মতামত ও বিশ্লেষণ

বান্দরবানে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও শেরপুরে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে

পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম, থানচি ও রোয়াংছড়ি-সহ প্রায় ৭টি উপজেলার সাঙ্গু, মাতামুহুরী নদী ও নদীর পার্শ্ববর্তী ঝর্ণা, ছড়া, খাল, ঝিরি থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব পাহাড়ী অঞ্চল থেকে কোটি কোটি টাকার পাহাড়ি বৃক্ষ কেটে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে এখন আগ্রাসীদের নজর পড়েছে প্রাকৃতিক পাথরের ওপর। খনিজ ও বন আইন এবং হাইকোর্টের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী ঠিকাদার-ব্যবসায়ীচক্র এ পাথর উত্তোলন কাজে উঠেপড়ে লেগেছে। যার ফলে, পাহাড়ি নদীগুলো যেমন প্রবাহ হারাচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে ঝিরি ও ঝরনাগুলো শুকিয়ে গিয়ে ঐ অঞ্চলের স্থানীয় আদিবাসীদের একমাত্র খাবার পানির উৎস ধ্বংস করা হচ্ছে। জানা গেছে, এসব অঞ্চলে পাথর উত্তোলনের ফলে প্রায় ৪০০ঝিরি ও ঝর্ণা নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানকার নদীগুলোও আজ পানিশূন্য। এইসব ঝিরি ও ঝর্ণাই হলো স্থানীয় আদিবাসীদের খাবার পানির একমাত্র উৎস। কিন্তু অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে এই ঝিরি বা ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে বান্দরবানের স্থানীয় আদিবাসীদের জীবন ব্যবস্থা ও বৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে তাদের সেখানে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় কেউ কেউ এ অবৈধ পাথর উত্তোলনের প্রতিবাদ করতে চাইলে উল্টো তাঁদের জীবনের ওপর নানারকম হুমকি নেমে আসার অভিযোগ রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নয় বরং এসব এলাকায় অসাধু মানুষের দ্বারা পাথর উত্তোলনের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য চরমভাবে নষ্ট হচ্ছে এবং আশেপাশের পাড়াগুলোতে পানি সংকটসহ বনের জীব বৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে পড়ছে। ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীরা প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে বা তাদের তোয়াক্কা না করে এ অবৈধ কাজ নির্বিচারে করে চলেছে। জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসন ও বনকর্মীরা এসব অঞ্চলে মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও পরক্ষণেই পাথর উত্তোলনকারীরা আবার নেমে পড়ছে। ফলে, স্থানীয় বনবিভাগ ও প্রশাসন এ অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছে। যার ফলে, কিছুতেই থামছে না এ অবৈধ পাথর উত্তোলন। আহরিত এ পাথরগুলো মেশিনে ভেঙ্গে কংক্রিট করে ভারি ট্রাকযোগে বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হচ্ছে। জানা গেছে, বান্দরবানের বেশ কিছু স্থানে উত্তোলনকৃত আরো প্রায় ৬ লক্ষাধিক ঘনফুট পাথর পাচার বা বিক্রির জন্য মজুদ করা হয়েছে। বান্দরবান জেলা প্রশাসনের কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখেও না দেখা এবং জেনেও না জানার ভান করছেন। প্রশাসন সুকৌশলে বিষয়টি কখনো এড়িয়ে চলছেন আবার কখনো কখনো অবৈধ পাথর ব্যবসায়ী ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। আর এদিকে অসাধু চক্র নির্বিচারে পাথর উত্তোলন করেই চলেছে।

উল্লেখ্য যে, বান্দরবানের এসব অঞ্চল থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে কয়েকমাস আগে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছিল স্থানীয় আদিবাসী নাগরিক-সহ আইন, পরিবেশ ও আদিবাসী অধিকার সচেতন ৬টি সংগঠন, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল’ইয়ার্স আ্যাসেসিয়েশন (বেলা), বাংলাদেশ পরিবশে আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কাপেং ফাউন্ডেশন, নিজেরা করি এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)। এসব সংগঠনগুলো রিট দায়ের করলে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ মহামান্য হাইকোর্ট পাথর উত্তোলন বন্ধে একটি নির্দেশ দেয়। এক মাসের মধ্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বান্দরবান জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ মামলার ১০ বিবাদীকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। এই রিটের শুনানি নিয়ে আদালত রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। কিন্তু মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনার পর প্রায় তিনমাস অতিবাহিত হলেও সে অঞ্চল থেকে কিছুতেই পাথর উত্তোলন বন্ধ না হয়ে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

অপরদিকে শেরপুর জেলার শ্রীবর্দীর কর্ণঝোড়ার ঢেঁউপা এবং বালুঝুড়ি মাসি নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে এলাকার আদিবাসী বসতবাড়ি, রাস্তা ও স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে ভাঙন ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় আদিবাসীদের প্রতিবাদ ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও যেন এ অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা যাচ্ছে না। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদী ও ডোবা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে প্রভাবশালী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা। এতে স্থানীয় মানুষের বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এখানে কিছুতেই দেশে প্রচলিত আইন ‘বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০’ মানা হচ্ছে না।

আমাদের রাষ্ট্রে, ‘বন আইন’, ‘খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২’, এবং ‘বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০’ কার্যকর থাকার ফলেও কিছুতেই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও বালু উত্তোলন বন্ধ করা যাচ্ছে না। সর্বশেষ, বান্দরবানে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে মহামান্য হাইকোর্ট-এর রায় পেলেও সে রায় অনুযায়ী পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়নি বলে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। এখন প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক যে, রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন যদি না মানা হয় এবং মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ যদি অমান্য করা হয়, তাহলে আমরা কার কাছে যাব? এমনিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আদিবাসীদের ওপর নানারকম হত্যা, নির্যাতন, নারী ও শিশুদের ওপর শ্লিলতাহানি, ভূমিদখল, মিথ্যা মামলা, অপহরণ, গুম ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘণের মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে, তার ওপর পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আগ্রাসীদের থাবা পড়ে আদিবাসীদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলেছে। এই অবস্থায় আমরা বান্দরবান পার্বত্য জেলায় জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং দেশের পরিবেশ সুরক্ষায় আজকের এ মানববন্ধনে কিছু দাবি উত্থাপন করছি।

আমাদের দাবিসমূহ-
১. অবিলম্বে বান্দরবান পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন নদী, ঝর্ণা, ছড়া, ঝিরি থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে হবে;
২. বান্দরবানে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে মহামান্য হাইকোর্টের রায় যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং প্রশাসনকে এ রায় বাস্তবায়নে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে;
৩. সমতলের শেরপুরের শ্রীবর্দী ও অন্যান্য অঞ্চলের নদী ও ডোবা থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে;
৪. অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত সকল প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ী চক্রকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি প্রদান করতে হবে;
৫. আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর পরিবেশ এবং তাদের ভূমি/ভূখন্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও রক্ষা করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৬. দেশের বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রাষ্ট্র বা প্রশাসনকে আরো মনোযোগী ও তৎপর হতে হবে।

…………………………………………..
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, কাপেং ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক কর্তৃক আয়োজিত, ৩১ মে ২০১৯, ঢাকা, শাহবাগ।

Back to top button