মতামত ও বিশ্লেষণ

বিপ্লবের দাগ ও আদিবাসী বুদবুদ : পাভেল পার্থ

চায়ের পেয়ালায় রক্তের দাগ

বঞ্চিত চা শ্রমিকদের সংগঠিত করার দায়ে ১৯৭২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্ধুরখান চা বাগানের কিশোর বসন্ত বুনারজীকে নির্মমভাবে হত্যা করে বাগান মালিক পক্ষের লোকজন। বসন- বুনারজী তখন শ্রীমঙ্গলের ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৭৮ সনে বাংলাদেশ চা সংসদ ও মালিক পক্ষের নির্ধারিত চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র অনুযায়ী চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য দৈনিক মজুরী নির্ধারন করা হয় মাত্র ৮.৫০ টাকা। বাংলাদেশের চা বাগানের অলিখিত সর্দার ব্রিটিশ বহুজাতিক কোম্পানি জেমস ফিনলে হঠাৎ করে শর্ত আরোপ করে যে, তিন মণ চা পাতার বোঝা একবারে মাথায় বহন না করতে পারলে মজুরী কমিয়ে ৪.৫০ টাকা করা হবে। মালিক পক্ষের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নারী চা শ্রমিক নেতা দামিনী গোয়ালা নিপীড়িত শ্রমিকদের সংগঠিত করেন এবং চা শ্রমিকদের আন্দোলন দমাতে বাগান কর্তৃপক্ষ নির্বিচারে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বন্দুক। ১৯৮৩ সালের ৬ জুলাই চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে রাষ্ট্রের বন্দুক বাহাদুরিতে জান দেন বংশী গঞ্জু। বসন্ত বুনারজী, দামিনী গোয়ালা কি বংশী গঞ্জু রাষ্ট্রের অন্যায় বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ন্যায়বিচারের রক্তবুদবুদ। দিন যায়, চাবাগানে রাষ্ট্রের চাইতেও মাতবর হয়ে ওঠে বহুজাতিক কোম্পানি। বাংলাদেশের ভূমির সার্বভৌমত্ব চাবাণিজ্যের নামে একতরফা নিয়ন্ত্রণে রাখছে এসব কোম্পানি। তৈরি করেছে খাসি ও চাশ্রমিকদের ভেতর এক পাতানো বিরোধের খেলা। ভূমি বাঁচাতে আবারো জান দিতে হয় মৌলভীবাজারের জুড়ীর ফুলতলা চাগান শ্রমিক অবিনাশ মুড়া ও শ্রীমঙ্গলের টিপরাছড়া চা বাগানের নিতাই তাঁতীকে। স্থায়ী মাটি, শ্রমিক ইউনিয়ন আর ন্যায্যমজুরির দাবি এখনও চাবাগানে টগবগ করে ফুটছে। প্রতি পেয়ালা গরম চায়ের চুমুকে সেই রক্তজয়ী ঝাঁঝ মিশে যাচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ন্যায্যতার সম্মান সুরক্ষায় বাংলাদেশের চাবাগানগুলো এখনো নির্ঘুম, এখনো টানটান।

তারুণ্যের মাদল বাজছে

১৮৫৫ সনে সংগঠিত হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহের মহানায়ক ফুলমণি মুরমু ও জানকী বা জানমণি মুরমু। এ দু’বোন তাদের চারভাই সিধো মুরমু, কানহু মুরমু, চাঁদ মুরমু, ভায়রো মুরমুদের নিয়ে জমিদারি শোষণ আর ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বাজিয়েছিলেন দুন্দুভি দামামা মাদল। সেই মাদলের ডাক তেভাগা আন্দোলনেও শোনা গিয়েছিল বরেন্দ্র ভূমির বিপ্লবী সাঁওতাল-ওঁরাও-মুন্ডা-পাহান-কর্মকার-রাজবংশী-মাহালী কোল-শবর জাতিদের তারুণ্যের ঝলকানিতে। জমিদারী আমলের কৃষি উৎপাদন বন্টন বিষয়ক অন্যায় তেভাগা ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে সংগঠিত গণআন্দোলনের পয়লা শহীদ শিবরাম মাঝি মুরমু আমাদের আবারো জানিয়ে দিয়ে গেছেন তারুণ্যের কি ঝাঁঝ, নিপীড়িতের কি শক্তি। হুলের সাহসী উত্তরাধিকার সাগরাম মাঝি (হাঁসদা) ১৯০১ সনে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার সাঁওতাল জনপদে জন্মগ্রহণ করেন। সারাজীবন যিনি উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য -জীবনমান উন্নয়নে এবং আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য কাজ করে গেছেন। ১৯৫৪ সনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সাংসদ নির্বাচিত হন। আদিবাসী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৫৬ সালে রাজশাহীর সাগরপাড়ায় গড়ে তোলেন আদিবাসী ছাত্রাবাস। ১৯৫৭ সালে স্থানীয় সরকার কাঠামোর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালের সামপ্রদায়িক দাঙ্গার সময় উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের জান দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করেন। ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রেরণা যোগান। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের শিক্ষা আন্দোলনে তাঁর অনন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। বটতলী, মধুমাঠ ও শীতলপুর আদিবাসী এলাকায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পানিহারা পাঠাগার তৈরী হয় তারই উদ্যেগে। রাজশাহীর বরেন্দ্র যাদুঘরে তারই চেষ্টায় সংরক্ষিত হয় আদিবাসী জীবনের নিদর্শনগুলো। নওগাঁর মহাদেবপুরের ভীমপুরে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সংগ্রামী নেতা আলফ্রেড সরেন জানবাজী রেখে বাঙালি ভূমি ছিনতাইকে প্রশ্ন করে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট ভূমি আন্দোলনে তিনি শহীদ হন।

দুবির্নীত ইনাফি ও স্পর্ধিত আদুরি

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ভানুবিল মৈতৈ মণিপুরী গ্রামের লীলাবতী সিংহ তারুণ্যের ইনাফি (মৈতৈ মণিপুরী নারীদের নিজস্ব তাঁতে বোনা কাপড়) উড়িয়ে যেমন প্রশ্ন করেছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশের বলপ্রয়োগকে, নেত্রকোণার দূর্গাপুরের বহেরাতলী হাজং গাঁওয়ের রাশিমনি হাজং কি কুমুদিনী হাজং নারীরাও তারুণ্যের দ্রোহী জাখা ( হাজং নারীদের হাতে বোনা বাঁশের তৈরী মাছ ধরার উপকরণ, হাজং নারীরা দলবদ্ধ ভাবে জাখা নিয়ে মাছ ধরতে যান এবং জাখামারা গীত বলে হাজং নারীদের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ গীতের প্রচলন আছে) দিয়ে ধরতে চেয়েছিলেন পুরুষতান্ত্রিক ব্যাবস্থার জুলুম ও চোখরাঙানিকে। ২০০১ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে বাঙালি ভূমি দখলদারির বিরুদ্ধে গীদিতা রেমা যখন বাজিয়েছিলেন তারুণ্যের আদুরি ( মহিষের শিঙ-বাঁশ-দড়ি দিয়ে তৈরী মান্দিদের একধরনের বাদ্যযন্ত্র) তখন ভূমিদখলকারীরা ২০ মার্চ তারিখে গীদিতা রেমাকে হত্যা করলেও আদুরির দ্রোহ থামাতে পারেনি। ১৯৬২ সন থেকেই মধুপুর শালবনে রাষ্ট্র প্রশ্নহীনভাবে তৈরী করে মধুপুর জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্প। মধুপুর শালবনের আদিবাসিন্দা মান্দি-কোচ-বর্মণেরা রাষ্ট্রের প্রশ্নহীন নিপীড়নকে জোর কায়দায় প্রশ্ন করে জানবাজী রেখে রুখে দাড়িয়েছিলেন। ঠিক একই কায়দায় মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ড ও মুরইছড়া ইকেপার্ক, শেরপুরের মধুটিলা ইকোপার্ক ও গজনী অবকাশ কেন্দ্র এবং বান্দরবানের চিম্বুক ইকোপার্ক বাণিজ্যকে প্রশ্ন করছেন দেশের বননির্ভর ‌আদিবাসী জনগণ। পরবর্তীতে যখন রাষ্ট্র এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের টাকা খেয়ে মধপুর শালবন উপড়ে রাবার বাগান বানায় বা বনবিভাগ মধুপুর বনে যখন ইকোপার্ক করার নামে পুরো বন দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করার জন্য বন্দুক তাক করে তখনও বননির্ভর মান্দি-কোচ জনগণ রাষ্ট্রের বন্দুকের তলায় পেতে দিয়েছিলেন বনঅধিকারের দ্রোহ। ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি মধুপুরে আবারো বেজে উঠেছিল বনজীবনের আদুরি, রাষ্ট্রের হামলা থেকে শালবন বাঁচাতে বনবাসী তারুণ্য সাজিয়েছিল অধিকারের গ্রীকা (মান্দিদের বিদ্রোহী নৃত্য কৃত্য)। রাষ্ট্র সেই সাহসী গ্রীকার তারুণ্যকে অস্বীকার করতে পারেনি, তাই রাষ্ট্র তার ক্ষমতার ‘সবেধন নীলমনি’ কর্পোরেট অস্ত্র কোম্পানির বন্দুক দিয়ে ( আমাদের মাথায় রাখা জরুরী রেথিয়ন, হেলিবার্টন, জেনারেল ডিনামিক্স কোম্পানির অস্ত্র বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতেই চলতি দুনিয়ায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলতে বন্দুক বাহাদুরিকে বোঝানো হয়) হত্যা করে মান্দি বীর পীরেন স্নালকে, মেরুদন্ড ঝাঁঝরা করে দেয় অষ্টম শ্রেণীর কিশোর শিক্ষার্থী উৎপল নকরেকের। কিন্তু অবাধ্য নির্বোধ রাষ্ট্রের জানা আছে কি না জানি না, উৎপল নকরেকদের মেরুদন্ড ঝাঁঝরা করে দিলেও উৎপল নকেরেকদের মেরুদন্ডের সাহসী বিপ্লব থেমে যায় না। টাঙ্গাইলের মধুপুরের বেরীবাইদ গ্রামের উৎপল নকরেক এখনও হুইল চেয়ারে বসে থেকেই বনবিভাগের বননিশ্চহ্নকরণ প্রক্রিয়ার বিরোধীতা করে, এখনও প্রশ্নহীন ইকোপার্ক স্থাপনের আন্দোলনে সামিল রাখতে চায় নিজেকে সমানভাবে।

জলপাই ঠুলি ও নিখোঁজ কল্পনা চাকমা

১৯৬২ সালে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙামাত্যার (স্থানীয় চাঙমাদের উচ্চারনে রাঙামাটি) হর্ণফুলী গাঙে (স্থানীয় চাঙমাদের উচ্চারনে কর্ণফুলী নদী) অন্যায়ভাবে রাষ্ট্র স্থাপন করে ‘কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প’ ব্রিটিশ উপনিবেশের পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয় জুলুমের আরেক মাত্রা। জুমের পর জুম, জংগলের পর জংগল, জমির পর জমি থেকে উদ্বাস’ হতে হয় প্রায় এক লাখ মানুষকে। একতরফা কর্তৃত্ববদী উন্নয়নর ফলে ইতিহাসের সবচে বড় উদ্বাস্তুকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে পার্বত্য জাতিরাই রাষ্ট্রের সামনে মেলে ধরেছিলেন দ্রোহের গেংখুলি ( চাঙমাদের ঐতিহ্যবাহী গীত)। আর এই দ্রোহের কেন্দ্রীয় শক্তি ছিল চাঙমা-ম্রাইনমা(মারমা)-ত্রিপুরা-বম-ম্রো-খিয়াং-পাংখোয়া-চাক-লুসাই-মিজো-তঞ্চংগ্যা-খুমিসহ পাহাড়ের সকল প্রান্তিক জাতির দিনবদলের তারুণ্য। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রথম সাংগঠনিকভাবে রাষ্ট্রে ‘জাতীয়তার রাজনৈতিক’ তর্ক হাজির করে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আদিবাসীদের উপর নিদারুণ বাঙালি জাত্যাভিমানকে প্রশ্ন করেছিলেন। ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর থানার বুড়িঘাট মৌজার মাওরুম (বাঙালিরা যে গ্রামের নাম দিয়েছে মহাপুরম) আদামে (চাকমা ভাষায় গ্রামবসতি মানে আদাম) জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে এই গ্রামজনপদ কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের কৃত্রিম বাঁধের তলায় ডুবে গেছে। ১৯৬০ সনে পাহাড়ি ছাত্র সমাজের নেতৃত্বদানের পাশাপাশি ১৯৬১ সনেই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে দেশের সকল জাতিদের একত্রে ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে গণপরিষদ অধিবেশন বর্জন করেন। ১৯৭৩ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভোররাতে পার্টির আটজন নেতা সহ নির্মম ভাবে নিহত হন। কিন’ নিহত হয় না পাহাড়ের দুর্বিনীত জুম জমিনের দ্রোহী স্রোত। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশ্নহীন সেনাবাহাদুরি আর উন্নয়নের বলপ্রয়োগকে জানবাজী রেখে প্রশ্ন করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন থেকে রাষ্ট্র কর্তৃক নিখোঁজ হয়ে আছেন কল্পনা চাকমা। লড়ছে পাহাড়, প্রতিদিন সাথে নিয়ে অগণিত স্পর্ধিত রক্তকুসুম।

সত্যবানের পাহাড় আর চীনামাটির বাসন

নেত্রকোণার সুসং রাজার অন্যায্য হাতি বাণিজ্যের বিরোধীতা করে গড়ে উঠা হাজংদের হাতি খেদা আন্দোলনের নেতা মনা সর্দারকে সুসং রাজা হাতির পায়ের তলায় পিষে মেরেছিল। তবুও মনা সর্দার সুসং রাজার কাছে হার মানেননি। টংক প্রথার বিরুদ্ধে সম্মিলিত হাজং বিদ্রোহকে ব্রিটিশ সরকারের বন্দুক ঠেকাতে পারেনি। ব্রিটিশ সরকারের ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর সশস্ত্র কবল থেকে রাশিমণি হাজং, সুরেন্দ্র হাজংরা জান দিয়ে রক্ষা করেছিলেন কুমুদিনী হাজংকে। রাশিমনি আর মনা সর্দারদের উত্তরাধিকার সত্যবান হাজংও চেয়েছিলেন আবার হাজং গ্রামে গ্রামে হাজং কৃষির অধিকার ফিরে পাবে হাজংয়েরা। আর কোনো পাহাড় জংগল কেউ চীনামাটির জন্য কারখানায় বিক্রি করে দেবেনা। আবারো পাহাড় টিলায় হাজং শিশুরা খুঁজতে যাবে বনফল বা আদরের পাখিদের। গ্রামে গ্রামে কেউ দিনমজুর থাকবে না , ঢিং-লেবাহাক-আংসাভাত-বিশিভাত-খিসকী-ছিপিঠা-পুনিপিঠা-দিক্রিপিঠা-খারপানি বানানোর ধূম পড়বে হাজং সমাজে। আর কোনো হাজং কিশোরী বা পুরুষ পেটের জ্বালায় নিজের গ্রাম ছেড়ে শহরে বাঙালি বাড়িতে চাকর বা দারোয়ান হবে না। সত্যবান স্বপ্ন দেখেছিলেন হাজং গ্রামে গ্রামে শিশুরা হাজং ভাষায় পড়ালেখা করবে। হাজং শিশুরা বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, মানুষের সমঅধিকারের আন্দোলনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করবে। হাজং সমাজের নতুন প্রজন্মই হাজংদের লড়াইয়ের ইতিহাস দুনিয়ার সকলের সামনে তুলে ধরবে। লেওয়াতানা গীত, জাখামারা গীত বানবে হাজং নারীরা। আবার হাজং নারীদের তাঁতে তাঁতে বোনা হবে স্বপ্নের পাথিন। সত্যবান স্বপ্ন দেখেছিলেন আবারো রাষ্ট্র মেনে নিবে হাজং সমাজের আপন রীতি কানুন ব্যাবস্থা, গ্রামে গ্রামে গাঁওবুড়াদের মান্য করবে সবাই। চাকলা, পরগণার সরমড়ল আর রাজাদের নিয়েই গঠিত হবে হাজং এলাকার স্থানীয় সরকার। বিরিশিরি ‘ উপজাতীয় কালচারাল একাডেমীর’ নাম পাল্টে রাখা হবে বিরিশিরি আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমী বা হাজং-মান্দি-কোচ-ডালু-বানাই ভাষার কোন সম্মিলিত নাম। কিন্তু ২৩ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে বাঙালিদের একটি গং হত্যা করে সত্যবানকে। এভাবেই বাংলাদশের তিরিশ লাখ ৪৫ কি তারও কম বেশী নিপীড়িত আদিবাসী জনগণের বঞ্চিত ধনুকের টান টান ছিলায় বারবার ঝলসে উঠেছে দ্রোহ ও দাহের তারুণ্য। উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র ভূমি, বৃহত্তর সিলেটের চা বাগান-পানপুঞ্জি-বন-টিলাভূমি, মধুপুরের শালবন, ভাওয়াল গড়, পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপক’লীয় জনপদ, দক্ষিণবঙ্গ কি গারো পাহাড়ের পাদদেশে নিপীড়িত আদিবাসী জনগণই বিরাজিত রেখেছেন বাংলাদেশের গণমানুষের শ্রেণীসংগ্রামের লড়াকু ইতিহাস। কাল থেকে কালে, নিরন্তর, প্রতিদিন প্রতিরাত।

লড়াইয়ের উত্তরাধিকার

চলতি কায়দার অধিপতি ইতিহাসে নিপীড়িত আদিবাসী জনগণের ইতিহাস আজো স্বীকৃত এবং নথিভুক্ত নয়। অথচ আদিবাসীরা কাল থেকে কালে নিজের বুকের রক্ত ঢেলে জুলুম আর দখলদারি থেকে চিহ্নিত করেছেন এই রাষ্ট্রের বিদ্যমান ভূগোল এবং দেশের বৈচিত্র্য বৈভবের সুরক্ষার সীমানা। ইতিহাসের পাঠ ও প্রক্রিয়া গড়ে উঠেছে যে আদিবাসী তারুণ্য শক্তির ভেতর দিয়ে সেই আদিবাসী তারুণ্যকেই আজ দিনবদলের তুমুল আওয়াজ তুলতে হবে ধারাবাহিক দ্রোহের মাদল দিয়ে। কারন পূর্বসূরীদের রক্তের দাগ লেগে আছে এই মাদলের অন্তর বাহির জুড়ে। নিপীড়িত জনতার আহাজারি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এই মাদলের অস্থিমজ্জায়। আদিবাসী নারী পুরুষ তারুণ্যকেই নিম্নবর্গের এই অপ্রতিরোধ্য মাদল বয়ে নিয়ে যেতে হবে সকল চোখরাঙানি ও জুলুমের সামনে। প্রশ্ন করতে হবে সকল কর্তৃত্ব ও অধিপতি প্রক্রিয়াকে। আদিবাসী সমাজের যে অংশ এখনও জুম কি কৃষি করে, মাছ ধরে, শিকার করে, বনজদ্রব্য সংগ্রহ করে, খাদ্য কুড়িয়ে, জ্বালানি সংগ্রহ করে, তাঁত বোনে, গৃহস্থালী উপকরণ নির্মান করে, কুটিরশিল্প করে ধরে রেখেছেন সভ্যতার চলমানতা সবার আগে সেই লড়াকু জনতার যাপিতজীবন থেকেই চিনে বোঝে নিতে হবে শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব-বাহাস-নির্দেশনা ও রাজনৈতিক সূত্রসমূহ। বহিরাগত কোনো ধারণা বা চিন্তাসূত্র দিয়ে নিম্নবর্গের মুক্তি সম্ভব নয়। কারন বহিরাগত সকল ধারণাতেই একধরনের অধিপতি ঝাঁঝ ও চোখরাঙানির প্রলেপ থাকে। নিম্নবর্গের যাপিতজীবনের ভেতরেই বিরাজিত আছে নিম্নবর্গের মুক্তির নির্দেশনা এবং শ্রেণীবিপ্লবের কারিগরী। আদিবাসী তারুণ্যকে আজ জোরোসোরে তাকাতে হবে নিম্নবর্গের সেই অপ্রতিরোধ্য যাপিতজীবনের দিকেই। কারণ এখানেই মজবুত আছে লড়াইয়ের উত্তরাধিকার ও বিপ্লবের গণিত।

সিধো মুরমু-কানহু মুরমু-চাদ মুরমু-ভায়রো মুরমু-ফুলমণি মরমু-জান মুরমু-বীরসা মুন্ডা-জীবন সাঁওতাল-শিবরাম মাঝি-কম্পরাম সিং-লীলাবতী সিংহ-নীরা বাউড়ি-বসন্ত বুনারজী-গীদিতা রেমা-মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা-রাশিমনি হাজং-কুমুদিনী হাজং-অবিনাশ মুড়া-সত্যবান হাজং-সাগরাম মাঝি-সুশীল মুন্ডা-বংশী গঞ্জু-চলেশ রিছিল-কুশ পাহাড়িয়া-কল্পনা চাকমা-অধীর দফো-আলফ্রেড সরেন-কাকেত হেনইঞতা-অজিত রিছিল-দামিনী গোয়ালা-জনিক নকরেক-পীরেন স্নাল-চলেশ রিছিল-নিতাই তাঁতীরা সমাজে যে বিপ্লবী তত্ত্ব ও ধারণা বইয়ে দিয়ে গেছেন আজ আদিবাসী তরুণ সমাজকে সেই তত্ত্ব এবং চিন্তাসূত্র সমূহ ঘেটে বেছে দেখতে হবে। এখান থেকেই শ্রেণী সংগ্রামের রাজনৈতিক ধারা এবং কর্মপ্রক্রিয়া নির্ধারন করা জরুরী হবে। নিম্নবর্গের দ্রোহের ভেতরেই বিরাজিত আছে শ্রেণীবিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল। সেইসব নীতি ও কৌশলকে পাঠ করতে এবং বুকের ভেতর সেই দ্রোহ ধারণ করতে না পারলে কোনোভাবেই জুলুমবাজ রাষ্ট্রকে ফানাফানা করে প্রশ্ন করা যাবে না। চিহ্নিত করা যাবে না দাপট ও ক্ষমতার অধিপতি উৎস ও আচরণগুলোকে। অর্জিত হবে না বহুপাক্ষিক মুক্তি ও সুরক্ষিত হবে না আপন সীমানা।

পাভেল পার্থ। লেখক ও গবেষক, ই-মেইল : [email protected]

Back to top button