লংগদুর আগুন হোক আমাদের দ্রোহের বহ্নিশিখাঃ দীপায়ন খীসা
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2017/06/m-1.jpg)
২ জুন শুক্রবার আক্রান্ত হলো লংগদুর পাহাড়ী জনতা। ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই দেখলো পুড়ে ছাই হয়ে গেলো বসত ভিটা। এই আগুন স্বাভাবিক আগুন নয়। প্রকাশ্যে দিবালোকে ভোরের ¯স্নিগ্ধাতাকে উপহাস করে একদল পিশাচ লংগদুর পাহাড়ী আদামে আগুন দিয়েছে। রাজধানী ঢাকার নাগরিক জীবন তখনও রাত্রির আলস্যতা কাটিয়ে উঠেনি। একটু দেরীতে ঘুম ভাঙার পর প্রাতঃরাশ শেষ করতে না করতেই মুঠোফোন বার বার বেজে উঠতে লাগলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুঠোফোনে আলাপন। ঐ প্রান্ত থেকে বলা হচ্ছে লংগদুর অবস্থা খুবই থারাপ। ঢাকার বন্ধুদের জানিয়ে দাও। কতটা খারাপ তখনও অনুমান করতে পারেনি। আবার মুঠোফোন ব্যস্ত হয়ে উঠল। ইথারের সংবাদ লংগদু জ্বলছে। পাহাড়ীদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সেটেলাররা সামরিক বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় জ্বালিয়ে দিচ্ছে একের পর এক গ্রাম। আমি আমাদের শুভাকাংখীদের বিষয়টি অবহিত করি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দ্রুত বিষয়টি জানানোর তৎপরতা চালাতে থাকি। তার সাথে সাথে আমি ফিরে যায় ইতিহাসের আরেক কালো অধ্যায়ে। ১৯৮৯ ৪ঠা মে। সেই বর্বর গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাবলীর ফেলে আসা অতীত আমাকে কিছুটা হলেও অন্যমনস্ক করে তুলে। সেই গণহত্যার পর বদলে যায় লংগদুর জনমিতি। ফসলি মাঠ, গবাদি পশু. ধানের গোলা সমৃৃদ্ধ জীবন রেখে পাহাড়ীরা শুধু প্রাণটা নিয়ে পালিয়ে যায়। শুনশান জনপদে গড়ে উঠে অভিবাসী বাঙালিদের বসতি। রাষ্ট্র শক্তির দাপটে রাতারাতি বদলে যায় জনমিতি। দখল হয়ে যায় ভিটে-মাটি, আর বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জুম্ম ছাত্র সমাজ। গড়ে উঠে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। গণহত্যার রক্ত আর লংগদুর সেই সময়কার তপ্ত আগুন জুম্ম ছাত্র সমাজকে তাতিয়ে দেয়। পার্বত্য জেলা সমূহের সেই সময়কার রাজনৈতিক প্রান্তিক জেলা বান্দরবান জেলায় সবে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এই আমিও দ্রোহের ডাক শুনতে পাই। লংগদুর রক্তে আমি নেতাজীর সেই শিহরিত আহ্বান শুনতে পাই। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নেতাজীর সেই উদাত্ত আহ্বান “ আমাকে রক্ত দাও বিনিময়ে স্বাধীনতা।” আমি সুভাষ বলছি বইটি বার বার গোগ্রাসে পড়তে থাকি। মনে হয় এই আমিও আছি ইম্ফল রণাঙ্গনে। লংগদুর রক্তই পাহাড়ী ছাত্র সমাজকে প্রতিরোধে সমর্পিত হতে নতুন করে অনুপ্রাণিত করে। অগণিত জুম্ম ছাত্রদের ন্যায় আমার তারুণ্যও দ্রোহী হয়ে উঠে। লংগদুর রক্ত আমার জীবনকেও নাড়া দিয়ে যায়। সেই থেকে আজ অবধি লংগদু আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
১৯৮৯ থেকে ২০১৭ দীর্ঘ সময়। শুধু লংগদু নয় পাহাড়ী জনপদে কত রক্ত ঝরেছে তার কোন হিসেব নেই। জীবন কখনও জুম্ম জনগণের হয়ে উঠেনি। রাইফেল আর বেয়নটের ডগায় জুম্ম জনগণের জীবন। ২০১৭ এসেও জুম্ম জনগণের জীবন ১৯৮৯ সালের সেই বেদনার্ত কালো অধ্যায়ের কাছে ফিরে যায়। বার বার এই রাষ্ট্র আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ২০১৭ কিংবা ১৯৮৯ জীবন কখনও তোমাদের হবে না। তারুণ্যের সেই আমি এখন মধ্য বয়স অতিক্রম করি করি । কিন্তু সেই যে লংগদুর রক্ত আমার ধমনীতে নাচন ধরিয়েছে সেই তপ্ত রক্ত এখনও আমার শরীরে বহমান। রক্তের এই ¯স্রোতধারা আমাকে এখনও দ্রোহী করে রেখেছে। রক্তের সেই ঋণ এখনও শোধ করা হয়নি। বরং দেনা দিন দিন বাড়ছে। তবে দ্রোহের বহ্নি শিখা সেই যে একবার আমাকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে সেই শিখা আর নিভেনি। এই রাষ্ট্র নিভতে দেয়নি। ১৯৮৯ এর ৪ঠা মে আর ২০১৭-র ২ জুন ইতিহাসেরই আবার পুনরাবৃত্তি। ২০১৭-এর ২ জুন কোন গণহত্যা হয়নি। কিন্তু পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেছে ৩ শতাধিক ঘরবাড়ী। পুড়ে কয়লা হয়েছে ৭০ বছরের এক প্রবীণ নারী। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বোঝা বয়তে বয়তে শেষ বয়সে এসে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া। এই হচ্ছে জুম্ম জনগণকে রাষ্ট্রের প্রতিদান। ১৯৮৯-যেমন আমার যুবামন প্রতিরোধে সমর্পিত হয়েছিল এখনও একই বাস্তবতা। এই সময়ের তারুণ্য অবারও দেখল লংগদু জ্বলছে। চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কোন অজানায় হাঁটছে। সেই সাথে স্পর্দিত তারুণ্য বুক টান টান করে গগণবিদারী শ্লোগান তুলছে। প্রতিবাদের মিছিলে, প্রতিরোধের পথে এখনও ছাত্র সমাজ অমিততেজী। এটাই আমাদের সাহস যোগায়। ১৯৮৯-এ যে লংগদুর রক্ত আমাদেরকে দ্রোহী করেছিল, ২০১৭ এসে সেই লংগদুর আগুন দ্রোহের বহ্নিশিখাকে নতুন করে প্রজ্জ্বলিত করছে। রাষ্ট্র তুমি যতই আমাকে জ্বালিয়ে ছাই করোনো কেন, দ্রোহের বহ্নি শিখা আমাকে ফিনিক্স´ পাখির মত নতুন করে জম্ম নিতে অনুপ্রাণিত করে। হে দ্বগ্ধে জীবন হারানো জননী তুমি জেনে রেখো যে আগুন তোমাকে পুড়ে ছাই করেছে সেই আগুন দ্রোহের বহ্নিশিখা হয়ে অত্যাচারীকে চিরতরে ভষ্মীভূত করবে।
দীপায়ন খীসা
তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম