) এর বরাত দিয়ে আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখের মধ্যে জনসংহতি সমিতির সদস্যের নাম, ডাক নাম, বয়স, পুরুষ/মহিলা, পিতার নাম, মাতার নাম, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা, উচ্চতা, বুকের মাপ, চোখ, মুখমন্ডল, বর্ণনা, সনাক্তকরণ চিহৃ, সম্প্রদায়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, বিবাহিত অবস্থা, স্বামী/ স্ত্রী, ছেলে কতজন মেয়ে কতজন, উত্তরাধিকারী, বন্ধু-বান্ধব, সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত ইত্যাদি বিষয় পূরণ করে ঐ কার্ড রাঙ্গামাটি সেনানিবাসে প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
সম্প্রতি জানা গেছে, গত ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ নানিয়ারচরে গোপন এক সভায় জনৈক সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘যতদিন সেনাবাহিনী থাকবে ততদিন ভূমি কমিশন আইন কার্যকর হবে না। কাজেই সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেই চলতে হবে…’। এর কিছুদিন আগে জানা গেছে, ‘জনৈক সেনা কর্মকর্তা রাঙ্গামাটিতে বেশ কিছু সংবাদকর্মীকে নিজ কক্ষে ডেকে পাঠান এবং তাদের মোবাইল বন্ধ রাখতে বলেন। এক পর্যায়ে এক প্রকার শাসিয়ে এবং হুমকী দিয়ে বলেন যে, ‘আমি চাই না, সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট কোন খবর মিডিয়ায় আসুক। না হলে…..’। এ ধরনের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই বিপদজনক বলতে হয়।
উন্নয়নের নামে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্র ও কার্যক্রম
একদিকে যেমনি চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত জুম্ম জনগণের অধিকার খর্ব হচ্ছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জটিলতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, তেমনি অপরদিকে উন্নয়নের নামে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রমের ফলে জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের ফলে এ যাবৎ শত শত একর জুম্মদের জুমভূমি ও আবাসভূমি বেদখল করা হয়েছে, এখনও দখলে প্রক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ করে বান্দরবানের নীলগিরি (কাপ্রু ¤্রাে পাড়া), জীবন নগর (সেপ্রু পাড়া), চন্দ্র পাহাড়, ডিম পাহাড় (ক্রাউডং), নীলাচল ও রাঙ্গামাটির সাজেক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের ফলে মোট ২৬টি গ্রামের অন্তত ৬৯৭টি ¤্রাে, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার উচ্ছেদ ও ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। এছাড়াও যত্রতত্র পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী পর্যটন বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের এখতিয়ারধীন বিষয় হলেও পার্বত্য জেলা পরিষদকে তোয়াক্কা না করেই এবং এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে এ সমস্ত পর্যটন ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী ও বিজিবির উদ্যোগে ক্যাম্প সম্প্রসারণ, নতুন ক্যাম্প স্থাপনের নামে প্রতিনিয়ত জুম্মদের ভূমি বেদখল করা হচ্ছে বা বেদখলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, আঞ্চলিক পরিষদ ও চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতিতে পাশ কাটিয়ে এবং আইন লংঘন করে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করা হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে একপাশে সরিয়ে রেখে উন্নয়নের নামে জুম্মদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ ও বহিরাগত পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে জুম্মদের সংখ্যালঘু করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকার, সরকারের স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদী ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের যোগসাজসে একতরফাভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ স্থাপন, রাজস্থলী-বিলাইছড়ি-জুরাছড়ি-বরকল-ঠেগামুখ সংযোগ নির্মাণ, রাঙ্গামাটি জেলার কাচলং ও সীতাপাহাড় ভূ-গঠনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে ইতোমধ্যে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্যবাসী পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে। বস্তুত চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে, পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের নামে এধরনের একতরফা উদ্যোগ পার্বত্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এবং পার্বত্যবাসীদের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না।
উপসংহার
বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি। সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই পার্বত্য চুক্তি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে সামরিক ও নির্বাচিত তিন-তিনটি সরকারের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে মোট ২৬ বার বৈঠক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তবেই বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। আর এই চুক্তির ফলে দীর্ঘ দুই দশকের অধিক সময় ধরে চলা বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী ও জনসংহতি সমিতির মধ্যকার সশস্ত্র সংঘাতের অবসান হয়েছে এবং জনসংহতি সমিতি সরকারের নিকট অস্ত্র জমা দিয়ে জুম্ম জনগণের স্বায়ত্তশাসন আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে প্রত্যাবর্তন করে। পাহাড়ি-বাঙালি বহু মানুষের জীবন, বহু রক্তপাত, অসংখ্য জুম্ম মা-বোনের ইজ্জত, অগণিত জুম্ম নর-নারীর বহুমুখী ও ব্যাপক ভিত্তিক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে এই চুক্তি অর্জিত হয়েছে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প থাকতে পারে না।
আর চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটা আজ জরুরী উপলব্ধির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষমতাসীন দল থেকে কায়েমী স্বার্থবাদীদের এবং প্রশাসন থেকে সাম্প্রদায়িক, জাত্যভিমানী ও জুম্ম বিরোধী আমলাদের সরাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ হয়ে থাকবে। এদের দিয়ে আর যাই হোক সুষম উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কায়েমের কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হতে পারে না। কাজেই এখন গভীরভাবে ভাবতে হবে, এসমস্ত কায়েমী স্বার্থবাদী ব্যক্তি, সংকীর্ণতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক আমলাদের কারণেই কী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন তথা পার্বত্য সমস্যা সমাধানের এই মহতী উদ্যোগ ভেস্তে যাবে? পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব কী বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

Back to top button