লাউয়াছড়ার ২৫ হাজার গাছ কাটা যাবে নাঃ পাভেল পার্থ
লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে গেছে এক প্রবীণ রেললাইন। আর এই রেলপথ কতভাবেই না কতখানে ব্যবহৃত হয়েছে। রেলওয়ের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে কর্পোরেট পর্যটনের বিজ্ঞাপন। জুল ভার্ণের বই নিয়ে বানানো ‘আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ’ হলিউডের ছবিটিতে এই রেলপথের দৃশ্য আছে। বনের ভেতর রেললাইনের চারধারে কী থাকে? নিশ্চয়ই জুতার দোকান বা মুরগির খামার নয়। বনের ভেতর রেললাইনের চারধার জুড়ে গাছই থাকে। আর এইসব গাছে গাছে সংসার পাতে নানা বন্যপ্রাণ। পতঙ্গ থেকে পাখি। বাংলাদেশ রেলকর্তৃপক্ষ রেললাইনের চারধারের গাছ কেটে ফেলার জন্য বনবিভাগকে দুটি চিঠি দিয়েছে। লাউয়াছড়ার প্রতি বর্গ মিটারে প্রায় ২০টি গাছ আছে। এসব গাছ-গুল্ম ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা প্রাণ প্রজাতির জটিল সংসার। রেলওয়ের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে মানলে বনবিভাগের হিসাবমতে প্রায় ২৫ হাজার তরুণ ও প্রবীণ বৃক্ষ খুন হবে লাউয়াছড়ায়। এই ২৫ হাজার বৃক্ষ কাটতে যেয়ে খুন হবে আরো কয়েক লাখ শিশুচারা। নিশ্চিহ্ন হবে শত সহস্র মস-ফার্ণ-ছত্রাক ও গুল্মলতা। কখনোই যাদের হিসাবে ধরা হয় না। বনবিভাগ রেলবিভাগকে চিঠি দিয়ে রেলকর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পাল্টানোর প্রস্তাব করেছে। এখন দেখা যায় কে কার কথা শোনে? কিন্তু কথা না শুনলেও সকল বিভাগকেই প্রকৃতির জটিল ব্যাকরণ মানতে বাধ্য হতে হবে। কারণ রেলবিভাগ কী বনবিভাগ কেউই লাউয়াছড়ার বাস্তুসংস্থান পয়দা করতে পারবে না। এমনকি এটি কোনো হুকুম দিয়েও তৈরি করা যাবে না। তাহলে আমরা রেলপথের নিরাপত্তার ছুতো তুলে দুম করে কেন এমন সিদ্ধান্ত নেব? এমন সিদ্ধান্ত রেলকর্তৃপক্ষ কীভাবে নেয়? যে বিভাগে একজন চমৎকার রেলমন্ত্রী রয়েছেন, বয়স হলেও হৃদয়ে যিনি বারবার চিরসবুজ, সেই চিরসবুজ মন্ত্রীর দপ্তর থেকে সবুজ-হন্তারক এমন নোটিশ কীভাবে আসে? কারণ আমরা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাইবো না, আমাদের রেলমন্ত্রী ২৫ হাজার গাছ হত্যা করতে পারেন। লাউয়াছড়া শুধুমাত্র সংরক্ষিত বনভূমি নয়, এটি একইসাথে জাতীয় উদ্যানও বটে এবং এক বিরল বর্ষারণ্য। এমন এক বনের গাছ কাটার প্রস্তাব কীভাবে রেলবিভাগ আনলো? এটি তো লাউয়াছড়ার প্রাণ ও প্রতিবেশের খাদ্যশৃংখল ও ভারসাম্যের বিরুদ্ধে এক অন্যায় হুমকী। অবশ্যই এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার জরুরি।
২.
২০১৬ সনের ৯ এপ্রিল রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকোশলী-২ মো. আরমান হোসেন প্রথম চিঠিটি দেন। পরবর্তীতে রেলওয়ে ২০১৬ সনের ১৮ মে দ্বিতীয় চিঠি পাঠান বনবিভাগ বরাবর। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সূত্র উল্লেখ করে দেশিয় গণমাধ্যম জানায়, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ কিলোমিটার পথের প্রায় ৫০ ফুট এলাকার গাছ কাটতে হবে। একইভাবে রশিদপুর-সাতগাঁও বিভাগের ২৭১/২ থেকে ২৭৯/৭ কিলোমিটার পর্যন্ত রেলপথের উভয় পাশের গাছ কাটতে হবে। গাছ কাটার ক্ষেত্রে রেল বিভাগের ভাষ্য হল, ঝড়-বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে রেললাইনের উপরে পড়ে রেল চলাচল বিঘ্নিত হয় এবং এতে প্রাণহানিরও আশংকা আছে। উল্লিখিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সনের ৭ এপ্রিল রাতে ঝড়ে ৩০টি গাছ ভেঙে রেললাইনের উপর পড়ে। ২১ এপ্রিল ৩৫টি গাছ ভেঙে রেল চলাচল ব্যহত হয়, উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের হেডলাইট ভেঙে যায় ও ট্রেনটি আটকা পড়ে। চিঠিতে এও লেখা হয়েছে, পরবর্তী সময়ে কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে ‘দ্য রেলওয়েজ অ্যাক্ট ১৮৯০’ এর ১২৮ ধারা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে রেল। এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আরমান হোসেন গণমাধ্যমে প্রথম জানান, রেললাইনে গাছ পড়ে রেল চলাচল বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তাই নিরাপদ দূরত্বে গাছ কাটতে বলা হয়েছে (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ জুন ২০১৬)। এক সপ্তাহ পরে তার ভাষ্য হলো, বনবিভাগকে দেয়া রেল কর্তৃপক্ষের চিঠির মেয়াদ শেষ, এখন রেলের উদ্যোগেই গাছ কাটার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন (সূত্র: দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ জুন ২০১৬)। রেলওয়ের সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান দৈনিক মানবজমিনকে জানান, বৃহত্তর জনস্বার্থে গাছগুলো কাটতে হবে, বন্যাপ্রাণী বিভাগ না কাটলে রেলওয়ে কেটে ফেলবে (২৫ জুন ২০১৬)। লাউয়াছড়ার মতন এমন এক সংবেদনশীল বর্ষারণের গাছ কাটা নিয়ে রেলওয়ের বিরুদ্ধে যেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। এ বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মিহির কুমার দো প্রথম আলোকে জানান, বনের ভেতর রেললাইন থাকলে কিছু ঝুঁকি থাকবে, ঝুঁকি এড়ানোর জন্য রেললাইন শিফট করতে হবে, সরকারি গাছ চাইলেই কাটা যাবে না (১৭ জুন ২০১৬)। বন্যপ্রাণী বিভাগ রেলওয়ের প্রথম চিঠির জবাব দিলেও এখনও দ্বিতীয় চিঠির জবাব দেয়নি। তার মানে কী রেলকর্তৃপক্ষ গাছ কাটবেই, এটি কী জোরজবরদস্তির বিষয়? বনবিভাগকে কী জোর করে রাজি করানো হবে এবং বনবিভাগ রেলকর্তৃপক্ষকে চিঠি দিবে এবং সর্বনাশা খুনখারাবি শুরু হবে। বন্যপ্রাণী বিভাগের ভাষ্য, বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ আলোচনা করছেন। কিন্তু এরই ভেতর নিদারুণভাবে লাউয়াছড়াতে না হলেও এর লাগোয়া রাজকান্দি বনের গাছ কাটা শুরু হয়ে গেছে। রেলওয়ের সিদ্ধান্তে রাজকান্দি রেঞ্জের রেলপথের দু’পাশের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ‘সামাজিক বনায়ন’ প্রকল্পে লাগানো ৪ হাজার এবং মাগুরছড়ার ৫ শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে (সূত্র: মানবজমিন, ২৫ জুন ২০১৬)।
৩.
লাউয়াছড়ার গাছ কাটার রেলকর্তৃপক্ষের এই সরকারি সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই নতুন ঘটনা নয়। আমরা বহুবার এমন দেখে চলেছি, রাষ্ট্রের নানা সরকারি প্রতিষ্ঠান নানা সময় উন্নয়নের ছুতোয় জল-জংগল-জমিন-পাহাড় চুরমার করে দেয়। রাস্তা বানানো থেকে শুরু করে রেলপথ নির্মাণ, সেতু ও অবকাঠামো নির্মাণ, বাণিজ্যিক চিংড়ী ঘের থেকে শুরু করে রাবার বা তামাক বাগান এভাবে দেশের বহু প্রাকৃতিক বন ও বৃক্ষদের হত্যা করা হয়েছে। সেসব হত্যাকান্ড বারবারই ‘উন্নয়নের’ তলায় চাপা পড়ে বিচারহীন থেকে গেছে। ২০০৮ সালের ৩০ জুন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের নাহার চাবাগানের খাসি পানপুঞ্জি এলাকার গাছ কাটার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়। ২০০৮ সনের ৭ আগস্ট ৪৭ লাখ ৫১ হাজার ৩৯১ টাকা রাজস্ব নির্ধারণ করে নাহার চা বাগানের বিভিন্ন প্রজাতির চার হাজার গাছ কাটার অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ বনবিভাগ। সবকিছুকে ছাপিয়ে মহামান্য হাইকোর্ট ২০১০ সনের ২২ ফেব্রুয়ারি ৪০০০ গাছের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। কক্সবাজারের দক্ষিণ বনবিভাগের আওতাধীন টেকনাফ উপজেলার জাহাজপুরা সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ৩৬টি প্রবীণ গর্জন বৃক্ষের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর। ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে এই সড়ক নির্মানের কাজ বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকাতে শুরু হলেও পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য ৩৬টি মাতৃ গর্জন গাছ কাটা পড়াসহ ভবিষ্যতে ২০০ একরের এই গর্জন বন নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশংকায় বনবিভাগের শীলখালি রেঞ্জ এই প্রাণবিনাশী প্রকল্পের বিরুদ্ধে জানবাজি রেখে প্রতিবাদ জানায়। ভোলার চর কুকরি মুকরি নয়া ম্যানগ্রোভ বনকে খুন করে পাকা সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর। ১৬ মে ২০১০ তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ন্যূনতম গাছ কাটার শর্তে সড়ক নির্মাণের অনুমতি দেয়। কুকরি-মুকরি বনের উত্তরাংশ বাবুগঞ্জ থেকে পাতিলার বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ পাকাসড়ক নির্মাণের জন্য কাটা পড়ে ১৫ হাজার কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, ও পশুর গাছ।
৪.
লাউয়াছড়ার রেলপথের চারধারের গাছ কাটা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কারণ এটি এই বনের একটি জটিল বাস্তুসংস্থানের অংশ। রেলকর্তৃপক্ষের কাছে কী তথ্য আছে যে ২৫ হাজার গাছ কাটলে বনের এই বাস্তুসংস্থান এবং খাদ্যশৃংখল বিনষ্ট হবে না। কারণ ২৫ হাজার গাছ কেটে ফেলা যেনতেন কথা নয়, এর জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী প্রাথমিক পরিবেশগত প্রভাব যাচাই ও পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা জরুরি। এছাড়া কোন পদ্ধতিতে কীভাবে এই গাছ কাটা হবে, গাছ কাটার সময় কীভাবে শিশুচারা ও লতাগুল্মদের সুরক্ষা করা হবে? ২৫ হাজার গাছের উপর সরাসরি আশ্রয় করে বেঁচে আছে কোটি কোটি পতঙ্গ ও নানাজাতের পাখি। এসব গাছে আছে লাইকেন, অর্কিড, ছত্রাক, শৈবাল,অণুজীব, লতাগুল্ম ও নানা জাতের তৃণ। এসব প্রাণসত্তাকে বাঁচিয়ে কী কোনোভাবেই ২৫ হাজার গাছ এককভাবে কাটা সম্ভব? বনের কাউকে শংকিত ও উচ্ছেদ না করে প্রাকৃতিক বনের গাছ কাটার জাদুকরী কোনো উপায় ও প্রযুক্তি কী রেলবিভাগ ‘আবিষ্কার’ করেছে? রেলকর্তৃপক্ষকে এমন সমুদয় প্রশ্নের জবাব দিয়েই গাছ কাটতে হবে। কারণ সংবিধানমতে এই বন এবং বৃক্ষদের মালিক জনগণ, রেলকর্তৃপক্ষ নয়।
৫.
বারবার উন্নয়নের নামে লাউয়াছড়া ছিন্নভিন্ন হয়েছে। ১৯৯৭ সনে গ্যাস উত্তোলনের নামে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল এই বন ছাড়খাড় করে দেয়। তারপর আসে আরেক মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল। তারা পুরো বনতল জুড়ে পাইপলাইন বসায়। তারপর আরেক মার্কিন কোম্পানি শেভরন, তারা বনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। লাউয়াছড়াকে দেখতে হবে এর নানাজাতের প্রাণসত্তা ও এদের টিকে থাকার সংগ্রাম থেকে। গাছপালা, পশুপাখি, পতঙ্গ-অণুজীব, মাটি ও জলপ্রবাহের সাথে এখানে আদিবাসী খাসি পুঞ্জি ও ত্রিপুরা গ্রাম আছে, আছে চাবাগান। সবকিছু মিলিয়েই লাউয়াছড়া। এর একক কোনো মানে নেই। রেলকর্তৃপক্ষকে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। রেলপথকে নিরাপদ ও রেল ও যাত্রী নিরাপত্তায় কী করা যেতে পারে এ নিয়ে সকল পক্ষ নিয়ে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গাছ না কেটে বনের ভেতর টানেল নির্মাণ কিংবা রেলপথকে অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেককিছুই হতে পারে। মাননীয় রেলমন্ত্রীর সবুজ হৃদয় লাউয়াছড়ার গাছগুলোকে রক্ষা করবে এই আমাদের সকলের বিশ্বাস। জানি আমাদের বিশ্বাস সত্য প্রমাণিত করবে রেলমন্ত্রীর সবুজ হৃদয়।
প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষক। ই-মেইল: [email protected]