জাতীয়

রাঙামাটিতে বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু এর প্রস্তুতি

এন্টুমনি তালুকদার,রাঙামাটি: আসছে ২৯ ও ৩০ চৈত্র ১৪২৫ বঙ্গাব্দ এবং ১ বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ তথা ১২, ১৩ ও ১৪ এপ্রিল ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতি সমূহের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ও জাতীয় প্রাণের উৎসব ‘বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসুক, বিষু, বিহু, সাংক্রান’। বহুজাতি, বহুভাষা ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির এই দেশের পার্বত্য জনপদে স্মরণাতীতকাল থেকে জুম্মদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্য পূর্ণ ঐতিহ্যের ধারা বহন করে চলেছে এই উৎসব। এই উৎসব উপলক্ষে ‘বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসুক, বিষু, বিহু, সাংক্রান’ ২০১৯ উদযাপ নকমিটি, রাঙ্গামাটির পক্ষ থেকে আপনাদের সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

লোকজ কোনো উৎসব যে কোনো জনগোষ্টীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তেমনি এই উৎসব ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অন্যতম প্রাণ প্রবাহ ও অনুপ্রেরণার উৎসহি সেবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। যুগ যুগ ধরে এই উৎসব জুম্মদের প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে যেমনি, তেমনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পরস্পরের মধ্যে সামাজিক সংহতিও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে। এই উৎসব আদিবাসী জুম্মদের মাঝে জাতীয় চেতনা, ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবতাবোধ, সম্প্রীতি, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক চেতনা, উদারতা, আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও মমত্ববোধকে আরও জাগ্রত ও জোরদার করে। বস্তুুত এই উৎসবটি জুম্মদের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
বলাবাহুল্য নানা কারণে বিষেশত রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠীর, অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক ও বৈরী পদক্ষেপ ও আচরণের কারণে এই অঞ্চলের আদিবাসী জুম্মরা বরাবরই শোষণ, বঞ্চনা ও বিপন্নতার শিকার হয়ে আসছে। আদিবাসী জুম্মদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদেরকে জোর করে বৃহত্তর বাঙালি সমাজে অঙ্গীভুত করানোর ষড়যন্ত্র চলছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একদিকে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে জাতিগত পরিচিতির স্বীকৃতি লাভের প্রাণের দাবিকে উপেক্ষা করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি প্রত্যেক জাতির আতœ পরিচয়ের সহজাত অধিকারকে খর্ব করে সংবিধানে আদিবাসীদের ‘‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠীও সম্প্রদায়’’ হিসেবে অসম্মানজনক ও বিভ্রান্তিকর পরিচয়ে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণকে জাতিহিসেবে বাঙালি পরিচিতি করার মাধ্যমে ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন জাতি সত্তার অধিকারী আদিবাসী জাতি সমূহকেও ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে জুম্ম সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও তার বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে সহায়ক বিভিন্ন ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জুম্মদের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার বিধান করা হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান করা হয়েছে যেগুলো জুম্ম সংস্কৃতি সংরক্ষণ,লালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে আতœ নিয়ন্ত্রনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তুু বিগত ২১ বছরে ও চুক্তির মৌলিক বিষয় সমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ায় জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় চরম এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্যে দিয়ে আদিবাসী জুম্মদের বন, ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সংস্কৃতির অধিকার যতটুকু স্বীকৃত হয়েছে তা আজ নানাভাবে পদদলিত করা হচ্ছে। পর্যটন কেন্দ্র, ক্যাস্প সম্প্রসারণ, রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণা, বহিরাগতদের লীজ প্রদানসহ নানা অজুহাতে জুম্মদের স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, বহিরাগতদের কর্তৃক জুম্মদের ভূমি বেদখল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বহিরাগত অভিবাসন, জুম্মদের সংখ্যালঘু করণ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং জুম্মদের আন্দোলন দমনের নামে নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, বাড়িতে অগ্নি সংযোগ ইত্যাদির কারণে বার বার জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে দেশের স্বাধীনতার চার দশক ও পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২১ বছর পরে ও ঐতিহ্যবাহী এই ‘বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসুক, বিষু, বিহু, সাংক্রান’ উৎসব যে ভাবে আরও বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় হওয়ার কথা, আরও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালিত হওয়ার কথা সেভাবে তা হতে পারছে না।
তবুও জুম্মদের মাঝে এই উৎসবের আবেদন চিরন্তন। তাছাড়া শুধু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংহতিও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠানয়, অধুনাবিশেষত জুম্মদের স্বকীয় সাহিত্য সৃষ্টি, নৃত্য-গীত, শিল্পকলা ঐতিতহ্যবাহী ক্রীড়া চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে ও এই উৎসব তাৎপর্য পূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। উৎসব উৎযাপন কমিটি এবছর এই উৎসবকে অর্থবহ, সৃষ্টিশীল ও সার্থক করার লক্ষে ‘জুম্ম সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও অধিকার নিশ্চিত করণে ঐক্যবদ্ধ হোন’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে এসেছে এবং চার দিনব্যাপী এক অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করেছে। উক্ত অনুষ্ঠান সফল করার লক্ষে উদযাপন কমিটির সকলের আন্তরিক ও উদ্যোগী সহযোগিতা ও অংশ গ্রহণ কামনা করছে।

Back to top button