আঞ্চলিক সংবাদ

লামার অগ্নিযোগের ঘটনায় প্রতিবাদী চরিত্র সংলেম ম্রোঃ কেমন আছে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরা ? (সরেজমিন প্রতিবেদন- ১)

বান্দরবান প্রতিনিধি, আইপিনিউজ: বান্দরবানের লামা উপজেলা সরই ইউনিয়ন এলাকায় ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির ৩০০ একর জুম চাষের জমি ও প্রকৃতিক বন পুড়িয়ে দেওয়া হয় গত তিন মাস আগে। পাড়াবাসীর অভিযোগ গত ২৬ এপ্রিল লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি রাবার কোম্পানি তাদেরকে পাড়া থেকে সুকৌশলে উচ্ছেদ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। আগুন দেওয়ার ফলে পাড়াবাসীর আশ-পাশ প্রাকৃতিক বনজঙ্গল ও জুম চাষের জমি সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়ে বিরানভুমিতে পরিনত হয়েছিল। এলাকাবাসী প্রাকৃতিক বন থেকে গাছ-বাঁশ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। যে জুমের উপর নির্ভরশীল ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়াতে সকল জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে লাংকম পাড়া, জয় চন্দ্র পাড়া, রেং য়েন ম্রো পাড়ার ৩৯পরিবারের মধ্য তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তারা নিরুপায় হয়ে বন থেকে সংগ্রহ করা আলু,কলাগাছের নরম অংশ, লতাপাতা-শাকসবজি খেয়ে, না খেয়ে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হয়। তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিন পাড়াবাসীর তীব্র খাদ্য সংকটের কথা জানাজানি হলে প্রথমে সরকারী তরফ থেকে অস্বীকার করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠন তিন পাড়ার ৩৯ পরিবারের খাদ্যের সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে।

জেলা শহর থেকে ৬০কিলোমিটার ও লামা উপজেলা থেকে প্রায় ৩০কিলোমিটার দূরে সরই ইউনিয়ন এর ৯নং ওয়ার্ড লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়েন ম্রো পাড়া সেখানে গত ৮ মে লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোস্তফা জাবেদ কায়সার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্যসংকটে পড়া তিনটি আদিবাসী পাড়ায় ত্রাণদিতে যান। এলাকাবাসী প্রথমে ত্রাণ নিতে আগ্রহী হলেও ত্রাণ বিতরনের সময় ইউএনও”র পিছনে তাচ্ছিল্যভাবে হেসে হেসে ছবি তুলছিল রাবার কোম্পানীর কর্মচারী মোঃ মোহসিন। প্রথমে তাকে কেউ চিনতে না পারলেও ঠিকই চিনে ফেলেন লাংকম ম্রো পাড়ার ৪ সন্তানের জননী সংলেম ম্রো (৪৭)। তাকে দেখার সাথে সাথে তিনি বলতে থাকেন,‘এই মোহসিনরাই আমাদের জুম বাগানে আগুন দিয়েছে। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘যারা আমাদের জুমের জায়গায়, প্রাকৃতিক বনে, ফলদ বাগানে আগুন দিয়েছে, যারা আমাদেরকে বাপ-দাদা ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভুমি কেড়ে নিতে চায় তাদের কাছ থেকে কোন ত্রাণ নেবোনা।’

স্থানীয় কয়েকজন আদিবাসী নারীসহ সংলেম ম্রো। ছবি- আইপিনিউজ।
তিনি সেসময় আরো বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনে উপোস থেকে মরে যাবো, তারপরও তাদের কাছ থেকে ত্রাণ নেবোনা।’ যেই কথা সেই কাজ। তখন তিন পাড়ার ৩৯পরিবার কেউই ত্রাণ গ্রহণ করেনি। তখন থেকে সংলেম ম্রো এলাকাবাসীর কাছে অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে আছেন। তার সেই প্রতিবাদী ছবি পরের দিন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হলে নিউজ সহ ছবি পুরো বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়ে যায়।
রবার কোম্পানির লোকজন কর্তৃক আগুন দেওয়ার পর পুড়ে যাওয়া প্রাকৃতিক বন ও জুম ভূমির চিত্র। ছবি- আইপিনিউজ, স্থান, সরই ইউনিয়ন, লামা।

জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার বাসিন্দা হাং মাইতি ত্রিপুরা(৫৫) বলেন, তাদেরকে বলা হয়েছিল সরকার পক্ষথেকে ত্রাণ সাহায্য দেবেন লামা ইউএনও পাড়ার সবাই একত্রিত হলে একসময় খেয়াল করেন রাবার কোম্পানীর মানুষ মোহসিনও আছে, তখন সাথে সাথে ইউএনওকে বলেছিলেন রাবার কোম্পানী লোকজন আপনার সাথে আছে তাই আমরা ত্রাণ নেবোনা। কারন যারা তাদের জায়গা-ভুমি কেড়ে নিতে চায় জীবন থাকতে তাদের কাছ থেকে ত্রাণ নেবো না, প্রয়োজনে মরে যাবো তারপরও ভুমিদস্যুদের নিকট থেকে ত্রাণ নেবোনা এবং পাড়ার কোন লোকজন ত্রাণ গ্রহণ না করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।

রেংয়েন ম্রো পাড়ার চাম রাও ম্রো (৪৫)বলেন, সেদিন নারী পুরুষ একসাথে প্রতিবাদ করেছিলাম। ভুমি দস্যুদের লজ্জা-শরম নাই। যারা আগুন দেয়, আদিবাসীদের মেরে ফেলতে চায়, ভুমি কেড়ে নিতে চায়, জায়গা থেকে উচ্ছেদ করতে চায় তারা আবার নির্লজ্জভাবে কিভাবে সাহায্য করতে আসে ? তিনি বলেন, যেহেতু রাবার কোম্পানী লোকজন সাথে ছিলেন তাই আমরা মনে করেছিলাম ইউএনও রাবার কোম্পানীথেকে টাকা নিয়ে আমাদেরকে ত্রাণ দিতে এসেছে সেজন্য আমরা সবাই মিলে ত্রাণ গ্রহণ করিনি। তিনি যোগ করেন আমরাতো ভিক্ষা চাইনি আমরা আত্মমর্যাদা নিয়ে নিরাপদে নিজের জায়গায় বসবাস করতে চাই।

অসহায় সহজসরল আদিবাসীদের অগ্নীমূর্তিরুপ ধারন করে সরকারের প্রতিনিধির সামনে অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদী আচরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বান্দরবানের নারী নেত্রী ও বিশিষ্ট মানবাধিকার নেত্রী ডনাই প্রু নেলী আইপিনিউজকে বলেন, আমাদের পাহাড়ীরা আজীবন আত্মমর্যাদা নিয়ে বসবাস করে আসছেন। শত বাঁধা-বিপত্তির, দুঃখ-কষ্ট, অভাব -অন্টনের মধ্যেও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেনি। যারা ম্রো ও ত্রিপুরাদের সৃজিত ফলদ বাগান, জুম বাগানসহ প্রাকৃতিক বনে আগুন দিয়েছে তাদের উপস্থিতিতে গত ৮মে লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট ত্রাণ না নিয়ে যে প্রতিবাদ জানিয়েছেন আমি তাদের স্যালুট জানায়।

তিনি আরো বলেন, সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে পাড়ায় পাড়ায় সকল নারীদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে হবে।
রাবার কোম্পানীর লোকজন পাড়াবাসীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর প্রকল্প পরিচালক মোঃ কামাল উদ্দিন সম্পূর্ণ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরই এলাকায় ৩০বছর যাবৎ রাবার উৎপাদন নিয়ে কাজ করছি। তিনি ৩৯ পরিবারের পাড়াবাসীর সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা করছেন বলেও জানান।

এছাড়া গত ১৩জুলাই রুংধজন ত্রিপুরাকে দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এঘটনায় তার লোকজন কোনমতেই জড়িত নয়।

সরই এলাকার ম্রো ও ত্রিপুরা ৩৯পরিবার আতঙ্কে থাকার প্রসঙ্গে লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘লামা রাবার কোম্পানী ও ম্রো-ত্রিপুরাদের ভুমি বিরোধ সংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন অবগত আছে এবং যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ এলাকায় কঠোর নজরদারীতে রেখেছেন বলেও জানান এই পুলিশের কর্মকর্তা।

লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, সরই এলাকার রাবার কোম্পানী ও স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরাদের সাথে ভুমি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রদান করা হয়েছে। যারা ক্ষতিগ্রস্থ তাদের জন্য কি করা দরকার সেটা তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এলাকার শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার জন্য পুলিশের নজরদারী বাড়ানো হয়েছে। আর এলাকাবাসীর খাদ্যের সংকট হলে সরকারের পক্ষ থেকে ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

Back to top button