মতামত ও বিশ্লেষণ

লোগাং গণহত্যাঃ আমার অহংকারে কালিমা- ইমতিয়াজ মাহমুদ

(১)
১০ই এপ্রিল। এপ্রিল মাস, বিশেষ করে মাসের এই সময়টা পাহাড়ের উৎসবের মাস। সমতলেরও। বসন্ত শেষ হয়ে নতুন বছর শুরু হবে সেই সংক্রান্তি আর নববর্ষ মিলিয়ে কতো উৎসব! বাংলাদেশে তো বটেই, হিমালয়ের এপারে কমবেশী সবখানেই- নেপালের ক্যালেন্ডার তো আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডারের মতোই, ভারতের বিভিন্ন জায়গাতেও এখন থেকেই উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। আসামের বিহু, আমাদের বিজু বিসু সাংগ্রাই সব।

এইরকম উৎসবের সময় আমরা সাধারণত আমাদের দুঃখ দৈন্য হতাশা কষ্ট শোক এইসব ভুলে যাই। উৎসবের সময়টাতে দুঃখের কথা মনে করিয়ে দিতে হয়না। তবুও আমি এই কাজটা করছি। আপনাদেরকে একটা ঘটনার কথা জানাই। পাহাড়ের ছেলে বুড়ো সকলেই জানেন, জানার কথা। সমতলের অনেকেই হয়তো জানেন না। একটু আগে একটা ছোট পোস্ট দিয়েছিলাম, সেখানে বিকাশ কবি আর অন্য একজন বলেছে ঘটনাটা বিস্তারিত লিখতে। বিস্তারিত লিখতে পারছি না- আমি আমার দুই বছর আগের একটা পোস্ট নিয়ে ঘটনাটা বলি।

১৯৯২ সনের ১০ই এপ্রিল। স্থান লোগাং গ্রাম- এই গ্রামটি খাগড়াছড়ির পানছরিতে। সরকার গৃহহীনদের জন্যে গুচ্ছগ্রাম বানিয়েছে। পাশাপাশি অনেকগুলি ছোট ছোট ঘর, সেখানে থাকে হতদরিদ্র হাজার দেড়েক মানুষ। ঘরগুলি থেকে একটু দুরে গরু চড়াতে গেছে তিনটি পাহাড়ি নারী। পাশেই আরেকটা গুচ্ছগ্রাম গড়ে উঠেছে সেখানে বাঙালি সেটেলারদের বসতি। সেখান থেকে কয়েকটা যুবক দেখেছে এই পাহাড়ি নারীদের। পাহাড়ে সেটেলাররা তো মনে করে নাক চ্যাপ্টা নারীদেরকে ধর্ষণ করা জায়েজ। ওরা হামলা করেছে সেই তিন নারীকে। তিন নারী নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করতে গিয়ে হাতের দা দিয়ে আঘাত করেছে, সেই আঘাতে একটা ধর্ষক গুরুতর আহত হয়ে সেদিন বিকেলে মারা যায়।

পাহাড়ি মেয়ের এত সাহস সে বাঙালি যুবককে দা দিয়ে কোপ দিবে? না হয় সে ধর্ষণই করতে গিয়েছিল? তাই বলে দা দিয়ে কোপ দিবে? মার শালা চাকমাদের। হামলা হয় পাহাড়ি গুচ্ছ গ্রামে। বাঙালি সেটেলার, পুলিশ সেনাবাহিনী সবাই মিলে অংশ নেয় সেই হামলায়। নিমেষেই পুড়িয়ে দেওয়া হয় আটশ’ ঘর, ঘরের ভেতর থাকা নারী শিশু বৃদ্ধ বেশিরভাগই মারা যায় পুড়ে। যারা ঘর থেকে বেরিয়ে পালাতে চেয়েছে, ওদেরকে মারা হয় নির্বিচারে গুলি করে। আশেপাশের কয়েক গ্রামের প্রাণ নিয়ে যে কয়জন পালাতে পেরেছিল ওরা শুধু প্রাণটা হাতে করে পালিয়ে যায় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে।

(২)
আপনারা জানেন আজকের মতই সেদিনও দশই এপ্রিলের দুদিন পরে ছিল ফুল বিজু, তারপর মুল বিজু। পাহাড়ের মুল উৎসব। সেদিনও লোগাংএর পাহাড়িরা উৎসবের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেই সময় ঘটে এই ঘটনা। ঘটনার পরদিন ঢাকা থেকে যাওয়া একটা দল- সেখানে আমাদের ব্যারিস্টার সারা হোসেন ছিলেন, আনু মুহম্মদ ছিলেন, ছিলেন আরও কয়েকজন, ওরা ঘটনাস্থলে যেতে চেয়েছিলেন। আর্মির লোকেরা ওদেরকে সেখানে যেতে দেয়নি। গোটা লোগাং এলাকাটা আর্মি সিল করে রেখেছিল কয়েকদিন ধরে। কিন্তু ওঁরা প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে ঘটনার ভয়াবহতা শুনেছেন। কিছু আলামত দেখেছেনও।

শুনেছি একজন নাকি লুকিয়ে একটি শিশুর পুড়ে যাওয়া কঙ্কাল নিয়ে এসেছিল ঢাকা থেকে যাওয়া মেহমানদের দেখানোর জন্যে। আপনি অনুমান করেন সেই পোড়া শিশুটি দেখতে কিরকম হয়েছিল।

সেই পোড়া শিশুর কঙ্কালের দৃশ্য মাথায় নিয়ে আপনি উৎসব করতে পারবেন? বিজু নববর্ষ আনন্দ শোভাযাত্রা পয়াণ ভোজন- পারবেন? তরুণ বন্ধুরা, দুঃখিত আপনাদের আনন্দের সময়টাতে এইসব কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু সেদিন যেসব মানুষকে ওরা মেরে ফেলেছিল, (জি, ওরা মানুষই ছিল, আমার আপনার মত বাঙালি হয়তো না, কিন্তু মানুষই ছিল ওরা) ওদেরকে আমি কি করে ভুলে যাবো?

আমার বন্ধুদের মধ্যে আনেক জ্ঞানী গুনি মানুষ আছেন। তরুণদের মধ্যে আমার যারা বয়ঃকনিষ্ঠ ওদের মধ্যেও অনেকেই আছেন যারা আইন কানুন মানবাধিকার নানারকম কনভেনশন ট্রিটি এইসব বিষয়ে অনেক জ্ঞানী। আপনারা কি কেউ আমাকে মেহেরবানী করে বলতে পারবেন যে এই ঘটনাটিকে আইনত গণহত্যা কেন বলা হবে না? আপনারা তো ফেসবুকে প্যালেস্টাইন সিরিয়া ফ্রান্স বেলজিয়াম এইসব জায়গায় যখন বেসমারিক মানুষের উপর হামলা হয় প্রতিবাদ করেন। আমিও করি। ফরাসী পতাকায় আমিও সাজিয়েছিলাম আমার ফেসবুক। লোগাং এর জন্যে কি করবেন?

আমি আমার বাঙালি জন্মের জন্য যখন অহংকার করি, সেই অহংকারে কালিমা ঢেলে দেয় এইসব ঘটনা। পাহাড় আমার এত প্রিয়, সেই ১৯৯২ সন থেকে এই পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর অন্তত একবার আমি নেপালে যাই পর্বতের হাওয়া খাবো বলে। ঢাকা থেকে এতো কাছে আমাদের প্রিয় রাঙ্গামাটি- ১৯৯২এর পর আমি সেখানে গিয়েছি শুধু একবার কি দুইবার। কি করে যাব? রাঙ্গামাটিতে বা খাগড়াছড়িতে যখন লাল সবুজ পতাকা দেখি, আমার মনে হয় ঐ লাল গোল্লাটা সবুজ পাহাড়ে আদিবাসীদের রক্তের দাগ।

(৪)
এক দিনে চারশ মানুষ মেরে ফেলা? এইটা কি হাসি তামাশার ব্যাপার? ভেবছিলাম নানারকম মানবিক কথাবার্তা বলে গণহত্যাটিকে সেন্সিটাইজ করবো। কিভাবে করবো? যখনই আমি কল্পনা করি কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্যে দিকবিদিক ছুটাছুটি করছে আর একদল মানুষ ওদেরকে গুলি করছে ওদের ঘরে আগুন দিচ্ছে, দা দিয়ে, কিরিচ দিয়ে কোপাচ্ছে যাকে পাচ্ছে তাকে- এই ঘটনাকে আপনি আর কিভাবে সেন্সিটাইজ করবেন?

আমি নিজেকে সেইসব হতভাগাদের দলে কল্পনা করি। ভাবি নিজের ভিতর ক্রোধ জাগ্রত হবে। জানেন, এক ফোঁটা ক্রোধ হয় না, রাগ হয় না। অসহায় লাগে নিজেকে। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। পরাজিত মনে হয়। একটা মৌলিক প্রশ্ন চলে আসে সামনে। সেদিনের ঘটনায় একদল আক্রান্ত আরেকদল আক্রমণকারী- এরা দুই দলই তো নিশ্চয়ই মানুষ হতে পারেনা। মানুষ তো আর মানুষকে এইভাবে মারবে না। একদল মানুষ ছিল আরেক দল না। সেদিন সেই দশই এপ্রিলের ঘটনায় কারা ছিল মানুষ আর কারা ছিল মানবেতর দানব? আমি কোন দলে?

আপনি রাঙ্গামাটি যাবেন বিজু খেতে? খাগড়াছড়ি? সাজেক যাবেন বেড়াতে? একজন আদিবাসীর চোখের দিকে আপনি কি করে তাকাবেন? পাহাড়ের প্রতিটা বাকে বাকে আপনি যখন দেখবেন সম্পূর্ণ কমব্যাট ইউনিফর্ম পরা ভারি অস্ত্র হাতে মিলিটারিরা টহল দিচ্ছে, কিরকম লাগবে আপনার? ভেবেছেন কখনো? রাঙ্গামাটি থেকে এক ছেলে ইনবক্সে আমাকে লিখেছে, ‘জুজু, আমরা বৈসাবি উপলক্ষে সংকলন বের করবো একটা লেখা দেন।’ বেকুব ছেলে, তোরে আমি কি লেখা দিব? ফুল বিজু আর মুল বিজুর মাহাত্ম্য? বিজু থেক বৈসাবির রূপান্তর?

আমার তো শুধু ১৯৯২ সনের বিজুর কথা মনে পড়ে যায়।

(৫)
আপনি কি জানেন যে এই ঘটনার কোন বিচার হয়নি? কোন বিচার হয়নি।

ইমতিয়াজ মাহমুদ; লেখক ও আইনজীবী

Back to top button