বান্দরবানে আতংক আর খাদ্য সংকটে ম্রো ও ত্রিপুরার ৩৯ পরিবার। সরেজমিন ২
বান্দরবান প্রতিনিধিঃ জুম চাষের ভূমি, সৃজিত ফলদ বাগান ও প্রাকৃতিক বন থেকে বাঁশ, কাঠ কেটে, শাকসবজি ও বিভিন্ন ফল সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ৩৯পরিবার। কিন্তু গত ২৬ এপ্রিল লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানীর লোকজন সেই ভূমি বেদখল করার উদ্যেশে জুম বাগানে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনে পাড়াবাসীর শ্বশান-কবর স্থান, ধানের জমি,ফলদ বাগান, প্রাকৃতিক বন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এমনকি ছোট পাখির বাসাসহ প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যায় সেই সাথে লাংকম ম্রো পাড়া,জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়েন ম্রো পাড়ায় ৩৯পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎসও।
জয় চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার বৈসু রাম ত্রিপুরা (৪৭) বলেন ২৬এপ্রিল সকাল ১০টার সময় পাড়ার উত্তর দিকে ধোঁয়া দেখে সেদিকে গিয়ে দেখি আগুন। আর সেখানে ১০-১৫জনের লামা রাবার কোম্পানীর শ্রমিক। তাদেরকে আগুন কে লাগিয়েছে জিজ্ঞাসা করা হলে তার অস্বীকার করে। কিন্তু আগুন লাগার সময় বিভিন্ন জায়গায় আরো ৫০-৬০ জনের মতো রাবার কোম্পানীর রোহিঙ্গা শ্রমিক অবস্থান করতেছিল।
রেংয়েং পাড়ার কার্বারী রেংয়েং ম্রো(৫৫) বলেন ২৬ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জুম বাগানে আগু জ্বলেছিল। পাড়ার কোন মানুষ সারারাত ঘুমাতে পারেনি ঘর-বাড়ী পুড়ে যাওয়ার আশংকায় আর আতঙ্কে। আমরা বিচার চাই।
লাঙকম পাড়ার কার্বারী লাংকম ম্রো (৪৭) বলেন আগুন দেওয়ার ঘটনায় লামা রাবার কোম্পানীর প্রকল্প পরিচালক, কামাল উদ্দিন সহ ৮জনকে আসামী করে ২৮এপ্রিল লামা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করলে ২৯এপ্রিল পুলিশ দুজন আসামীকে গ্রেফতার করে, পরবর্তী সকল আসামী আদালত থেকে জামিন লাভ করে। জুম ভুমিতে আগুন দেওয়ার কারনে পাড়াবাসী সময়মত কেউই জুম চাষ করতে পারেনি,কেউ এক আড়ি, কেউ দুই আড়ি জুম চাষ করতে পেরেছেন অনেকে মোটেই জুম চাষ করতে পারেনি বলে জানান তিনি। সেজন্য পাড়ার সবাই কমবেশী খাদ্য সংকটে পড়বেন। অন্যদিকে জুম ভুমি বেদখলের প্রতিবাদ করার জন্য পাড়াবাসীকে সংগঠিত করে লামা রাবার কোম্পানীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে সহযোগীতা করেছিলেন রুংধজন ত্রিপুরাকে গত ১৩জুলাই রাতে রাবার কোম্পানীর লোকজন পরিকল্পিতভাবে হামলা করে গুরুতর আহত করে। রুংধজন বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন।
তিনি আরো বলেন তারা ত্রাণ নিতে আগ্রহী নয়, তাদের ভূমিতে জুম চাষ, ফলদ বাগান করে নিরাপদে বাস করতে চান,নিজেরা আয় রোজগার করে জীবনজীবিকা নির্বাহ করতে আগ্রহী বলে জানান। একদিকে খাদ্যের সংকটের চিন্তা অন্যদিকে পাড়া উচ্ছেদের আশংকা- আতংক তিন পাড়ার ম্রো ও ত্রিপুরা ৩৯পরিবার মানুষ এখন উভয় সংকটে বলে জানান লাঙকম পাড়ার কার্বারী লাঙকম ম্রো।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বনওভুমি অধিকার আন্দোলনের বান্দরবান জেলা চেপ্তারের সভাপতি ও বিশিষ্ট গবেষক জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, একমাত্র সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার অভাবের কারনে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের প্রধান সমস্যা ভূমি সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা বলে জানান। সরকার আন্তরিক হলে বিরাজমান সমস্যা অবশ্যই সমাধান সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও দুর্নীতিপ্রতিরোধ কমিটির বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি অং চমং মার্মা বলেন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপদে বসবাস করা ও খাদ্যের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। আছে আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার আশাকরি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন লাংকম পাড়াসহ তিনটি পাড়ার ৩৯টি ম্রোও ত্রিপুরা পরিবারের বসবাসের নিরাপত্তা প্রদান ও খাদ্যের সংকট হলে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে।
সরই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইদ্রিস কোম্পানী বলেন রাবার কোম্পানীর পক্ষ থেকে ৩৯ পরিবারকে প্রতি পরিবারকে ৫একর করে জায়গা ছেড়ে দিয়ে সমঝোতা করতে চেয়েছিল কিন্তু ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায় রাজি না হওয়াতে সমঝোতা করা সম্ভব হয়নি। তার জানামতে পাড়াবাসীকে কেউ হুমকী দেয়নি,তারা নিরাপদে থাকতে পারবে বলে জানান।
আর খাদ্যের সংকট দেখা দিলে প্রয়োজনী খাদ্য সহায়তা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানীর পরিচালক কামাল উদ্দিন পাড়াবাসীর অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, রাবার কোম্পানীর লিজ নেওয়া যায়গায় কাজ করতে গিয়ে বাধাগ্রস্থ হয়েছি। কাউকে হামলা করা হয়নি বলে জানান।
রাবার কোম্পানীর লোকজন পাড়াবাসীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর প্রকল্প পরিচালক মোঃ কামাল উদ্দিন সম্পূর্ণ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরই এলাকায় ৩০বছর যাবৎ রাবার উৎপাদন নিয়ে কাজ করছি, তিনি ৩৯ পরিবারের পাড়াবাসীর সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা করছেন বলে জানান, গত ১৩জুলাই রুংধজন ত্রিপুরাকে দুর্বৃত্তের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন এঘটনায় তার লোকজন কোনমতেই জড়িত নয়।
সরই এলাকার ম্রো ও ত্রিপুরা ৩৯পরিবার আতঙ্কে থাকার প্রসঙ্গে লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন লামা রাবার কোম্পানী ও ম্রো-ত্রিপুরাদের ভুমি বিরোধ সংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন অবগত আছেন ও যাহাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ এলাকায় নজরদারীতে রেখেছেন বলে জানান এই পুলিশের কর্মকর্তা।
লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন সরই এলাকার রাবার কোম্পানী ও স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরাদের সাথে ভুমি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রদান করা হয়েছে,যারা ক্ষতিগ্রস্থ তাদের জন্য কি করা দরকার সেটা তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এলাকার শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার জন্য পুলিশের নজরদারী বাড়ানো হয়েছে। আর এলাকাবাসীর খাদ্যের সংকট হলে সরকারের পক্ষ থেকে ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।