অন্যান্য

বাস্তব ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে

পার্বত্য চুক্তি পূর্নাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বাস্তব ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। চুক্তি বাস্তবায়ন সরকারকে করতেই হবে। চুক্তির পূর্বে আমরা দীর্ঘ দুই দশক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছি। চুক্তির পরেও ২০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে থামানোর জন্য শাসক শ্রেনী অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু জুম্ম জনগণ যেকোন মূল্যে শাসকদের সে উদ্দেশ্যকে সফল হতে দিবেনা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর এবং নতুন প্রজন্মের ভাবনা শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সমাপনী বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এসব কথা বলেন। মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আজ সকালে ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে অলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এসময় সন্তু লারমা আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য আজ থেকে ২০ বছর আগে যে চুক্তি হয়েছিল সেটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সেখানকার সমস্যা আজো মেটেনি। বিভিন্ন সরকারের আমলে চুক্তির বিপক্ষে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে সেগুলোর কারণে আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে চরম অস্থিশীলতা কাজ করছে। পাহাড়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে পিছনে যাওয়ার আর জয়াগা নেই। আজকের নতুন প্রজন্ম পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছেন যা পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

পাবর্ত চুক্তি বাস্তবায়নে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ১০ দফার ভিত্তিতে যে অসহযোগ আন্দোলন হচ্ছে সেটি অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি জানান। পাশাপাশি তিনি দেশের সুশীল সমাজসহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষকে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে আরো বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নেই। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার চুক্তি করলেও তারাও এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক নয়। গত ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চুক্তির ২০ বছর উদযাপন করেছেন, তার অনুসারীরা দিনটিতে আনন্দ করেছেন। কিন্তু পাহাড়ী আদিবাসী জীবনে কি আনন্দ আছে? যদি সরকার সত্যিই চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন সেনা শাসন এখনো অব্যাহত আছে?

আলোচনায় নতুন প্রজন্মের সাথে সাথে যেসব প্রবীনরাও তাদের ভাবনাগুলো তুলে ধরেন তারা হলেন: আব্দুল্লাহ আল কাফি, কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি; নজরুল কবীর, সাংবাদিক; শাকিল আহমেদ, হেড অব নিউজ, একাত্তর টিভি; গোলাম মোর্তোজা, সম্পাদক, সাপ্তাহিক; বিপ্লব রহমান, লেখক ও সাংবাদিক; দীপায়ন খীসা, তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; জান্নাত এ ফেরদৌসী, সাধারণ সম্পাদক, আরডিসি; ব্যারিস্টার সুব্রত পাল, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; তাসলিমা ইয়াসমিন, সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সাজেদুর রহমান সজীব, শিক্ষক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাগাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; জাহেদ হাসান সাইমন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন; অন্তরা বিশ্বাস, সাংবাদিক, নিউজ ২৪ টিভি; মানবেন্দ্র দেব, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন; সোহলে চন্দ্র হাজং, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ; হরেন্দ্রনাথ সিং, সভাপতি, আদিবাসী যুব পরিষদ; সুমন মারমা, সাধারণ সম্পাদক, পাহা; চন্দ্রা ত্রিপুরা, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরাম প্রমুখ। আলোচনা সভায় প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা।

সঞ্জীব দ্রং বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যারা অপেক্ষায় রয়েছে তাদের কাছে ২০ বছর দীর্ঘসময় কিন্তু যারা অপেক্ষায় রেখেছে তারা পারলে আরো ২০ বছর অপেক্ষায় রাখবে। সরকার পক্ষ মনে করে তারা আস্তে আস্তে করে যাচ্ছে, আরো সময় প্রয়োজন। সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে নতুন নতুন যে তথ্য দেয় সেগুলো শুনে আমরা আশ্বর্য্য হই। যেমন, চুক্তিতে বলা আছে ‘একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির দ্বারা পার্বত্য ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠত হবে।’ ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুতরাং চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ন ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। আদতে কি তাই, শুধু ভূমি কমিশন করেই কি পাহাড়ের আদিবাসীদের ভূমির সমস্যা মিটেছে। এইরকম অদ্ভুদ সংখ্যা নির্ভর তথ্য দিয়ে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের তথ্য বিভ্রাট ঘটাচ্ছে। আন্তরিকতার অভাব ও স্বদিচ্ছার অভাব আমরা দেখছি চুক্তি বাস্তবায়নে।

আব্দুলাহ আল কাফী বলেন, আমরা যারা উপজাতি শব্দ ব্যবহার করি তারা আসলে হীনমন্যতার পরিচয় দিই। ধরেন বাঙ্গালিরা যদি বিদেশে কোথাও গিয়ে সংখ্যালঘু হয় তাহলে কি সেখানে তাদের উপজাতি বলা হবে। তাহলে কেন আমরা পাহাড়ী আদিবাসীদের উপজাতি বলবো। বাংলাদেশ যে বহু জাতির দেশ এটা আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সেইভাবে আদায় করতে পারিনি। এমনকি স্বাধীন দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এদেশের অপরাপর আদিবাসী জাতিদের স্বীকৃতি দিতে পারেননি। বরং তিনি তাদের বাঙ্গালি হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।

শাকিল আহমেদ বলেন, ২০ বছর আগে যে লড়াই পাহাড়ে হয়েছিল সেটা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। শান্তি চুক্তির মাধ্যমে সেটি প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছেনা এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে জাতাভ্যিমান ও অবিশ্বাস। চুক্তি বাস্তবায়নে গবেষনাধর্মী কাজ ও আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে চুক্তির সকল ধারা বাস্তবায়ন করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আজকে সারাবাবিশ্বেই উগ্রবাদ দেখা যাচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে যাদের সংখ্যাধিক্য আছে তারা অন্য ধারা বা মতকে গ্রহণ করতে পারছেনা। বাংলাদেশেও সেটির ব্যতিক্রম হচ্ছেনা। তবে আমরা নিশ্চয় এমনটা চাইবোনা।

গোলাম মোর্তোজা বলেন, চুক্তির বাস্তবায়ন যাতে করতে না হয় সেজন্য সরকার বা নিয়ন্ত্রকরা খুব সফলভাবেই পাহাড়ীদের বিভক্ত করতে পেরেছে। বিভিন্ন দলের আবির্ভাব হয়েছে। এখন এই বিভক্তির রাজনীতির মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তিতে নস্যাৎ করার চেষ্টা চলছে যা নতুন প্রজন্মকে বুঝতে হবে।

নজরুল কবীর বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে অর্জিত এই রাষ্ট্রের যে চরিত্র হওয়ার কথা ছিল আজকে সেই চরিত্র রাষ্ট্রের মধ্যে অনুপস্থিত। এমনকি আওয়ামীলীগ এর মতো দল ক্ষমতায় থাকার পরেও। রাষ্ট্রের চরিত্র যতদিন বদলাবে না, ধর্মীয় উগ্রবাদ, সেনাবাহিনী নির্ভরতা রাষ্ট্র চরিত্র থেকে যতদিন দূর হবেনা ততদিন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হবেনা। তাই শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয় এর বাইরেও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের চরিত্র যেভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদে চলে যাচ্ছে সেভাবে চলতে থাকলে এই রাষ্ট্র থেকে খুব ভাল কিছু সহজে আশা করা যায়না।

Back to top button