বান্দরবানে ঝিরির পাথর দিয়েই হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প: ‘উন্নয়নই’ ডেকে আনছে সংকট
সতেজ চাকমাঃ বান্দরবানের বিভিন্ন ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলনের ঘটনা অনেক পুরোনো। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই পার্বত্য জেলাটির বিভিন্ন ঝিরি থেকে এত বিপুল পরিমাণ পাথর উত্তোলন করা হয়েছে, যা হাইকোর্ট পর্যন্তও গড়িয়েছে। তারপরেও থামেনি ঝিরি-ঝরনা থেকে অবাধে পাথর আহরণ। ফলে মরছে ঝিরি-ঝরনা এবং হুমকির মুখে পড়েছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘৭১ টিভি’ প্রচারিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় সেই সময় বান্দরবানের থানচি থেকে প্রতিদিন ১০ হাজার ঘনফুট পাথর উত্তোলন করা হচ্ছিল। পরিণতিতে সে সময় প্রায় চারশত ঝিরি মরে গেছে। ঝিরি-ঝরনা থেকে পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে বান্দরবানে স্থানীয় আদিবাসীরা যেমন বিভিন্ন সময়ে নানান জায়গায় মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তেমনি জাতীয় পর্যায়েও কম প্রতিবাদ হয়নি। ২০১৯ সালে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও কাপেং ফাউন্ডেশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট পাথর উত্তোলনকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমূহকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন। কিন্তু তারপরও পাথর উত্তোলন থামেনি। বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমেই বেশি পাথর উত্তোলন করা হয়। এর সঙ্গে আছে ‘উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের একটি নিবিড় সম্পর্ক। দেখা যায় যে, এযাবৎ পর্যন্ত বান্দরবানে সড়ক তৈরির কাজে এবং বিভিন্ন ভবন তৈরির প্রকল্পে প্রয়োজনীয় সমস্ত কংক্রিটের যোগান দেয়া হয়েছে স্থানীয় ঝিরি-ঝরনা থেকে পাথর উত্তোলন করে।
অন্যদিকে জাতিসংঘের কনভেনশন অব বায়োলজিক্যাল ডাইভ্যারসিটি (সিবিডি) গত জুনে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জীববৈচিত্র্য সম্মেলনে ‘এ নিউ গ্লোবাল ফ্রেমওয়ার্ক ফর ম্যানেজিং ন্যাচার থ্র ২০৩০’ প্রকাশ করেছে যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রকৃতির সঙ্গে সৌহার্দ্য নিয়ে জীবনধারণের পর্যায়ে পৌঁছানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কোন পথে হাঁটছে তা যথেষ্ট ভেবে দেখবার বিষয়।
পাথর উত্তোলনের ফলে যা হচ্ছে :
সম্প্রতি থানচি উপজেলায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় যে, যেখানে নতুন সড়ক তৈরি হয়েছে তার আশেপাশের ঝিরি থেকেই উত্তোলন করা হয়েছে পাথর। এ প্রসঙ্গে থানচি উপজেলার উন্নয়ন কর্মী সিনিয়া ম্রো বলেন, ২০০৬ সালে নির্মিত ৩২ কিলোমিটারের থানচি-আলীকদম সড়ক, ২০১৪ সালে নির্মিত থানচি উপজেলা পরিষদ ভবন, চলমান আলীকদম-কুরুকপাতা সড়ক, আরেকটি চলমান প্রকল্প থানচি-লিক্রি সড়ক, রোয়াংছড়ি- রুমা সংযোগ সড়ক, থানচি-বড়মোদক-আলীকদম সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে প্রয়োজনীয় সমস্ত কংক্রিটই ব্যবহৃত হচ্ছে স্থানীয় ঝিরিগুলোর পাথর।
এসব ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে তৈরি হচ্ছে নানা সংকটের। এ প্রসঙ্গে থানচি উপজেলার ৩৭৩ নং পর্দ্দ মৌজার হ্যাডম্যান হাপরু ম্রো (৭০) আইপিনিউজকে বলেন, “ঝিরিতে পাথর ন্ থাকিলে শামুক নাই, ক্যাকড়া নাই, মাছ নাই, ইশা মাছ নাই।” মূলত হাপরু হ্যাডম্যান পাড়ার মানুষ যে ঝিরির পানির ওপর নির্ভর করে টিকে আছে তার উজানের রাম-অ ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়েছে যা চলমান থানচি-লিক্রি সড়ক নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, “এখন ঠান্ডা পানি গরম ওয়ে, অল্প বৃষ্টি অইলে পানি ঘোলা হয়। ঝিরির পানি দূষিত আর খাইত ন্ পারে।” (অর্থাৎ এখন ঠান্ডা পানি গরম হচ্ছে, অল্প বৃষ্টি হলে পানি ঘোলা হয়। ঝিরির পানি দূষিত হচ্ছে আর খাওয়া যাচ্ছে না।)
থানচি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে হাপরু পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় ২৫ পরিবারের পানির যোগান দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে দু’মাস আগে একটি পানির কল বসানো হয়েছে। এই কলের পানি আসে ৮৫০০ ফুট দূরত্বের একটি ঝিরি থেকে। তবে স্থানীয় ইউপি সদস্য কৃখেন ম্রো বলেন, “এখন হয়ত বর্ষাকাল বলে কিছু পানি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু গ্রীষ্মকালে ও শীতকালের শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না। ফলে অনেক কষ্টে দিন কাটাতে হয়।”
ইউপি সদস্য কৃখেন ম্রো আরো বলেন, “পাথর না থাকার ফলে পানি যেমন ঘোলা হচ্ছে, তেমনি পানিতে এক ধরণের লাল আস্তরণও পড়ছে এবং যার ফলে অনেকেই নানা চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।”
রুতই ম্রো (৫৫) নামের হাপরু পাড়ার এক ম্রো নারী বলেন, “গ্রীষ্মকালে অনেক দূর থেকে পানি নিয়ে আসতে হয়। প্রায় ২-৩ কি:মি: উঁচু নিচু পথ হেঁটে পানি নিয়ে আসা লাগে। তবুও ভালো পানি পাওয়া যায় না।”
এদিকে একই জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলায়ও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও পানির সংকটে আছে অনেক পাড়া। ৩৩৮ নং রোয়াংছড়ি মৌজার লুংলাই বম পাড়ার কার্বারী (গ্রাম প্রধান) মুনলাই বম বলেন,”আমার পাড়ায় এখন পানির সংকট তীব্র। এখানে খাবার পানির সংকট তো আছে সেই সাথে নিত্য ব্যবহার্য পানি পর্যন্ত মিলছে না। পানির অভাবে গ্রামের মানুষ সপ্তাহ পর পর গোসল করে। সারাদিন জুমের কাজ করে একটু শান্তিতে গোসল করবো তাও পায় না।”
এদিকে একই উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের সাংকিপাড়া’র খুমি আদিবাসীরা পানির তীব্র সংকটের কারণে পাড়া পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানা যায়। সুবিধামত জায়গা পেলে তারা নিজেদের পাড়া ছেড়ে চলে যাবেন বলেও জানা গেছে।
এদিকে ঝিরিগুলো থেকে পাইকারী হারে পাথর উত্তোলনের ফলে পানি যেমন কমে গিয়েছে তেমনি ঝিরিতে পাথর না থাকায় সুপেয় পানির উৎসগুলোও দূষিত হয়ে যাচ্ছে বলে জানান স্থানীয়রা। থানচি উপজেলার কয়েকজন কার্বারী জানান, গত জুনে থানচির য়ংনং পাড়া, মেনতাং পাড়া ও রাম-অ ঝিরি পাড়ায় একসাথে ৯ জন ম্রো ডাইরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সুপেয় পানির অভাবে এসব হচ্ছে বলেও মনে করেন তারা।
এদিকে বান্দরবানে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী ম্রো’দের মধ্যে প্রকৃতি পূজারীর সংখ্যাও কম নয়। ম্রো’দের আদি ধর্ম ক্রামা ছাড়াও রয়েছে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং প্রকৃতি পূজারী। এর মধ্যে থানচি’র চমি পাড়ার প্রকৃতি পূজারী স্থানৗয় ম্রো আদিবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের বেদনার কথা। পাড়ার কার্বারী রেংপুন ম্রো বলেন, “আমরা যারা প্রকৃতি পূজা করি, তারা ঝিরি ও ছড়াতে এক ধরণের পূজা দিই। ঘরের কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে ‘সংফু’ নামের পূজা করি। এই পূজা দিয়ে আমরা ঝিরি থেকে শক্তি নিই। আর আমাদের রোগ বালাই দূর হয়ে যায়। কিন্তু ঝিরি যেভাবে মরে যাচ্ছে এবং পানি না থাকলে কীভাবে এই পূজা দিবো। কার থেকে শক্তি নেবো আমরা।”
যা বলছেন বিশিষ্টজনরা:
বান্দরবানে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত প্রথম আলোর প্রতিনিধি বুদ্ধ জ্যোতি চাকমা বলেন, “পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু সংখ্যক সমতল ও নদী তীরবর্তী জায়গা ছাড়া প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভূপৃষ্ঠের পানির উপর নির্ভরশীল। পাহাড়ের অধিকাংশ জায়গা পাথুরে হওয়ায় মাটি খুঁড়ে ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়াটা দুষ্কর। তাই সারাবছর পাহাড়ের অধিবাসীদেরকে প্রাকৃতিক ঝিরি, ঝর্না, নদী, ছড়া, বিলের পানির উপর নির্ভর করতে হয়। কাজেই পাথর উত্তোলনের ফলে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ শুকিয়ে যাওয়ায় আদিবাসীরা অনেক অসুবিধার মধ্যে পড়ছে।”
তিনি আরো বলেন, “একদিকে প্রাকৃতিক বন উজার হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভূপৃষ্ঠের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ঝিরি-ছড়ার তলদেশে যে পাথর পানি ধরে রাখে সেটাও তোলা হচ্ছে। যার ফলে ছড়া-ঝিরি শুকিয়ে যাচ্ছে এবং বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সাথে মাটি এসে ছড়ার তলদেশ ভরে যাচ্ছে। ফলে ঝিরি শুকিয়ে গিয়ে ছড়াগুলো মরে যাচ্ছে। অনেক দুর্গম এলাকায় আদিবাসীরা পানি সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। অন্যদিকে ছড়ার পানি দূষিত হয়ে পানিসৃষ্ট নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।”
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পাবত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি জুমলিয়ান আমলাই বলেন, “প্রকৃতিকে যদি তার মত করে চলতে দেয়া না হয়, তাহলে এমন বিপযয় নেমে আসবেই। আগে শঙ্খ নদীতে বন্যা হত কিন্তু এখন এক মাথা পানি নাই। পানির স্তর কমে যাওয়ায় জুমের ধানও বেড়ে উঠতে পারছে না।” এছাড়া ‘যারা রক্ষক তারাই এখন ভক্ষক’ বলে প্রকৃতির উপর এমন বিপযয় এবং আদিবাসীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে মনে করেন এই আদিবাসী নেতা।
বান্দরবানের উন্নয়ন কর্মী লেলুং খুমী বলেন, “আদিবাসী উচ্ছেদের জন্য বেশি কিছু করার প্রয়োজন নেই। যেভাবে ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়েছে এবং চলমান রয়েছে তাতে পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আর পানি না থাকলে আদিবাসীরা আপনা-আপনিই দেশান্তরী হতে বাধ্য হবেন।” ‘তথাকথিত উন্নয়ন’ই আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করছে বলেও মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, “আমরা সবসময় বলছি যে- যে উন্নয়ন মানুষের জন্য নয়, সে উন্নয়ন আসলে উন্নয়ন না। সে উন্নয়নে প্রকৃতির উপর একদিকে বিপযয় নেমে আসে এবং অন্যদিকে স্থানীয় মানুষ খাপ-খাওয়াতে পারছে না। এতে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর মানুষের অভিগম্যতা ও অধিকারের জায়গাটি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।”
এটা শুধু পাহাড়ে হচ্ছে তা নয়, সমতলের আদিবাসী অঞ্চল শেরপুরে সাদা মাটি উত্তোলন এবং বালু উত্তোলনের ফলে বিপযয়ের সৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “এসব বিষয়ে দেখভাল করার জন্য জন্য যে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় আছে তাদের কিন্তু কোনো ধরণের তদারকি নাই। এমনকি কোনো ধরণের চিন্তা ও মনিটরিং এর জায়গা আছে বলে মনে করি না।”
পাথর উত্তোলন নিয়ে তিনি আরো বলেন, “সেগুলোতে হয়ত এমন বিষয় আছে যেখানে টেন্ডার আছে ২০ টন তোলার আর তারা উত্তোলন করছে দুই হাজার টন। কিন্তু এগুলোতে কোনো মনিটরিং নেই। যার ফলে স্থানীয় মানুষের যে বিপযয় সেটা নিয়ে প্রশাসনেরও কোনো স্টাডি (অধ্যয়ন) এবং কাযক্রম নেই। যে কারণে বিষয়গুলো ঘটছে।”
”সরকারের উন্নয়ন ডিসকোর্সের সাথে মানবিক যে উন্নয়ন ডিসকোর্স এর যে বিশাল পাথক্য আর প্রকৃতির উপর পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসী মানুষের যে জীবন ও বৈচিত্র্য তা না বোঝার কারণেই এসব সংঘটিত হচ্ছে” বলেও মনে করেনএই নৃবিজ্ঞানী। এছাড়া ‘সরকারের অতিমাত্রায় খামখেয়ালীপনার জন্যই স্থানীয় আদিবাসী জনগণ বেশি বিপযয়ের শিকার হচ্ছেন’ বলেও মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি’র নিবাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বালু ব্যবসায়ী, পাথর ব্যবসায়ী, ইট ভাটার মালিকরা আদালতের নিদেশ মানছে না। এর বড় কারণ হল তাদের কমকান্ডে প্রশাসনের যোগসাজশ। প্রশাসন আইনগতভাবে বাধ্য আদালতের নিদেশ মানতে এবং মানাতে। সেটা না হলে আমরা আবার আদালতের দ্বারস্থ হবো।”
This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International License.
The story has been produced with the support of Earth Journalism Network.