মতামত ও বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সংবাদ সম্মেলনের মূল বক্তব্য

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০১৯ উপলক্ষে হোটেল সুন্দরবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনের পঠিত বক্তব্যটি নিচে হুবুহু দেওয়া হল……।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। প্রতি বছরের মতো আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার জন্য আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আপনারা জানেন, আগামী ৯ আগস্ট বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘ ঘোষিত ২৫তম আদিবাসী দিবস উদযাপিত হবে। এ বছর আদিবাসী দিবস উদযাপনের রজত জয়ন্তী পালিত হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজুলেশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করে ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং তা পালনের জন্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আহ্বান জানায়। তারপর থেকে গত ২৫ বছরে বৈশ্বিক পর্যায়ে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তম্মধ্যে ২০০০ সালে জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম গঠন, ২০০১ সাল থেকে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোটিয়ার নিয়োগ, ১৯৯৫-২০০৪ সালের সময়কালকে প্রথম আদিবাসী দশক ও ২০০৫-২০১৪ সালের সময়কালকে দ্বিতীয় আদিবাসী দশক হিসেবে পালন, ২০০৭ সালে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র গ্রহণ, ২০০৭ সালে আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কর্মব্যবস্থা প্রবর্তন, ২০১৪ সালে সাধারণ পরিষদের বিশ্ব আদিবাসী সম্মেলন আয়োজন এবং এ সম্মেলনে ঐতিহাসিক ‘আউটকাম ডকুমেন্ট’ গ্রহণ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযাগ্য। ‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা নয়’ বা ‘ No One Behind’ শ্লোগান নিয়ে যে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০৩০ এজেন্ডা জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে, সেখানে আদিবাসীদের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। তাই এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদিবাসী জনগণ এবং আদিবাসী সংগঠনসমূহের অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

আপনারা জানেন, আদিবাসী জাতিসমূহের জীবনধারা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, আদিবাসী জাতিসমূহের ভাষা ও সংস্কৃতি তথা আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ অ-আদিবাসী জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করে তোলা এবং আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করাই হলো আদিবাসী দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, আমাদের দেশে এই কাজগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বিশ্বের ৯০টি দেশের ৪০ কোটির অধিক আদিবাসী জনগণের মতো বাংলাদেশে বসবাসকারী ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ এবারও জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস জাতীয়ভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ২০১৯ সালের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় “Indigenous Languages” এই মূলসুরের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে, “আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে এগিয়ে আসুন।” আসুন আমরা সকলে আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করি।

আদিবাসীদের বর্তমান বাস্তবতায় এই মূলসুর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা আদিবাসীদের বঞ্চনার মাত্রা মাতৃভাষার বিপন্নতা থেকে শুরু করে ভূমি অধিকার, এমনকি বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরোলেও দেশের ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক সময় যেসব অঞ্চলে আদিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, সেখানে ‘পপুলেশন ট্রান্সফারের’ ফলে আদিবাসী জনগণ নিজভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, গারো পাহাড়, উত্তরবঙ্গ, গাজীপুর, মধুপুর বনাঞ্চল, পটুয়াখালী-বরগুনা, খাসিয়া অঞ্চল সর্বত্র আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি (Ancestral land) হারিয়েছে। আদিবাসীদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, এখন আত্ম-পরিচয়, মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও আদিবাসী জনগণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,

এ বছর জাতিসংঘ আদিবাসীদের মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও চর্চার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। ২০১৯ খ্রীষ্টাব্দকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ‘আদিবাসীদের মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক বর্ষ’, International Year of Indigenous Langauges ঘোষণা করেছে এবং সদস্যরাষ্ট্রসমূহকে আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ইউনেস্কোর মতে, পৃথিবীতে আনুমানিক ৭০০০ ভাষা এবং আদিবাসীদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি সংখ্যা ৫০০০। তার মধ্যে ২৬৮০ টি ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার আশংকার মধ্যে রয়েছে। এই বিপন্ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাগুলোই আদিবাসীদের ভাষা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের বিপন্ন ভাষাগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, পৃথিবীতে প্রায় ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ জীবিত ভাষা রয়েছে। ২০১৫ সালের এথনোলগ প্রতিবেদনে ৭,১০২ টি জীবিত ভাষার উল্লেখ আছে। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে ৪১ টি ভাষার সন্ধান পেয়েছে। তারা বলেছে, সমীক্ষায় পাওয়া ভাষাগুলোর মধ্যে ১৪ টি ভাষা বিপন্ন। ভাষাগুলো হলোঃ খাড়িয়া, কোড়া, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও পাত্র। তবে আমরা মনে করি, বাংলাদেশে আদিবাসীদের বিপন্ন ভাষার সংখ্যা আরও বেশি।

জাতিসংঘ বলছে, আদিবাসী জনগণকে কখনও কখনও নিজ দেশে ভৌগোলিক কারণে, ভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চনা ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বসবাস করতে হয়। অন্যদিকে, এই আদিবাসী মানুষেরাই বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘ আরও বলছে, আদিবাসী ভাষাসমূহ হাজার বছর ধরে মৌলিক স্থানীয় সংস্কৃতি, প্রথা ও মূল্যবোধকে সমৃদ্ধ করেছে। আদিবাসীদের মাতৃভাষা বিশ্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যেকে আরও সমৃদ্ধশালী করেছে। আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি ছাড়া পৃথিবী হতো সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে অতি দরিদ্র স্থান। আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করতে হবে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা বর্ষ ও আদিবাসী দিবস উদযাপন জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন ও সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে বলে আমরা মনে করি।

আমাদের জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ আদিবাসীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। শিক্ষা নীতির ৭ নং ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “জাতি, ধর্ম, গোত্র-নির্বিশেষে আর্থ-সামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য ও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।” ২৩ নং লক্ষ্যে বলা আছে, “দেশের আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো।” জাতীয় শিক্ষা নীতির “আদিবাসী শিশু” অনুচ্ছেদে লেখা আছে, “আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষায় শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্য পুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। এই কাজে, বিশেষ করে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নে, আদিবাসী সমাজকে স¤পৃক্ত করা হবে। আদিবাসী প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।” আজ আবারও আমরা আদিবাসী দিবসে আদিবাসীদের শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষা নীতির যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। আদিবাসী অঞ্চলের স্কুলগুলোতে অবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থায় আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা নিশ্চয় জানেন, বাংলাদেশের সংবিধানে এখনো আদিবাসী জাতিসমূহের জাতিসত্তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি নেই। আমরা আদিবাসী সংগঠনের পক্ষ থেকে বার বার বলার চেষ্টা করেছি যে, আদিবাসী জনগণের আত্ম-পরিচয়ের অধিকার রয়েছে। এটি আমাদের মানবাধিকার। আন্তর্জাতিকভাবেও আদিবাসীদের আত্ম-পরিচয়ের অধিকার স্বীকৃত। তাই সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী জাতিসমূহের আশা-আকাক্সক্ষা ও দাবির ভিত্তিতে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছে।

আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটাপন্ন। দেশের বিভিন্ন অ লে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২১ বছর অতিবাহিত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুধু ধীরগতি নয়, অনেকটা থমকে আছে আর পাহাড়ের মানুষ সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দুর্বিসহ জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। সরকার বার বার সমতলের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন করেনি। এই বিষয়ে ন্যূনতম পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো লক্ষণ নেই।

বর্তমান সরকার বলছে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম জোর দিয়ে বলতে চায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত হাজার হাজার আদিবাসী মানুষের জীবনে এ কথার প্রতিফলন নেই, এর সত্যতা নেই। মানবাধিকার লংঘন, ভূমি দখল, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ফলে আদিবাসীদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে কবলিত। ১,৯০৯ ডলার মাথা পিছু আয়ের যে হিসাব দেখানো হয়, সেখানেও আদিবাসীদের প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন নেই। স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজিতে জাতিসংঘ আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নের কথা বলছে। আর আমাদের দেশে আদিবাসীদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে কবলিত। দেশে যখন জবাবদিহিতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতার অভাব প্রকট হয়, তখন আদিবাসীসহ দেশের গরিব ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ পরিস্থিতি। দেশে একদিকে চলছে উন্নয়নের আস্ফালন, অন্যদিকে রয়েছে মানুষের মধ্যে অধিকারহীনতা, বৈষম্য ও বঞ্চনার হাহাকার। এই অবস্থায় আমরা আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করছি।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজকে সাথে নিয়ে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সমাজ আদিবাসী অধিকার রক্ষায় ও জনসচেনতা তৈরিতে অবদান রাখছে। আদিবাসী দিবসে আপনাদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, সংগ্রামের পথেই আদিবাসীরা একদিন না একদিন তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদিবাসীদের মতো বাংলাদেশের আদিবাসীরাও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে। এ দিবসটি আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের পথে নতুন চেতনায় উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন।

আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও অন্যান্য সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে-

#৪ আগস্ট সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আলোচনা সভা;
#৫ আগস্ট সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মূল অনুষ্ঠান- সমাবেশ, র্যালী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধক হিসেবে এবং অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, প্রাক্তণ চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়াও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ উপস্থিত থেকে সংহতি জানাবেন;
#৭ আগস্ট সকাল ১০ টায় ঢাকার ডব্লিউ.ভি.এ মিলনায়তনে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের যৌথ আয়োজনে আদিবাসী নারীর অধিকার বিষয়ক সেমিনার;
#৯ আগস্ট বেলা ২ টায় বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় ছাত্র সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান;
#২৭ আগস্ট এএলআরডি ও ১০টির অধিক সংগঠন মিলিতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিয়ে সেমিনার আয়োজন করবে ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে;
এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় ও উপজেলায় যেমন- রাজশাহী, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল (মধুপুর), গাজীপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, শেরপুর, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে আদিবাসী দিবস উদযাপন করা হবে।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিতব্য এসব কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আপনাদের সকলকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

সাংবাদিক বন্ধুগণ,

যেহেতু এ বছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের মূল সুর আদিবাসী ভাষা, তাই বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আহ্বান-

#আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানসহ আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে একটি আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা। যে সকল অঞ্চলে আদিবাসীরা বসবাস করে, সেসব অ লে তাদের ভাষা চর্চা ও উন্নয়নে জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমিসমূহ যাতে আদিবাসী ভাষা চর্চা, সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, তার জন্য বাজেট বরাদ্দসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

# আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে একটি সেল বা বিভাগ স্থাপন করা এবং আদিবাসী যোগ্য ও দক্ষ লোকের সমন্বয়ে একটি পরিচালনা পরিষদ গঠন করা ও এ বিষয়ে একটি নীতিমালা গ্রহণ করা;

# এ পর্যন্ত মাত্র ৫টি আদিবাসী ভাষায় প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে, কিন্তু কোথাও পৃথকভাবে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। অবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থায় আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আরও পর্যায়ক্রমে অন্যান্য আদিবাসী ভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা চালুর ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

# শিক্ষার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার। আদিবাসীদের শিক্ষা বিস্তারে সুস্পষ্ট উল্লেখসহ বিশেষ বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। শিক্ষা নীতির সুফল যাতে আদিবাসীরা ভোগ করতে পারে, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

# সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজি বাস্তবায়নে আদিবাসীদের গুরুত্বসহকারে অংশীদারী করা এবং আদিবাসী সংগঠনসমূহ যাতে এসডিজি বাস্তবায়নে সরাসরি এবং যথাযথ অবদান রাখতে পারে, তা সরকার কর্তৃক নিশ্চিত করা;

# পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করা এবং এ লক্ষ্যে সময়সূচি-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করা;

#জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন করা। আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন ও ১৬৯ নং কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করা;

# সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে। আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করাসহ মধুপুর বনে গারো ও কোচদের ভূমিতে ঘোষিত রিজার্ভ ফরেস্ট অবিলম্বে বাতিল করা;

# আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস কর্তৃক প্রণীত আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন করা;

#মৌলভীবাজার জেলার ঝিমাই, পাল্লাতল ও নাহার খাসিয়া পুঞ্জির খাসিয়াদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের উপর অবৈধ চাপ প্রয়োগ বন্ধ করা। চা বাগানের লীজ বাতিল করা এবং বাগানের গাছ কাটা বন্ধ করা;

#আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, মিথ্যা মামলা, হয়রানি ও অপপ্রচার বন্ধ করা। আদিবাসী নারীসহ সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা;

#গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উপর চরম মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় জড়িত সকল দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং অবিলম্বে সাঁওতালদের ভূমি ফেরত দেওয়া;

# জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আদিবাসী দিবসে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছে যে, আপনারা আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে নানাভাবে এগিয়ে এসেছেন। আমরা মনে করি, আদিবাসীদের অধিকার হলো মানবাধিকার। জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রে যে সকল অধিকার আদিবাসীদের দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের স্বীকৃতি এবং রাজনৈতিক ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণ নিশ্চিত করা সকলের দায়িত্ব। এ বছর আদিবাসী দিবস উদযাপনে যেসকল ব্যক্তি ও সংস্থা সহযোগিতা করছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আসুন সকলে এবারের আদিবাসী দিবসের “আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে এগিয়ে আসুন” এই মূলসুর বাস্তবায়নে একসাথে কাজ করি।
আপনাদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ।

জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা
সভাপতি
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
ঢাকা, আগস্ট ৩, ২০১৯

Back to top button