জাতীয়

রাঙ্গামাটিতে জনসংহতি সমিতির ১৩ এবং ১৪ জুন ৩৬ ঘন্টা অবরোধের ডাক

রাঙামাটি প্রতিনিধিঃ “বিজিবি, স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃত্বসহ রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার সবাই এই মিথ্যা ও প্রহসনমূলক নির্বাচনে যুক্ত ছিল”- সন্তু লারমা
৯ জুন ২০১৬, সকালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা সদরস্থ জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির আহ্বানে জেলাধীন বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ছোট হরিণা কেন্দ্রে ২৫ বিজিবির সহায়তায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্তৃক কেন্দ্র দখল করে ভোট ডাকাতির প্রতিবাদে এবং পুনঃনির্বাচনের দাবিতে এক বিশাল গণসমাবেশের আয়োজন করা হয় এবং সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিলও বের করা হয়।
জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি সুবর্ণ চাকমার সভাপতিত্বে এবং শরৎ জ্যোতি চাকমার সঞ্চালনায় গণসমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরি সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। এছাড়া সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ভূমি ও কৃষি বিষয়ক সম্পাদক চিংলামং চাক, বরকল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মণি চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য উদয়ন ত্রিপুরা, ভূষণছড়া ইউনিয়নের মাওদ্দং মৌজার হেডম্যান দীপন দেওয়ান টিটো, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বাচ্চু চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি টোয়েন চাকমা প্রমুখ।
গণসমাবেশের সভাপতি ও জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি সুবর্ণ চাকমা ‘আগামী ১৩ জুন ২০১৬, সোমবার, ভোর ৬:০০ টা হতে ১৪ জুন ২০১৬, মঙ্গলবার, সন্ধ্যা ৬:০০ টা পর্যন্ত মোট ৩৬ ঘন্টা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় সড়ক ও জলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালিত হবে’ বলে ঘোষণা প্রদান করেন। তবে ‘রোগী বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স ও যানবাহন, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর যানবাহন, অগ্নিনির্বাপক যানবাহন, জরুরী বিদ্যুৎ সরবরাহ গাড়ি, সাংবাদিকদের বহনকারী গাড়ি ও জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত যানবাহন’ অবরোধের আওতার বাইরে থাকবে বলে ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়।
গণসমাবেশের প্রধান অতিথি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ছোট হরিণা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে লেঃ কঃ শাহাবুদ্দিন ফেরদৌসের নেতৃত্বাধীন ছোট হরিণা ২৫ বিজিবির সহায়তায় যে ভোট জালিয়াতি হয়েছে, কেন্দ্র দখল করে জালভোট দেয়া হয়েছে সেখানে রিটার্ণিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারগণ এবং মিলিতভাবে দীপঙ্কর তালুকদারের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বসহ সবাই এই জাতিয়াতি ও প্রহসনমূলক নির্বাচনে যুক্ত ছিল।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে এবং চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অচলাবস্থার মধ্যে থাকার কারণে যারা এ পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের ভিন্ন ভাষাভাষি পাহাড়ি জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে তারাই আজকে দীপঙ্কর তালুকদারের নেতৃত্বাধীন রাঙ্গামাটির আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ভূষণছড়ার অনুপ্রবেশকারীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় এবং ২৫ বিজিবির লেঃ কঃ শাহাবুদ্দিন ফেরদৌসের নির্দেশনায় ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদের ছোটহরিণা কেন্দ্রের নির্বাচনে ভোট ডাকাতি করে মামুনুর রশিদ মামুনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী উদ্যোগে আনীত ও পুনর্বাসিত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ভূমির উপর যাদেরকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদেরই একজন হচ্ছেন এই মামুন। ভূষণছড়া বরকল উপজেলার সবচেয়ে উর্বর জায়গা, সবচেয়ে জনবহুল জায়গা যেখানে দাঙ্গা করে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে জুম্ম জনগণকে উৎখাত করে সেখানে বসানো হয়েছে এই মামুনদেরকে। তিনি বলেন, আজকে সেটেলারদেরকে বাংলাদেশের সমতল অঞ্চলে পুনর্বাসন না করে তাদেরকে এখানে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করার ষড়যন্ত্র শুধু নয়, এই সেটেলারদেরকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সবক্ষেত্রে তাদেরকে সরকার প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। আজকে তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণকে তাদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের স্থলে এই বাঙালি সেটেলারদেরকে পুনর্বাসন দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা, তাদের জায়গাজমি বেদখল করা এবং তাদের শাসনতান্ত্রিক অংশীদারিত্ব হরণ করা।
তিনি বলেন, ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের ছোট হরিণা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে যে নির্বাচন এবং তার যে ফলাফল, নির্বাচনের যে প্রক্রিয়া ও পরিবেশ, সেটাই প্রমাণ করে যে পার্বত্য অঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতি কী বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, যতদিন না পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হবে ততদিন পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের বুকে সন্ত্রাস তথা শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়ন, অত্যাচার-অবিচার অব্যাহত থাকবে।
IMG_1282
শ্রী লারমা বিজিবির ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, ছোট হরিণা ২৫ বিজিবি জোন তাদের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখা, প্রয়োজনে দেশের স্বাথীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, পাশাপাশি জনগণের সাথে সংযুক্ত থেকে জনগণের কল্যাণার্থে তাদের ভূমিকা রাখার যে দায়িত্ব তা থেকে সরে এসে তারা সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সেবাদাস ও ক্রীতদাস হয়ে আওয়ামী লীগের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে, যা তাদের অর্পিত দায়িত্বের চরম বরখেলাপ।
গণসমাবেশের সভাপতি সুবর্ণ চাকমা আরও বলেন, ভূষণছড়া ইউনিয়নে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে আমাদের চেয়ারম্যান প্রার্থী দীলিপ কুমার চাকমার বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, এটা মেনে নেয়া যায় না। আওয়ামী লীগ সরকার আজকে সারা দেশে ভোটের নামে যে অরাজকতা সৃষ্টি করছে সেটা অবশ্যই প্রতিবাদ করা দরকার।
বরকল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মণি চাকমা ও মাউদং ইউনিয়নের হেডম্যান দীপেন দেওয়ান টিটো বলেন, বিজিবির সহায়তায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সেটেলার বাঙালিদের ভোট ডাকাতির ঘটনার তারা প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিকটিম। তারা বলেন, বিজিবি সদস্যরা পাহাড়ি ভোটারদের আইডি কার্ড চেক করা ও মোবাইল ফোন জব্দ করার নামে পাহাড়িদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান করে। তাদের উপস্থিতিতে সেটেলাররা লাঠিসোটা নিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেন। দীপেন দেওয়ান বলেন, বিজিবি সদস্যরা তাকে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়নি। ফলে তিনি সেদিন ভোটদান থেকে বঞ্চিত হন বলে জানান।
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, ভূষণছড়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ছোট হরিণা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের এই ভোট ডাকাতি ও জালিয়াতির নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ঐ কেন্দ্রে অবিলম্বে পূনঃনির্বাচন ঘোষণা করা না হলে রাঙ্গামাটি জেলার এই সড়ক ও জলপথ কর্মসূচি আরও জোরদার করা হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জেলায়ও এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া হবে।
সমাবেশ শুরু হওয়ার পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির পক্ষ থেকে জনস্বার্থে জরুরী ভিত্তিতে বরকল উপজেলাধীন ৪নং ভূষণছড়া ইউনিয়নের ছোট হরিণা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিল করা এবং অচিরেই উক্ত কেন্দ্রে পুন:নির্বাচনের জন্য জোর দাবি জানিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার জেলা নির্বাচনী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিকট এক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।

Back to top button