রেঙ ও চাকে মুখর আদামে পাজনের সৌরভ
দীপায়ন খীসাঃ চাকমাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসব বিজু। বঙ্গাব্দকে ঘিরে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের এ উৎসব চাকমা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গাব্দের সঙ্গে চাকমাদের যোগাযোগ কবে থেকে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব বিদগ্ধজনের। মোগল সাম্রাজ্যের অধীন চাকমা রাজাদেরও সে সময় বার্ষিক খাজনা দিতে হতো। চাকমা রাজারা মোগল সম্রাটদের বার্ষিক কর হিসেবে কার্পাস তুলা দিতেন। এ কারণে পার্বত্য অঞ্চল একসময় কার্পাসমহল নামেও পরিচিত ছিল। মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকে বঙ্গাব্দের সূত্রপাতের একটা বিষয় ইতিহাসে আছে। তাই মোগল শাসকদের কর আদায়ের হাত ধরে বঙ্গাব্দের সঙ্গে চাকমাদের পরিচয়ের ঘটনাটিও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে যেভাবেই এ মিথস্ক্রিয়া ঘটুক না কেন, চৈত্রের শেষে বর্ষবিদায় ও পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের আমেজকে একান্তই নিজেদের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে চাকমারা বাঁধভাঙা উৎসবে মেতে ওঠেন। চৈত্রের শেষ দুদিন ও বৈশাখের প্রথম দিনসহ মোট তিনদিন এ উৎসবের সময়। বিজু উৎসবের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ফুল বিজু, চৈত্রের শেষ দিনকে বলা হয় মূল বিজু। আর বছরের প্রথম দিন হলো গোজ্জ্যা পোজ্জ্যা। চৈত্র মাসকে চাকমা ভাষায় বলা হয় চোইত মাজ আর বৈশাখ মাসকে বলা হয় বোজেক মাজ।
বিজু উৎসব তিনদিনের হলেও চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে গৃহস্থরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে গৃহিণীরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে তৎপর হয়ে ওঠেন। জামা-কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার রাখা, ঘর পরিচ্ছন্ন রাখা, উঠান আর বাড়ির চারপাশ ঝকঝকে রাখতে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীরা ব্যস্ত সময় কাটান। থালা-বাসনসহ নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র বিজুর আগে ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতি ঘরে চলে বিরামহীন আয়োজন। এভাবে বিজু ঘরে ঘরে, আদামে (গ্রাম) জানান দিয়ে আসে। পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন হয় ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়ানুষ্ঠান। ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা, পোর খেলা, বলি খেলাসহ নানা ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলায় লোকালয় মেতে ওঠে। অতীতে গেংখুলিদের (চাকমা চারণ গীতিকবি) গানে গানে মুখর হয়ে উঠত চাকমা জনপদগুলো। উভগীতের সুরে সুরে টালমাটাল হয়ে উঠত পাহাড়ি গ্রাম।
বিজু উৎসবের প্রথম দিনটি ফুল বিজু। এদিন শিশু-কিশোর-কিশোরীরা আলো-আঁধারে ঘুম থেকে উঠে ফুল তুলতে যায়। তার পর মালা গেঁথে ফুলে ফুলে ঘর সাজানো হয়। প্রত্যুষে নদীতে কিংবা ছড়ায় ফুল ভাসানো হয়। নদীর দেবতাকে প্রণাম জানানো হয়। ঘরের দুয়ারে, উঠানে, গোয়ালে ও নদীর ঘাটে জ্বালানো হয় সান্ধ্যপ্রদীপ। শুধু ফুল বিজুর দিন নয়, মূল বিজু ও গোজ্জ্যা পোজ্জ্যাতেও এ সান্ধ্যপ্রদীপ জ্বালানো হয়। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ বছরের শেষ দিনটি হলো মূল বিজু। এদিন হলো বর্ষবিদায়ের উৎসব। ঘরে ঘরে খাবারের নানা আয়োজন। তবে পাজন তরকারি প্রতি ঘরে থাকবে। নানা পদের সবজি দিয়ে এ পাজন রান্না করা হয়। হরেক রকমের পিঠা তৈরি করা হয়। ছোট ছেলেমেয়েরা মূল বিজুর দিন খুব ভোরে নদীতে কিংবা ছড়ায় ডুব দিয়ে বিজুগুলো (কাল্পনিক বিজুফল) খুঁজতে থাকে। তার পর নিকট-দূরের ঘরে ঘরে গিয়ে মোরগ-মুরগিদের জন্য উঠানে চাল কিংবা ধান ছিটিয়ে দিয়ে আসে। মূল বিজুর দিন গৃহস্থরা প্রস্তুত থাকেন অতিথি আপ্যায়নের জন্য। অথিতি আপ্যায়নই হচ্ছে মূল বিজুর দিন গৃহস্থদের প্রধান কাজ। পাজন আর হরেক রকমের পিঠার সঙ্গে থাকে নানা পানীয়। জগরা, কাঞ্জি ও দুচোয়ানি। পানীয়তে আসক্তি না থাকলেও ওই একটি দিনে আপনাকে সবাই একটু হলেও স্বাদ নিতে বারবার অনুরোধ করবে। গৃহকর্তা কিংবা কর্ত্রীও বারবার সাধবেন একটু গলা ভিজিয়ে নেয়ার জন্য। দলবেঁধে এ ঘর থেকে ও ঘর, এক আদাম থেকে আরেক আদামে বিজু খাওয়া— সে এক মহা আনন্দের মহাযজ্ঞ। দেখা যাবে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরছে আর ঘুরছে। দিন শেষ করে মাঝরাত পর্যন্ত ক্লান্তিহীন এ ঘোরাফেরা আর বিজু খাওয়া। তরুণ-তরুণীরা হইহুল্লোড় আর রেঙ ও চাক (এক ধরনের সংঘবদ্ধ উল্লাসধ্বনি) দিয়ে পুরো দিনটাকে আনন্দ আর উল্লাসে ভরিয়ে রাখে। বিজু হলো খাওয়া-দাওয়া আর আনন্দ-উল্লাসে সময় কাটিয়ে দেয়ার সর্বজনীন উৎসব। বিজুর শেষ দিনটিকে বলা হয় গোজ্জ্যা পোজ্জ্যা। বঙ্গাব্দের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ হলো গড়িয়ে গড়িয়ে থাকার দিন। মূল বিজুর দিন খাওয়া-দাওয়া আর আনন্দ করার পর শেষ দিনটি হলো গড়াগড়ি খাওয়ার দিন। অবশ্য এদিন গুরুজনদের প্রণাম করা হয়, অনুজরা জ্যেষ্ঠদের আশীর্বাদ নেয়। নদী, ছড়া কিংবা কুয়ো থেকে পানি তুলে এলাকার প্রবীণদের স্নান করানো হয়। গোজ্জ্যা পোজ্জ্যার দিনও বিজুর উৎসবের আমেজ থাকে। যদিওবা গড়াগড়ি খাওয়ার দিন; কিন্তু ওইদিনও মূল বিজুর মতো উৎসব উৎসব রব থাকে। ধর্ম-কর্ম দিয়ে যারা বছরটা শুরু করতে চান, তারা বিকালে কিয়াংয়ে যান। একটা কথার প্রচলন আছে, ‘বিজু গেলেও নাকি কিছু থেকে যায়।’ বিজুর এ রেশ অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়ার ধুম বেশ কিছুদিন থেকে যায়।
মূল উৎসবের পাশাপাশি বিজুর অন্য দিকও রয়েছে। বিজু উৎসব নিয়ে রচিত হয়েছে নানা কবিতা, গান ও নাটক। চাকমাদের শিল্প-সাহিত্যসহ সংস্কৃতির সব শাখায় একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে বিজুর প্রভাব। হালনাগাদ বিজুর নগরায়ণ হয়েছে। বিজুর দু-একদিন আগে বিজু শোভাযাত্রা নগর সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু-তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক মেলা আয়োজন করাও নাগরিক বিজুর অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বিজুর খাওয়-দাওয়াতেও নাগরিক সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। বহুজাতিক কোম্পানির কোমল পানীয়, তার সঙ্গে নুডলস, সেমাইসহ নামীয় ব্র্যান্ডের বাহারি মিষ্টি নাগরিক বিজুর অপরিহার্য উপাদান হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে নতুন কাপড় কেনাকাটার একটা আয়োজনও যোগ হয়েছে।
এটাও একটা বিবর্তন। নগরায়ণের সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে বিজু উৎসব আরো সমৃদ্ধ হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। চাকমাদের এক বিরাট সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ চট্টগ্রাম ও ঢাকার সাভারে ইপিজেডগুলোয় চাকরিরত। পাহাড়ের বাইরে ইপিজেডের এ অঞ্চলগুলোতেও ঘটা করে বিজু উৎসবের আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। বাংলদেশের বাইরে ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা ও অরুণাচলের চাকমা অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় বিজু উৎসব উদযাপন করা হয়। পৃথিবীর দেশে দেশে যেখানে চাকমারা আছেন, অভিবাসী হয়েছেন, বিজু উৎসবে তারা শামিল হবেনই। বিজু উৎসব চাকমাদের জীবন-ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা ছাড়াও মারমা, তংচঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, অহমি ও গুর্খারা বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের এ উৎসব পালন করে থাকেন। তংচঙ্গ্যারা বিষু, অহমিরা বিহু আর ত্রিপুরারা বৈসুক নামে এ উৎসবকে অভিহিত করে থাকে। নামের ভিন্নতা থাকলেও তংচঙ্গ্যা, চাকমা, ত্রিপুরাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষববরণ উৎসব বঙ্গাব্দকে কেন্দ্র করে। এ উৎসব বঙ্গাব্দকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও প্রত্যেক জাতি নিজ নিজ সংস্কৃতি ও রীতি-নীতিতে বর্ষবিদায় আর বরণের আয়োজনকে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। আর মারমাদের বর্ষবিদায় আর বর্ষবরণ উৎসবের নাম হচ্ছে সাংগ্রাই বা সাংগ্রাইং। সাংগ্রাই হলো মগাব্দের বিদায় ও বরণ উৎসব। বঙ্গাব্দের সঙ্গে মগাব্দের বর্ষবরণ আর বিদায়ের পার্থক্য দু-তিনদিন। বিজুর শেষ মানে সাংগ্রাইং শুরু। পাহাড়জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগুলোর বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের এ উৎসব সমগ্র পাহাড়ি জনপদকে আনন্দের উচ্ছলতায় মাতোয়ারা রাখে।
বঙ্গাব্দের চিরকালীন প্রথা হলো বর্ষকে বিদায় জানানো; যেটা চৈত্রসংক্রান্তি নামে পরিচিত। চৈত্রের শেষে বর্ষবিদায়কে কেন্দ্র করে এ চৈত্রসংক্রান্তি। বাংলার মাঠে-হাটে চৈত্রসংক্রান্তিতে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। কিন্তু বাংলাদেশের শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্ত, প্রধানত বাঙালি মসুলমানরা এ আয়োজনকে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণে রূপান্তর ঘটিয়েছেন। কবিগুরু রবিঠাকুরের জন্মের বহু আগ থেকেই বঙ্গাব্দের যাত্রা। রবিঠাকুর বঙ্গাব্দের বিভিন্ন ঋতু ও মাসের বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক গান লিখেছেন। বর্ষা, বসন্ত ও বৈশাখ নিয়ে রবিঠাকুরের বহু গান কালজয়ী হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্ত রবিঠাকুরের এসো হে বৈশাখ এসো গানটি নিয়ে বাংলা বর্ষবরণের যে আনুষ্ঠকিতা তৈরি করল, তার আয়ুষ্কাল খুব বেশি দীর্ঘ নয়। এ পোশাকি আয়োজনের ডামাডোলে বঙ্গাব্দের বর্ষবিদায়ের চিরায়িত চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব একেবারে গায়েব হয়ে গেল। চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব কীভাবে পহেলা বৈশাখে রূপান্তর ঘটল, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা চলতি রচনার বিষয় নয়। যেহেতু পাহাড়ের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গাব্দ, সেহেতু এ বিষয়টার হালকা অবতারণা করা। চাকমাদের মূল বিজু কিন্তু চৈত্রের শেষ দিন। এটাই হচ্ছে বঙ্গাব্দকে বিদায় জানানোর পরম্পরা রীতি। বাংলার মূল ভূখণ্ডে এ রীতি ম্রিয়মাণ হলেও ভাষায় যারা বাঙালি নন, তারাই বঙ্গাব্দ বিদায়ের পরম্পরাকে স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বলভাবে টিকিয়ে রেখেছে। আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে সবকিছুই আগ্রাসনের কবলে। কিন্তু পাহাড়ের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব তার স্বকীয়তা টিকিয়ে রেখেছে গৌরবের সঙ্গে। জনসংখ্যায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তংচঙ্গ্যা, অহমি ও গুর্খারা ১০ লক্ষাধিক। জনমিতির এ ক্ষুদ্র পরিসংখ্যান নিয়ে আকাশ সংস্কৃতির সর্বগ্রাসীর বিপরীতে পাহাড়ের জুম্ম জনগণ নিজস্ব ঐতিহ্যকে লালন-পালন করছে। এটাই হচ্ছে শেকড়ের প্রতি অসীম টান।