মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা দেশের আপামর মানুষের নেতা: স্মরণ সভায় বক্তারা
আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা দেশের আপামর মানুষের নেতা বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট জনরা। শ্রমজীবী মানুষের প্রিয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জাতীয় কমিটির উদ্যোগে মহান বিপ্লবীকে শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্মরণসভায় এই মন্তব্য করেন বিশিষ্টজনরা। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের, বকুলতলায় বিকাল ৩.০০টায় শ্রদ্ধাঞ্জলি, স্মরণসভা, কবিতা পাঠ, প্রদীপ প্রজ্বালন ও প্রতিবাদী গানের অনুষ্ঠান আয়োজন করে জাতীয় কমিটি।
উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ভূমি ও আইন বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল আাজিমের সঞ্চালনায় উক্ত স্মরণসভায় আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার, বাংলাদেশ জাসদ’র সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর প্রতিনিধি নাসির হোসেন প্রিন্স, এএলআরডি’র প্রতিনিধি আজিম হায়দার, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মাসুদা রেহেনা বেগম, আরডিসি’র সাধারণ সম্পাদক জান্নাত এ ফেরদৌসী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফেরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলীক মৃ প্রমুখ। এছাড়া শোক প্রস্তাব পাঠ করেন ইসলামী বিশ্বিবিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জাতীয় কমিটির সদস্য ফারহা তানজিম তিতিল। শোক প্রস্তাব পাঠ করে এই দিনে শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মিনিট মৌনতা পালন করা হয়।
শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাবি শিক্ষক অধাপক ড. সৌরভ সিকদার। তিনি এম এন লারমার উক্তি উল্লেখ করে বলেন ”আমরা ধর্ম, সংস্কৃতির দিক দিয়ে আলাদা হলেও মানবতার দিক দিয়ে আমরা সবাই এক”। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে মানবতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়াই করে গেছেন। তিনি শুধু পাহাড়ের মানুষের নন, সর্বোপরি সকল মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন। যারা জনগগণের প্রতিনিধিত্ব করেন তারা মেহনতি মানুষের কথা বলেন না। কিন্তু মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন মহান সংসদে দাঁড়িয়ে এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন। মহান নেতার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সকলকে এগিয়ে আসার জন্য এই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, আজকের এই দিন জুম্ম জাতির জন্য কালো অধ্যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সবসময় আত্মনিয়ন্ত্রনের কথা বলেছে, বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য নয়। পাহাড়ের মানুষকে শত্রæ ভেবে নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য সরকারকে পাহাড়ের মানুষের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে। আজকের পাহাড়ে যে ভাগ কর, শাসন কর নীতি চলছে, বিভিন্ন যে সশস্ত্র-গোষ্ঠির উদ্ভব হয়েছে, আমি বলতে চাই সরকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই সব গোষ্ঠিকে দুধ কলা দিয়ে কালো সাপ পোষার মতো পুষছে এবং তারাই বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হয়ে ছোবল মারার চেষ্টা করছে।
ছাত্রনেতা অলিক মৃ বলেন, জাতীয় নেতার প্রয়ান দিবসে যে প্রদীপ জানিয়ে দিয়েছেন তা আমরা এখনও জ¦লতে দেখি। কৃষকশ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের অধিকার যেন প্রতিষ্ঠা পায় সংসদে দাঁড়িয়ে দাবি করেছেন। ৫০ বছরেও এই শ্রমজীবিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি।
আরডিসি’র সাধারণ সম্পাদক জান্নাত এ ফেরদৌসী বলেন, শুধু সেই সময় না এখনও নারী অধিকারসহ অন্যান্য সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা কম বলা হয়। কিন্তু মহান নেতা সেই সময়ে সংসদে দাঁড়িয়ে তাদের অধিকারের কথা বলেছেন। ভাবাদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ আজ ক্রমান্বয়ে অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি। বহুত্ববাদীকে সম্মান প্রদশন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা মহান নেতার কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল সেই সময়। এই দেশটা যে অসম্প্রদায়িক দেশ হওয়া দরকার তা আমরা এম এন লারমার কন্ঠে শুনতে পায়।
নাগরিক উদ্যোগের প্রধান প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন বলেন, আত্ম-পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এই শ্রমজীবি মানুষের নেতা। সংখ্যাগরিষ্ঠের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের প্রশ্নে আজও আমরা উনাকে জাতীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারিনি, এটা আমাদের জন্য লজ্জা।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, সেই সময়ে তিনি সংসদে বৈচিত্র্যতার প্রশ্ন না করলে এদেশ আজ বহুজাতির দেশ হিসেবে তা সামনে আসতো না। আমি নাম উচ্চারণ করতে চাই না, আপনাদের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি করিয়ে দিচ্ছি, আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি। এখন থেকে আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। এদেশে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এই আহ্বান জানান।
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, যদি মত প্রকাশে স্বাধীনতা না থাকে তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কোথায় এই প্রশ্ন সেই সময় মহান নেতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আমরা এখনও লড়াই করছি মত প্রকাশের ক্ষেত্রে। শান্তিচুক্তি হয়েছিল পাহাড়ী মানুষের শান্তির জন্য । কিন্তু তারা কি শান্তিতে আছে? এখনো তল্লাশি চলছে পাহাড়ে পাহাড়ে নিরাপত্তার নামে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এর আধিপত্যে সংখ্যালঘুদের কন্ঠে আমরা শুনি না। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার স্বপ্ন আসুন সবাই মিলে প্রতিষ্ঠা করি।
নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, এম এন লারমা যে বৈষম্যহীন, শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেইটা আমাদের স্বপ্নের বাইরেই রয়ে গেছে। সেই স্বপ্ন অর্থাৎ শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসার আহŸান জানান।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি আমলারা কি আদিবাসীর স্বীকৃতি কি মানে? মোটেই না। সরকার এই বিষয়ে কাজ করছে না। যদি এম এন লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে তাদের মুক্তি পথ যেতে হবে, আমরা এই লড়াইয়েপামে আছি।
ঐক্য ন্যাপ সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক বলেন, ছাত্রজীবন থেকে তিনি যে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, অসম্প্রদায়িক ও মানবতার রাজনীতি করেছেন। শেষ পর্যন্তও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে অটল ছিলেন। তার জন্য তিনি লড়াই করেছেন দুর্গম পাহাড় থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতর পর্যন্ত ।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী বলেন, এমএন লারমার ভাবনাগুলো খন্ডিত নয়। তিনি শুধু আদিবাসীদের কথা বলেন নি, নারীদের কথা, শ্রমজীবিদের কথা, কৃষকের কথা বলেছেন। পাহাড়ী নেতা হয়েও সবার কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের ওয়াকাস পাটির সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন বলেন, মানবেন্দ্র লারমার রাষ্ট্রভাবনা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, জাতীয় ভাবনাগুলো তাকে বোঝার জন্য যথেষ্ঠ। পাহাড়ে পাহাড়ীরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যে ভাগ কর, শাসন কর নীতি শুরু করা হয়েছে তা শাসকগোষ্ঠীর কাছে বুমেরাং হয়ে ফিরেছে। পাহাড়ের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে মেসবাহ কামাল বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মৃত্যুবাষিকীতে আমরা তাঁর স্মৃতির সাথে তাঁর যে রাষ্ট্রভাবনা, সমাজভাবনা, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যে চেতনা স্মরণ করছি তাঁর জন্য বিশেষ করে তরুণদের আমি ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলতে চেয়েছেন, মানুষের জন্য মানবিক রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়। সকল নাগরিকের সমান অধিকার এবং বহুজাতির বাংলাদেশের বিশ^াসী ছিলেন এম এন লারমা। তিনি বারবার বলতে চেয়েছেন একটি দেশের নাগরিকত্ব এক হতে পারে কিন্তু একজাতির দেশের চিন্তা আমরা করতে পারি না। আমরা নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী কিন্তু বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন আরও অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পুষ্পস্তবক অর্পন দিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে শ্রদ্ধা জানান মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা’র ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল এর নেতৃত্বে অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। এছাড়া আরো শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, ঐক্য ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, মহিলা পরিষদ, বাসদ, জাসদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, কাপেং ফাউন্ডেশন, এএলআরডি, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, আরডিসি, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, জনউদ্যোগ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বাগাছাস, আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, গানের দল মাদল, নাগরিক উদ্যোগ, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন।