বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন আদিবাসী কবি ও সাহিত্যিক মৃত্তিকা চাকমা
আইপিনিউজ, রাঙ্গামাটি: আদিবাসী কবি ও নাট্যকার মৃত্তিকা চাকমাকে নাটক ও নাট্যসাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ এর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। তিনি নিজ মাতৃভাষায় বহু কাব্য, নাটক সহ নানা সাহিত্যকর্ম সম্পাদনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি অধিক সমাদৃত।
এই সম্মাননা প্রাপ্তি সম্পর্কে কবি ও নাট্যকার মৃত্তিকা চাকমার কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গতকাল(২৪ জানুয়ারি) রাত ১১ টায় বাংলা একাডেমি থেকে ফোন করে জানানো হয়, বাংলা একাডেমি ২০২৩ সালের নাট্য ও নাট্যসাহিত্যে বিষয়ের উপর তাঁকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে এটা আমার জন্য সম্মানের এবং সুসংবাদও বটে। এবং এটা পার্বত্যবাসীর জন্য সুসংবাদ বলে তিনি মনে করেন।
যারা আগামী দিনে নাটক ও নাট্য সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে চাই এই সম্মাননা তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে তিনি মনে করেন।
তিনি নাটক ও নাট্য সাহিত্য নিয়ে আরও ব্যাপকভাবে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। সেইজন্য তিনি সকলের কাছে আশীর্বাদ এবং শুভকামনা প্রত্যাশা করেছেন।
কবি মৃত্তিকা চাকমা জন্মগ্রহণ করেন ১২ জানুয়ারী ১৯৫৮ খ্রি: রাঙ্গামাটি জেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের মুবাছড়িতে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধে বসতভিটা জলমগ্ন হলে রাঙ্গামাটির বন্দুকভাঙ্গা ত্যাগ করে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি থানার লোগাং এ চলে যেতে হয় কবির পরিবারকে। কবি মৃত্তিকা চাকমার শৈশব কাটে লোগাং এর মাটি ও মানুষের সাথে। লোগাং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করে শেষ হয় চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ(স্নাতক) এম.এ(স্নাতকোত্তর) ডিগ্রী অর্জনের মাধ্যমে। কবি মৃত্তিকা চাকমা মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। স্ত্রী শৈব রানী চাকমা দুই সন্তান ড্যানিস চাকমা ও নিসা চাকমাকে নিয়ে ছোট পরিবার। পিতা যুবনাশ্ব চাকমা ও মাতা রাজলক্ষী চাকমা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আশির দশকের খ্যাতিমান কবিপ্রতিভা মৃত্তিকা চাকমা। কাপ্তাই বাঁধের ফলে বাস্তুভিটা হারিয়ে পরিবারের সঙ্গে শৈশবে উদ্বাস্তু হন তিনি। ফলে তাঁর কবিতায় প্রকৃতির পাশাপাশি দ্রোহের উচ্চারণ এসেছে বারবার। তাঁর কবিতায় মৃত্তিকা স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের নান্দনিক সৌন্দর্যের কথা ফুটে উঠেছে। তিনি চাকমা সাহিত্য সমাজকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন দীর্ঘ সময় ধরে।অধিকারহীন, অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ ও আর্থসামাজিকভাবে অনগ্রসর বা বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার একটি জাতির একজন কবি, লেখক ও নাট্যকারের তার লেখনি চালিয়ে যাওয়া, তার প্রকাশ করা, জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া যে কতখানি কষ্টকর তা নিশ্চয়ই ভুক্তভোগীরাই জানেন। এরপরও মৃত্তিকা চাকমার রচনা চাকমা নাটক ও সাহিত্যের জন্য বিশাল না বললেও, বিরাট ব্যাপার নি:সন্দেহে।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন জুম ইসথেটিক কাউন্সিল জাক এর নীতি নির্ধারক ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি জাক-এর সাথে সম্পৃক্ত থেকে এবং নিজ উদ্যোগে জুমিয়া সাহিত্য সংস্কৃতির অগ্রগতি সাধনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও তিনি হিল চাদিগাং থিয়েটারসহ কয়েকটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে থেকেছেন। এ পর্যন্ত ১২ টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে কবিতা ছয়টি, নাটক চারটি, প্রবন্ধ ২টি। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: মেঘ সেরে মোনো চুক(কবিতা), মন পরানী(কবিতা), এখনো পাহাড় কাঁদে(বাংলা ভাষার কবিতা), দিকবন সেরেততুন(কবিতা), একজুর মান্নেক(চাকমা নাটক), বান(চাকমা নাটক) ইত্যাদি।
বাংলা, বাংলা হরফে চাকমা ও চাকমা হরফে লিখিত মৃত্তিকা চাকমার নাট্যসাহিত্যের দৃষ্টান্ত-
১. দেবঙসি আহধর কালা ছাবা (১৯৮৯)
২. গোঝেন (১৯৯০)
৩. মহেন্দ্রর বনবাঝ (১৯৯২)
৪. একজুর মান্নেক (১৯৯৩)
৫. জোঘ্য (১৯৯৯)
৬. হককানির ধনপানা (২০০১)
৭. একাত্তর তরুনী (২০০২)
৮. ভূত
৯. থবাক (২০০৫)
১০. বান (২০০৮)
১১. কর্মফল (২০১২)
১২. মোনফুল [মঞ্চনাটক] (১৯৯০)
১৩. উদোশিঙর খানা গুদি (১৯৯৭)
১৪. তুলোপুধি বাবর মাধা ধনা (১৯৯৭)
১৫. গুণমনে স্কুলত যেব (২০০০)
১৬. নেতার চবাত (নাটিকা)
১৭. থগ (নাটক)
১৮. জামেই মারা (চাকমা কিংবদন্তী নাটক)
১৯. কুন্ডলী বালার অর্হত (কাব্য নাটক)
২০. আভা (পরিবেশ বিষয়ক চাকমা নাটিকা)
২১. শান্তি দেবী জদন হলা (নাটিকা)
২২. আঙস্যা সদগ (নাটিকা)
২৩. জামুরো (নাটিকা)
২৪. শিদোলো তাবা দি’ বিনি ভাত (নাটিকা)
২৫. পার্বতী মা (নাটিকা)
২৬. চন্ডি চরনার খানাগুলি (নাটিকা)
২৭. কাবাহুল (নাটিকা)
২৮. ছি মোকে লাদি ভাত (নাটিকা)
২৯. নিজ অহরণ শিখিবং (নাটিকা)
৩০. তানজাং (নাটিকা)
মৃত্তিকা চাকমা অনূদিত নাটক:
১. গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটক (১৯৮৪)
২. জাপানি নাট্যকার ইয়ামামতো ইউজোর One hundred sacks of rice’ নাটক অবলম্বনে ‘একশ বস্তা চোল’ (২০১৮)
মৃত্তিকা চাকমার প্রকাশিত নাট্যগ্রন্থ:
১. একজুর মান্নেক [মঞ্চ নাটক] (১৯৮৮)
২. গোজেন [মঞ্চ নাটক] (১৯৯৯)
৩. বান [মঞ্চ নাটক] (২০১০)
৪. কর্মফল [চাকমা নাটক] (২০১২)
এ কবি সন্মাননা পেয়েছেন দেশে ও দেশের বাইরে। তার মধ্যে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও তোলবিচ সাহিত্য পুরস্কার(১৯৮১), জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা(২০০৩), স্বাধীনতা সংসদ সন্মাননা, ঢাকা(২০১০), আন্তর্জাতিক জলঙ্গী কবিতা উৎসব সন্মাননা, নদীয়া ভারত(২০১০) উল্লেখযোগ্য।