মিঠুন রাকসাম; মান্দি সাহিত্যের বহুমাত্রিক তরুণ প্রতিভা
শ্যাম সাগর মানকিনঃ সময়ের মান্দি সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম তরুণ তুর্কি মিঠুন রাকসাম। সাহিত্য চর্চা, প্রকাশনা, ছোট কাগজ সম্পাদনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন কায়মনোবাক্যে। এরই মধ্যে সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার পদচ্ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। কবিতা লেখার পাশাপাশি ছোটগল্প লেখা, গবেষণামূলক লেখায় নিজের হাত পাকিয়েছেন মিঠুন রাকসাম। সম্পাদনা করেন ছোট কাগজ থকবিরিম। ছোট কাগজ থকবিরিম থেকেই প্রকাশ করে থাকেন মান্দি লেখক-সাহিত্যিকদের লেখা পত্তর।
মিঠুন রাকসাম শেরপুর জেলার মরিয়মনগরের ভাটপাড়া গ্রামে ১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা যুবরাজ হাদিমা আর মা রেজিনা রাকসামের বড়ছেলে মিঠুন। যুবরাজ ও রেজিনা দম্পতির আরেক মেয়ে রয়েছে । মিঠুন রাকসাম পড়াশুনা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।
মিঠুন রাকসামের ছোটবেলা কেটেছে অবাধ দূরন্তপনা দিয়ে। পুরো গ্রাম দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বন্ধুদের সাথে নিয়ে। গ্রামের খালে সকাল দুপুর দাপিয়ে বেড়ানো, পাখি শিকার করে খাওয়া, অন্যের ফলমূল চুরি করা ছিলো ছোটবেলাকার নিত্যদিনের কাজ। গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন বন্ধুদের সাথে। নিজের ছোটবেলা নিয়ে এমনই বলেন মিঠুন রাকসাম। সাহিত্যের প্রতি ভালোলাগা সেই ছোটবেলা থেকেই। আরো পরে এসে সেই ভালোবাসা পরিণত হতে থাকে। মা রেজিনা রাকসাম ছিলেন বিনোদনপ্রিয়, সংস্কৃতি মনা। সে সময় আশেপাশে যে কোন অনুষ্ঠান, নাটক হলেই ছেলেকে নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে যেতেন তিনি। বলা যায় মিঠুন রাকসামের সাহিত্যের প্রতি যে ভালোবাসা অনুরাগ তার একটা গোড়াপত্তন ছিলো সেটা । তাদের গ্রামে সাময়িকী প্রকাশ হতো নিয়মিত। সেখানে লেখা পড়ে মনে মনে ভাবতেন আমিও এমন লিখতে পারবো। কিন্তু সে সময় তার মতন তরুণদের লেখা ছাপাতে বেগ পেতে হতো সেই সাময়িকীতে। স্কুলে পড়ার সময় থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি, নাচ, একক অভিনয় নিয়মিত অংশগ্রহণ ছিলো তার। শেরপুরের আলহাজ্ব শফিউদ্দীন আহমদ কলেজে পড়ার সময় দেয়াল পত্রিকায় লেখা দিয়ে তার সাহিত্য চর্চার একপ্রকার শুরু হল বলা যায়। কলেজের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক ক্ষমা চক্রবর্তী প্রতিনিয়ত তাকে উৎসাহিত করে গেছেন লেখার ক্ষেত্রে। মিঠুন রাকসামের ভাষ্যমতে ক্ষমা চক্রবর্তীর উৎসাহ তাকে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে অনেক বেশি।
তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ হলো মন্ত্রধ্বনি। ২০০৭ সালে শালুক প্রকাশনী থেকে তার এই কবিতার বই প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে একে একে তার কবিতা ও গল্পের বই প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে। এখন পর্যন্ত কবিতার বই বেরিয়েছে ৬ টি, গল্পের বই একটি আর গবেষণাধর্মী একটি। তার প্রকাশিত বইগুলো হল- কাব্যগ্রন্থ –মন্ত্রধ্বনি, শিঙালাগানী মেয়ে, যমজ স্তনের ঘ্রাণে বালকের জীবন, দলিলে ভাটপাড়া গ্রাম, মুখ না ধুয়ে লেখা কবিতা, গন্ধচোর।
গল্পগ্রন্থ- শিকড়ে খড়া
গবেষণা গ্রন্থ- মান্দি জাতির পানীয় ও খাদ্য বৈচিত্র্য ।
এর পাশাপাশি থকবিরিম নামে ছোট কাগজ সম্পাদনা করেন তিনি। এখান থেকেই বিভিন্ন বই প্রকাশের কাজও করে থাকেন।
একটা সময় বিটিভির শিশুদের অনুষ্ঠান সিসিমপুর১২৩ এ সিনিয়র স্ক্রিপ্ট রাইটারের কাজ করেছেন। কিছুদিন একটা সাপ্তাহিকেও কাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু সব ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে তার নিজের প্রকাশনী থকবিরিমের প্রকাশনার কাজেই পুরো মনোযোগ দিয়েছেন। বর্তমানে গারো মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাতকার নিয়ে কাজ করছেন। ভবিষ্যতে মান্দি সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্য আড্ডা, লেখক কর্মশালার মতন নানান কাজে হাত দেয়ার পরিকল্পনা আছে। যাতে করে মান্দি লেখকরা সমসাময়িক কালের সাহিত্যের সাথে নিজেদের পরিচিতি ঘটাতে পারে। এই কাজে হাত দেবার আরেক কারন তিনি আমাদের জানালেন। মান্দি সাহিত্যিকদের মধ্যে সমসাময়িক সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি চোখে পড়ার মতন। এর কারন হয়তো পর্যাপ্ত পড়াশুনা না করা। দেখা যায় যে কবিতা যারা লিখছেন তারা অধিকাংশ সময় রাবিন্দ্রীক সাহিত্যের যে ভাষার প্রয়োগ তার থেকে বের হতে পারছেন না। ফলে বর্তমান সময়ে ভাষার যে প্রয়োগ, যে চিত্রকল্পের নির্মাণ তা করতে মান্দি সাহিত্যিকরা সফল হচ্ছেন না। মিঠুন রাকসাম তার কাজের উদ্দেশ্য এভাবেই আমাদের কাছে প্রকাশ করলেন।
মিঠুন রাকসামের সাহিত্যে জড়িয়ে থাকে মান্দি জাতিগোষ্ঠীর জীবন যাপনের নানান চিত্রকল্প। মান্দি জাতিগোষ্ঠীর শত বছরের লাঞ্ছনার ইতিহাস, তাদের সংস্কৃতি, জীবনবোধ তার সাহিত্যের উপাদান। প্রবলজীবনবোধ কখনো কখনো তার সাহিত্যে দ্রোহের সঞ্চার ঘটায়। ধর্মান্তরিত মান্দি জাতিগোষ্ঠী তার সব ঐতিহ্য, কৃষ্টি হারিয়ে যখন দিশেহারা তখন তরুণ কবি মিঠুন রাকসাম তার যাপনে, তার কবিতায়, গল্পে জাগিয়ে তোলেন অন্য এক সত্তা। যে সত্তা আদিম প্রকৃতিপূজারী মান্দি জাতিগোষ্ঠীর অনবদ্য এক আলেখ্য বয়ান করে। কখনো কখনো স্বপ্ন দেখায় ফের নকমার উঠোন জুড়ে বসবে ওয়ানগালা। যেনোবা প্রবল স্রোতের বিপরীতে দাঁড় বেয়ে আত্মন কে ফিরে পাবার এক ব্যকুলতম নাবিক মিঠুন রাকসাম।