মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাঃ এক মহান বিপ্লবীঃ আবু সাঈদ খান
বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের এক অনন্য নাম। যিনি বাংলাদেশের জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন। জনপদের অধিকার-বঞ্চিত নরনারীকে মুক্তির মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন দুর্বার আন্দোলন। তার মৃত্যুর পরও সে আন্দোলন থামেনি। ১৯৯৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি – সে আন্দোলনেরই ফসল।
কৈশোর থেকে তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন, শিক্ষাজীবনে ছাত্র আন্দোলন করেছিলেন, ধারণ করেছিলেন মার্ক্সবাদী দর্শন। ছাত্রজীবন শেষে নিজ শিক্ষকতা করেছেন, ওকালতি করেছেন। তবে কখনো ভুলেননি নিপীড়িত পার্বত্যবাসীর কথা। ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, জনগণের সুখে দুঃখে তাদের পাশে থেকেছেন। এভাবেই হয়ে ওঠেন পার্বত্যবাসীর কন্ঠস্বর। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়। তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মুখপাত্রে পরিণত হন।
স্বাধীনতা-উত্তর যখন জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠিত হলে তখন অধিবেশনে দুই প্রতিবাদী কন্ঠ ন্যাপের ( মোজাফ্ফর) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও স্বতন্ত্র সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। সে সময়ে আমরা বিপ্লবী লারমার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে পরিচিত হই। সংসদে দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বেলিত বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর নেতাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, বাংলাদেশের মানব মানচিত্রের বৈশিষ্টের কথা। তিনি গণপরিষদে বলেন, ‘ আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্যবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সব দিক দিয়েই আমরা এক সঙ্গে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দ পুরুষ বলে নাই – আমি বাঙালি।’ স্পীকার যখন জানতে চান – আপনী বাঙালি হতে চান না? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘… আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদের বাংলাদেশী বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।’ তাঁর এ উপলব্ধি সঠিক ও যৌক্তিক। আমাদের বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, বাংলাদেশ কেবল এক জাতির বাস নয়, সংখ্যার বিচারে ছোট হলেও আরো জাতিসত্তা আছে, ভিন্নতর নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের মানুষ আছে। বাঙালির সঙ্গে তাদের তাদের যুথবদ্ধতা আছে, আবার স্বাতন্ত্রতা আছে। এ সব বৈচিত্রের মাঝেই ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ। সেদিন তিনি এই বাস্তবতাকে তুলে ধরেছিলেন। বহু কাটা-ছেঁড়ার পরও বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিক পরিচয় আবার ‘বাঙালি’ হয়েছে। এখনো সাংবিধানিকভাবে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর গায়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রলেপ রয়েছে – যার কোনো মানে নেই। বরং যেটি প্রয়োজন আদিবাসীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি। পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রাক্কালে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী এবং নাগরিক সমাজের দাবির মুখেও নীতিনির্ধারকদের চৈতন্যোদয় হলো না। তবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি – নিশ্চয়ই একদিন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে – সেটি কেবলই সময়ের ব্যাপার। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, দেশের সব নাগরিকের সমমর্যদা সুনিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে যেমনি ধর্র্মনিরপেক্ষ হতে হবে, তেমনি হতে হবে জাতি নিরপেক্ষ, ভাষা নিরপেক্ষ ও লিঙ্গ নিরপেক্ষ; এটি স্যেকুলারিজিমের মর্মবাণী।
বিপ্লবী লারমা গণপরিষদ ও পরবর্তী জাতীয় সংসদের সদস্য হয়ে কেবল চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং প্রভৃতি পাহাড়ী জনগণের অধিকারের দাবিতেই সোচ্চার ছিলেন না। তাঁর ভাবনায় ছিল সমগ্র বাংলাদেশ। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, নারী, পেশাজীবীদের অধিকারের কথা বলেছেন। সামাজিক বঞ্চনার শিকার যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও পুনর্বাসনের দাবি তুলেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রকে একাত্তরের শহীদদের সন্তানের দায়ভার গ্রহণের তাগিদও দিয়েছিলেন।
১ এপ্রিল ১৯৭৩-এ রাষ্টপতির ভাষণের ওপর বক্তৃতাকালে বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ প্রস্তাবের সঙ্গে নিম্নরূপ কথাগুলি যোগ করা হোক; পাকিস্তানের যে হানাদার বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে, আজো সে হানাদারদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হয়নি এবং দুঃখের বিষয় এই – বিচার কবে এবং কখন করা হবে, সেই কথাটা রাষ্ট্রপতির ভাষণে স্থান লাভ করেনি।’ এটি আমাদের মর্মযন্ত্রণা যে, আমরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারিনি। তারা আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। তবে তাদের দেশীয় দোসরদের বিচার হচ্ছে। সে যাই হোক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নানা জাতীয় ইস্যুতে সোচ্চার মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মূল্যায়ন কি আমরা করতে পেরেছি?
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় নেতা। দুর্ভাগ্য যে, তিনি মূলধারায় রাজনীতির নেতৃত্বে আসীন হবার যোগ পাননি বা সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। সে সুযোগ তিনি পেলে সমগ্র জাতিই উপকৃত হতো, জাতীয় সংহতির বাতাবরণ আরো সুসংহত হতো।
বিপ্লবী লারমা আমাদের মাঝে নেই। তবে তিনি সংগ্রামে ও সংসদে যে দিগ-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন তা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করতে, সংখ্যালঘু জাতি ও জনগোষ্ঠীর অধিকার সমুন্নত রাখতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বক্তব্য বিবেচনায় আনতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে – তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই।
আবু সাঈদ খান
কলাম লেখক ও সাংবাদিক
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী-২০১৫তে জাতীয় কমিটির স্মরণিকায় ১ম প্রকাশিত