লামার দগ্ধ পাহাড়ে স্বপ্নের স্কুল- পাভেল পার্থ
ভাওয়াল কিংবা মধুপুরের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমিরও আজ করুণ দশা। একের পর এক পাহাড়ে গড়ে ওঠছে রাবার বাগান কী রিসোর্ট। এসব রাবার বাগান মানছে না স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের বিজ্ঞান, ভাঙছে পাহাড়ের খাদ্যশৃংখল। অসংখ্য বুনো প্রাণ নিজেদের বিচরণ অঞ্চল ও খাদ্যের জোগান হারিয়ে হয়ে ওঠছে বিপন্ন। তৈরি হচ্ছে পাহাড়ে নতুন বিবাদ, দ্বন্দ্ব সংঘাতের নয়া মেরূকরণ। ‘লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ’ নামের একটি কোম্পানি সম্প্রতি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে ৩৫০ একর পাহাড়ি বাস্তুতন্ত্র এবং জুমজমিন। খাদ্যের উৎস ও জোগান হারিয়ে লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্রপাড়া এবং রেংয়েন পাড়ায় তৈরি হয়েছে দু:সহ খাদ্য সংকট। ২৬ এপ্রিল আগুন দেয়ার পর লাংকম ম্রো পাড়ার কারবারি লাংকম ম্রো লামা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আসামিদের ভেতর রাবার ক্ম্পোানির ব্যবস্থাপক মো. আরিফ হোসন ও মাঝি মো. দেলোয়ারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেন। ২৯ এপ্রিল এ ঘটনার নিন্দা ও বিচারের দাবিতে ২৮ নাগরিক বিবৃতি দেন। লামা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮ মে ২০২২ ত্রাণ নিয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামগুলো ত্রাণ ফিরিয়ে দেয় কারণ সেখানে অভিযুক্ত রাবার কোম্পানির লোক ছিল। পরবর্তীতে লামার পাহাড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে অনেকেই নানা সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়ান। রাবার কোম্পানির আগুনে কেবল তিনটি গ্রামের মানুষের জুমজমিন আর ফসল পুড়েনি। দগ্ধ হয়েছে পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্র। অসংখ্য বুনোপ্রাণ হারিয়েছে সংসার। জুমচাষনির্ভর পরিবারগুলোর খাদ্যনিরাপত্তা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। মহামারি-উত্তর সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া অস্থির বাজারের কারণে দেশের সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তার বলয়কেও এই ঘটনা কিঞ্চিত হলেও প্রভাবিত করবে। তিনটি পাড়ার মানুষের জুমআবাদ আর ফলদ বৃক্ষের বিবেচনায় এর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়তো হিসাব করা সহজ। হয়তো এই ঘটনায় আতংকিত, ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামবাসী শিশু-প্রবীণ নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক ক্ষতিও কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে পরিবেশগত যে ক্ষতি হলো তা কী আর পূরণ করা সম্ভব? কেউ চাইলে রাবার বাগানের জন্য দেশের কোনো শস্যভরা জমি ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র আগুনে পুড়িয়ে দিতে পারে? রাবার আমাদের দরকার, কিন্তু এর জন্য অঞ্চল চিহ্নিত করে জোনিংসহ বিশেষ নীতি গ্রহণ জরুরি। চলতি আলাপখানি রাবার বাণিজ্য বা এর প্রতিবেশ-রাজনীতি নিয়ে নয়। চলতি আলাপখানি ঘটনাটির একটা ছোট্ট প্রতিবেশগত বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়ে দগ্ধ ঐ পাহাড়ে একটা স্কুলের দাবি তুলছে। লাংকম, জয়চন্দ্র ও রেংয়েন পাড়ায় ১৬ পরিবার ত্রিপুরা এবং ২৩ পরিবার ম্রো জাতিগোষ্ঠীর বাস। বিস্ময়করভাবে তিনটি পাড়ায় কোনো স্কুল নেই। স্কুলে যেতে হলে শিশুদের বহুদূর পাহাড়ি পথ ডিঙোতে হয়। পাহাড়ে কেউ স্কুল বা হাসপাতাল নিয়ে আসে না। ম্যারিয়ট আসে হোটেল কংবা রাবার কোম্পানি আসে জুম পুড়িয়ে বাগান বানাতে। চলতি আলাপখানি স্বপ্ন দেখে লামার পাহাড়ের ছোট্ট শিশুরা মাইলের পর মাইল রাবার বাগান নয়, নিজ পাড়ার স্কুলে মাতৃভাষায় পড়বে বই।
কী ঘটেছে লামার পাহাড়ে?
লামা উপজেলার নানা পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে জুমের জমিন এবং পাহাড়ি বাস্তুতন্ত্র জবরদখল করে রাবার বাগান করার জন্য তৎপর নানা কোম্পানি। এমনি এক পাহাড়ের ম্রো নাম সরই হোং (সরই পাহাড়)। সরই হোংয়ের ৩৫০ একর পাহাড়ি বনাঞ্চল ও জুমজমিন দখলের পাঁয়তারা করে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি। পাহাড়ি বন, জুম ও পাড়া সুরক্ষার দাবি জানিয়ে ২০২২ সনের ২০ মার্চ বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাবাসী মানববন্ধন করে। ক্ষতিগ্রস্থ জুমিয়া পরিবারের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দেশের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ বিবৃতিও দেন। কিন্তু বান্দরবান প্রশাসন উল্লিখিত পাহাড় সুরক্ষায় এলাকাবাসীর দাবিকে গুরুত্ব দেননি। ২৬ এপ্রিল এই কোম্পানি সরই পাহাড়ে আগুন লাগায়। রাবার কোম্পানির কেবল জুমক্ষেত বা ফলের গাছ নয়; চরম ক্ষতি হয়েছে পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্র ও প্রাণবৈচিত্র্যর। ৩০ এপ্রিল ২০২২ তারিখে দ্য ডেইলি স্টার দগ্ধ বাসাসহ নিহত পাখির ছানা ও মৌচাকের বীভৎস ছবি প্রকাশ করে। কোম্পানির আগুনে পাখি, মৌমাছি, বিড়াল গোত্রের প্রাণী এবং ঝিরির কাঁকড়া ও মাছ মরে পানি দূষিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে গণমাধ্যম।
গণমাধ্যমকে রাবার কোম্পানির পরিচালক আগুন দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কোম্পানি কারো জুমে আগুন দেয়নি, কোম্পানি নিজেদের জায়গা পরিস্কার করেছে। খাদ্য ও খাদ্যের উৎস পুড়ে যাওয়ায় সহসা এক নিদারুণ খাদ্যাভাব তৈরি হয় এই পাহাড়ি গ্রামগুলোতে। যদিও পরে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে সমতল-পাহাড়ের বহু মানুষ। ‘উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দের সম্মিলিত প্রচেষ্টা’ ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার প্রতি তিনটি কাঁঠাল, তিনটি আম গাছের চারা ও দুই হাজার করে টাকা দিয়েছেন।
তকওয়ামি বনাম ওয়াংতকমি
সরই পাহাড়ে ম্রো ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর বসতি বহুপ্রাচীন। কেবল সামাজিক সাংস্কৃতিক সাক্ষ্য নয়, এখানকার জুমভূমির বিন্যাস ও জুমধানের বিশেষ বৈচিত্র্যও একই প্রমাণ হজির করে। রাইচা, রাইরিক, ডেংপ্লি, চেম্মা, রাইসং, স্তুই, কুয়াতুইচা, রাইস্যু এমনসব অবিস্মরণীয় জুম ধানে আদি পৃথিবীর টাটকা ঝাঁঝ লেগে আছে। সমতলের কৃষি যেমন বহুস্তরে বিভক্ত, জুমআবাদেও ঋতুভিত্তিক কর্মস্তর আছে। চামকির ওয়াহ (জায়গা নির্বাচন) থেকে শুরু করে ওয়াহ চিয়াখিন, চিয়াডিয়া, ওয়াহ তৌকখিন, ওয়াহরাত, চাসতখিন, বটরামা থাক খিন, বটওয়াই থাক খিন, বটসুম, রউতাত, চাঙেনখিন, চাথুয়া, চারেও, চালিও বা পরের বছরের জন্য বীজ সংরক্ষণ এরকম নানা গুরুত্বপূর্ণ পর্ব নিয়ে ম্রোদের এক একটি জুমচক্র। জুমচক্রের একটি পর্ব হলো ‘তকওয়ামি’ মানে জুমক্ষেতের স্তুপে পরিকল্পিতভাবে আগুন ধরানো। মাটি, আর্দ্রতা, সময়, পানি, বাতাসের গতিবেগ, উচ্চতা, আশেপাশে প্রাণের উপস্থিতি নানা বিষয়ে নিরীক্ষা করে তকওয়ামি পর্ব পালিত হয়। তাহলে সরই পাহাড়ে রাবার কোম্পানি জোর করে দখলের উদ্দেশ্যে প্রাণহানির জন্য যেভাবে আগুন লাগালো তাকে ম্রো ভাষায় কী বলা যেতে পারে? আসলে বহিরাগতদের এমন শত্রুতাবসশত জোর করে লাগানো অগ্নিকান্ডকে ম্রো ভাষায় কী বলে তা নতুন প্রজন্মের শিশুরা ভুলেই গেছে। বহু আগে এমন কিছু ঘটনা ঘটতো, কেউ কোনো কারণে কারোর ওপর অখুশি হয়ে অন্যের জুমপাহাড়ে জোর করে আগুন লাগিয়ে দিত। জবরদস্তি করে লাগানো অগ্নিকান্ডকে ম্রো ভাষায় বলে ‘ওয়াংতকমি’।
সরই পাহাড়ে কীসের অভাব?
দেশে নানা স্থানে নানা ঋতুতে মানুষের খাবারের অভাব হয়। উত্তরাঞ্চলে কার্তিকের মঙ্গা কিংবা হাওরাঞ্চলে চৈত্রের নিদান। পাহাড়ে জুমে বীজ রোপণকালে খাবারের অভাব হয়। তখন বুনো খাবার কুড়িয়ে খাওয়ার সময়। চাকমা ভাষায় এই ঋতুভিত্তিক খাদ্যাভাব ‘চইতা রাইদ’ নামে পরিচিত। ত্রিপুরারা বলেন ‘বাসনি খরা’ আর ম্রো ভাষায় ‘সাতমা হমখন’ বা গ্রীষ্মকালের ভাতের অভাব। খাদ্যের অভাবকে ম্রো জুমিয়ারা ঋতুভিত্তিক বিবেচনা করেন। কোনোসময় বনজ খাদ্য ভান্ডারের অভাব এবং কোনো সময় ভাতের অভাব। গ্রীষ্মকাল শুরু হওয়ার পর যখন চারপাশে বনজ সব্জি কম পাওয়া যায় তখন একধরনের খাদ্য অভাব দেখা দেয়। এই অবস্থা মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত থাকে। বর্ষাকাল শুরু হওয়ার পর এই অবস্থা কেটে যায়। ম্রোদের ভেতর অভাবী মানুষকে ঙারাই বলে। একমাত্র জুমে ফসলহানি হলে কারো সাময়িক এ অবস্থা তৈরি হতে পারে। এরা কখনোই খাদ্যের জন্য কারো কাছে হাত পাতে না। অপরদিকে ভিক্ষুকদের ম্রোরা লু লুক চি বলে। এরা খাদ্যের জন্য অন্যের কাছে হাত পাতে, নিজে কাজ করে না বা করতে পারে না। ভিক্ষুক ম্রোদের ভেতর নেই। ঋতুভিত্তিক অভাব সামলে নেয়ার বহু টিকে থাকার কৌশল আছে ত্রিপুরা ও ম্রো সমাজে। কিন্তু রাবার কোম্পানির মতো বাইরে থেকে কেউ আগুন দিলে, দখল বা উদ্বাস্তু করলে তা সামলে নেয়ার কারিগরি কী হতে পারে? আর তাই দু:সহ খাদ্যাভাব নেমেছিল দগ্ধ লামার পাহাড়ি গ্রামে। খাদ্যর অভাব হয়তো সাময়িক সহযোগিতায় কিছুটা কাটলো কিন্তু রাবার কোম্পানির দখলিপনা থেকে কী বাঁচবে পাহাড় ও পাহাড়ের গ্রাম? এ প্রশ্নটি ফায়সালার জন্য হয়তো আমরাদের বহু নথি আর প্রমাণ নিয়ে বসতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে পার্বত্য শান্তি চুক্তি, পরিবেশ আইন, জীববৈচিত্র্য আইন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংষ্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, বন্যপ্রাণী আইন, মানবাধিকার ঘোষণা, আইএলও সনদ, প্রাণবৈচিত্র্য সনদ কী স্থানীয় সমাজের প্রথাগত কাঠামো ও আত্মপরিচয়ের দলিল। কিন্তু সরই পাহাড়ে দগ্ধ তিনটি পাড়ায় একটি বিদ্যালয়ের বড়ই অভাব। এই অভাব দূর হবে কবে? আমরা পাহাড়ে কতোই না রাবার বাগান কী রিসোর্ট দেখেছি। আসুন লামার দগ্ধ পাহাড়ে একটি স্কুলের জন্য জোরদার করি আমাদের নাগরিক সংহতি।
পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: [email protected]