রাজশাহীতে আদিবাসীদের উন্নয়নে জাতীয় নীতিমালার বাস্তবায়ন শীর্ষক প্রশিক্ষণ
সোহেল হাজংঃ কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ১৪ ও ১৫ নভেম্বর “আদিবাসী উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট জাতীয় নীতিমালা ও সরকারি বাজেটসমূহ বাস্তবায়নের মনিটরিং” বিষয়ে দুইদিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালা রাজশাহীর ডাসকো প্রশিক্ষণ কক্ষে আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন এবং জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন-এর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক হিরন মিত্র চাকমা। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম পিয়ারুল, বাংলাদেশের ওয়ার্কারস পার্টি, রাজশাহী মহানগরের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ প্রামাণিক দেবু, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, রাজশাহী থেকে ড. আইনাল হক, কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী সোহেল হাজং, খোকন সুইটেন মুরমু ও হেলেনা তালাং।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, “আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সাথে আমি গত ২৫বছর ধরে সম্পৃক্ত রয়েছি। দেশের সকল আদিবাসীদের প্রতি আমার সমবেদনা রয়েছে। একজন মানুষ হিসেবে আদিবাসীদের সাথে আমি আরো কাজ করতে চাই এবং তাদের অধিকার আদায়ের সম্পৃক্ত লড়াইয়ে জিততে চাই। ” এর আগে স্বাগত বক্তব্যে হিরন মিত্র চাকমা এ প্রশিক্ষণ কর্মশালার লক্ষ্য উদ্দেশ্য তোলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকারি সকল নীতিমালায় আদিবাসী অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলির কি পর্যায়ে রয়েছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর কার্যক্রমের সাথে আদিবাসীরা কতটুকু সম্পৃক্ত এবং আদিবাসী নেভিগেটর এর পদক্ষেপ নিয়ে আদিবাসী নেতৃবৃন্দ ও স্টেকহোল্ডারদের অবগত করানোই হচ্ছে এ প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য। ড. আইনাল হক বলেন, দেশের উন্নয়নে সকল মানুষের সার্বিক উন্নয়ন দরকার। কেউ যেন পেছনে পড়ে না থাকে! আদিবাসীদের এ উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, আদিবাসী অধিকার নিয়ে জাতীয়ভাবে এখনো তেমন কোন আইন প্রতিষ্ঠা পায় নি আবার বিভিন্ন নীতিতে আদিবাসীদের যতটুকু আনা হয়েছে সেটারও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নেই। আদিবাসীদের ওপর যে সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনা ঘটে তার কোন সুষ্ঠু বিচার হয় না। তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন নিয়েও আদিবাসীদের সচেতন হতে হবে। জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন রয়েছে তাদের সমস্যাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তোলে ধরার জন্য। এসডিজি কার্যক্রমও সকলের অন্তর্ভূক্তির কথা বলেছে।
এ প্রশিক্ষণে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় আদিবাসী প্রতিনিধি, নারী, যুব ও আইপিএইচআরডি-এর সদস্যসহ প্রায় ৪০ জন অংশগ্রহণকারী হিসেবে উপস্থিত আছেন। এ প্রশিক্ষণের মূল বক্তব্যের নোটে কাপেং ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, বাংলাদেশে স্মরণাতীত কাল হতে ৫০ টিরও অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগণ বসবাস করে আসছে। দেশের পার্বত্যাঞ্চল, বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, উত্তরবঙ্গ, গাজীপুর ও ঊপকূলীয় অঞ্চলে তাদের বসবাস। তারা দেশের সর্বাধিক পিছিয়েপড়া জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে অন্যতম। ঊপনিবেশিক আমল থেকে এদেশের আদিবাসীরা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণসহ বহুবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আসছে। আশানুরূপ না হলেও, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সরকার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দেশের আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর নানাবিধ চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা মোকাবেলায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে। এ উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ অনুস্বাক্ষর। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসীদের প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, জাতিসত্তা, উপজাতি এবং সম্প্রদায় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারী উন্নয়ন-এসব জাতীয় নীতিমালায় আদিবাসী অধিকার বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ এর আরো সংশোধিত সংস্করণ হলো আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক আইএলও কনভেনশন নং ১৬৯। আশাজনক যে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০)-এ বাংলাদেশ সরকার আইএলও কনভেনশন নং ১৬৯ অনুস্বাক্ষর এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র ২০০৭ অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে বাংলাদেশ সরকারের একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হয় যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নামে পরিচিত। এ চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে এবং চুক্তির পূর্ণ বাস্তায়নে সরকার প্রতিশ্রুতি অব্যাহত রেখেছে। যাই হোক, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ বাস্তবায়নেরও সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্র যদি যত্নের সাথে এ লক্ষ্যমাত্রার প্রত্যেকটি অভীষ্ট বাস্তবায়ন করে যায় তাহলেও আদিবাসীরা অনেকাংশে উপকৃত হতে পারে। কেননা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার এক তৃতীয়াংশের বেশি অভীষ্টের মধ্যে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র-এর সুনির্দিষ্ট ধারাসমূহ প্রতিফলিত হয়েছে।