মতামত ও বিশ্লেষণ

মহীয়সী নারী হাজংমাতা রাশিমণি হাজং

সোহেল হাজংঃ আজ ৩১ জানুয়ারি। আদিবাসীদের ইতিহাসে এক অন্যতম দিন। এ দিনে মহীয়সী নারী ও টংক আন্দোলনের নেত্রী রাশিমণি হাজং তার দল ও ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
রাশিমণি হাজংয়ের জন্ম ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলাধীন বগাঝরা নামক গ্রামে ১৯০৮ সালে।

শৈশবকালীন শিক্ষা ছাড়া তার আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়নি। তবে ছোটকাল থেকেই তিনি খুব কৌতূহলী ও স্বাধীনচেতা ছিলেন। বাল্যকালেই তার বিয়ে হয়েছিল স্থানীয় আড়াপাড়ার পাঞ্জি হাজংয়ের সঙ্গে। স্বামী পাঞ্জি হাজং একজন কবিরাজ ছিলেন। সেই সুবাদে তিনিও স্বামীর কাছ থেকে কবিরাজী বিদ্যা অর্জন করেন। তাছাড়া নিজেও কিছু তন্ত্রমন্ত্র ও ধাত্রী (দাইমা) জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। তাই রাশিমণি প্রতিবেশীদের ছোটখাটো কোন রোগ সারাতে ও সন্তান প্রসব করানোর মতো সেবা করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।

তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় একজন প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে। সেসময় তার গ্রামটি ছিল ব্রিটিশবিরোধী গ্রামগুলোর মধ্যে একটি। রাশিমণি হাজংয়ের মনেও শুরু থেকেই ব্রিটিশবিরোধী চেতনা গড়ে ওঠে। মহাজন ও জোতদারদের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখেন। এভাবেই এক সময় তিনি হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী।
টংক আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে কৃষক আন্দোলন। টংক মানে ধান কড়ারি খাজনা। টংক প্রথার শর্তানুসারে জমিতে ফসল হোক বা না হোক চুক্তি অনুযায়ী টংকের ধান জমির মালিককে দিতেই হতো। ফলে দেখা যায় কোন বছর যদি জমিতে ফসল না হয় বা খরা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্য নষ্ট হয়ে যায় তবুও কৃষককে তার নির্ধারিত খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এতে হাজংসহ অন্যান্য সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক কৃষকসমাজ অর্থনৈতিকভাবে দুরবস্থায় পড়ে। আর কোনও কারণে টংকের ধান পরিশোধ করতে না পারলেই কৃষকদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার-নিপীড়ন।

টংক প্রথা কৃষকদের জন্য ছিল অভিশাপ। সেজন্য তারা টংকের হাত থেকে মুক্তির জন্য সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ বা আন্দোলন গড়ে তোলেন। রাশিমণির নেতৃত্বে হাজংরা প্রথমে টংকের কুফল বিষয়ে সচেতনায়নে গ্রামে গ্রামে বৈঠক করেন। পরে ঐকমত্য সৃষ্টি হলে কৃষকরা জমিদারদের টংক ধান দেওয়া বন্ধ করে দেন। এতে টংক চাষীদের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্ভোগ । কেননা জমিদারগোষ্ঠী টংক ধান আদায়ের জন্য যথাসাধ্য শক্তি প্রয়োগ করেই চলত। মূলত হাজং কৃষকগণই টংক প্রথা উচ্ছেদের জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রথমে তারা জমিদার গোষ্ঠীর সঙ্গে অতঃপর ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে এবং শেষে পাক-সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। হাজংদের এ টংক ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দানে এগিয়ে আসেন কমরেড মণি সিংহ। যদিও বলা হয় ১৯৩৮ সাল থেকে টংক আন্দোলন শুরম্ন হয়েছিল কিন্তু তার বহু পূর্বেই আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল এবং হাজংদের মাঝে সেটা কাজ করছিল।

রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে নেত্রকোনার প্রতিটি অঞ্চলে যখন আন্দোলন তুঙ্গে। সে সময় ১৯৪৬ সালের ১ জানুয়ারি দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্ বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে বিদ্রোহী হাজং কৃষকসহ অন্যান্য কৃষকদের খুঁজতে শুরম্ন করে। সে লক্ষ্যেই ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল্স বাহিনী বিরিশিরি থেকে চার মাইল উত্তরে বহেরাতলী গ্রামে তলস্নাশি চালায়। কিন্তু এ দিনে এ গ্রামের বিদ্রোহী কৃষক নর-নারীরা প্রতিবেশীদের টংকবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার কাজে পাশের গ্রামে চলে গিয়েছিল।

অবশেষে বহেরাতলী গ্রামে কাউকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত পুলিশ বাহিনী লংকেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে বিরিশিরি ক্যাম্পের দিকে রওনা হয়। হাজং গ্রামগুলোতে এ সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে শতাধিক হাজং নারী-পুরম্নষ সশস্ত্র বাহিনীর পথরোধ করে। এ সময় বিপস্নবী রাশিমণি হাজং তার দলবলসহ কুমুদিনী হাজংকে বাঁচাতে পুলিশ বাহিনীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই বলে_ “ময় তিমাদ, তিমৗদলৗ মান ময় রুক্ষা কুরিব না-তে মরিব, তুরা তুমলৗ নীতি নিয়ৗ বুইয়ৗ থাক।” বাংলায়- আমি একজন নারী, নারী হয়ে নারীর মান রক্ষা করব নাহয় মরব, তোমরা তোমাদের নীতি নিয়ে বসে থাক । পুলিশ বাহিনীও নৃশংসভাবে তাদের ওপর গুলি চালায়। ফলে এক সময় পেছন থেকে আসা গুলিতে রাশিমণি হাজং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পেছনে পুরম্নষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাশিমণিকে ধরতে গেলে তাকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাকি আদিবাসীরা পুলিশদের মেরে ঘায়েল করা শুরম্ন করলে অবশেষে তারা কুমুদিনীকে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এভাবেই শহীদ হন আদিবাসী নেত্রী রাশিমণি। অধিকার প্রতিষ্ঠা ও একজন নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে তার এ আত্মত্যাগ আজও তাকে অমর করে রেখেছে। সেজন্য কবি রফিক আজাদ তার ‘মাতা রাশিমণি’ কবিতায় লিখেছেন_
রাশিমণি একটি নাম, জীবন-সমান দীর্ঘ নাম;
দেশবাসী, জানাও তোমরা তাঁকে সহস্র প্রণাম।
রাশিমণি এই বিশাল বাংলায় একবারই জন্মানঃ
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গর্বিত শহীদ।

নারী হয়ে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে জীবন দিয়ে রাশিমণি আজ হাজংদের কাছে হাজংমাতা হিসেবে পরিচিত। তারই স্মৃতি রক্ষার্থে দীর্ঘ ৫৮ বছর পর দেশের বিভিন্ন সুশীল ও গুণীজনদের উদ্যোগে ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বহেরাতলী গ্রামের তাঁর মৃতু্য সংলগ্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে ‘শহীদ হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ’ যা হাজং বিদ্রোহের অন্যতম সাক্ষী হিসেবে পরিচয় বহন করছে। হাজং আদিবাসী ও রাশিমণির অনুসারীরা তাই প্রতিবছর এ দিনটি আসলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করে থাকেন। এ দিনে তোমাকে জানাই সালাম।

Back to top button