মতামত ও বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭ সার সংক্ষেপ : কাপেং ফাউন্ডেশন

রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার
মানবাধিকার কর্মীদের জন্য ২০১৭ সালের বছরটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বছর। এ বছরটিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনার পাশাপাশি এ বছর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা জনমনে চরম উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের আদিবাসী অধিকার কর্মীরা এ ধরনের অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনার শিকার না হলেও ক্রমবর্ধমান ঘটনায় ২০১৭ সালে আদিবাসী কর্মীদেরও চরম উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে থাকতে হয়েছে। তবে ২০১৭ সালের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে শারীরিক নির্যাতন ও মৃত্যু, আদিবাসী কর্মীদেরকে নানা অজুহাতে গ্রেফতার করা, বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত করে সাজানো মামলা দায়ের করা, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নিয়ে অমানুষিক মারধর করা, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে জেলে প্রেরণ করা ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন উদ্বেগজনকভাবে অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী অধিকার কর্মীদেরকে চাঁদাবাজি, অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি সাজানো অভিযোগে অভিযুক্ত করে মিথ্যা মামলা দায়ের, ধরপাকড়, জেলে প্রেরণ, ক্যাম্পে আটক ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি তল্লাসী ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন জোরদার করেছে। এমনকি জামিনে থাকা আদিবাসী কর্মীরা আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তাদেরকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক আইন-বহির্ভূতভাবে আটক করে মারধর করা এবং অন্য মামলায় জড়িত করে জেলে প্রেরণের ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৭ সালে অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭ জনসহ ১০ জনকে হত্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪১ জন আদিবাসী অধিকার কর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসীকে গ্রেফতার ও সাময়িক আটক এবং ১৬১ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়ন-নির্যাতন ও হামলায় ২০৩ জন আহত (তাদের মধ্যে সমতলের ৯ জন) এবং ৭৯টি ঘরবাড়িতে তল্লাসী চালানো হয়েছে।
গ্রেফতারকৃত ও হামলার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান-কার্বারী, নারী ও স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীও রয়েছে। অনেককে আদালতে হাজির করার পূর্বে নিরাপত্তা বাহিনী হেফাজতে নিয়ে অমানুষিকভাবে মারধর করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশের সময় আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। নৃশংসভাবে মারধর করার ফলে গুরুতর আহত হওয়ায় পুলিশ গ্রহণ করতে অপরাগতা জানিয়েছে এমন ধরনের অন্তত তিনটি ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের একটি ঘটনায় পুলিশ গ্রহণ না করাতে ৫ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে নানিয়ারচরে ধৃত এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমাকে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ এপ্রিল তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এ অমানবিক ঘটনার সাথে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এভাবে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করছে।
ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার
২০১৭ সালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রায় ২০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ বা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ার অধীনে আনা হয়। যার মধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, পর্যটন কমপ্লেক্স, ব্যবসায়িক কাজে এবং সংরক্ষিত বন নির্মাণের উদ্দেশ্যে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা বেশির ভাগ আদিবাসীদের ভূমি অধিগ্রহণের আওতায় আনা হয়। গতবছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি সাধিত হয়নি। আবার এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দীর্ঘতর হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করে তুলছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য ভিত্তি হিসাবে যে ‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১’ রয়েছে তাতে অনেক বিরোধাত্মক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে কোন অগ্রগতি সাধিত হয়নি। উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশমালা মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন করে। কিন্তু ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য আইনটি বাস্তবায়নে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, অফিস স্থাপন না করা এবং আইনের বিধান সাপেক্ষে কার্যবিধিমালার প্রণীত না হওয়া কমিশনের কাজকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাছাড়া, বিগত বছরটি বিভিন্ন কারণে আদিবাসী জনগণের জন্য তিক্ত অভিজ্ঞতার বছর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যা তাদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে এবং তাদের সামাজিক শান্তিকে বিনষ্ট করতে দেখা যায়। গত বছরের ২ জুন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার লংগদু উপজেলায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর সেটেলার বাঙালি দ্বারা সংঘটিত অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও উচ্ছেদের ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। এ ঘটনায় আদিবাসী গ্রামবাসীদের প্রায় ২৫০টি ঘরবাড়ি এবং দোকান ভাংচুর এবং লুটপাটের শিকার হয়েছিল। গুণমালা চাকমা (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ মহিলাকে এই অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আগুণে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া ৩ জন আদিবাসী গ্রামবাসী এ হামলায় আহত হয়। আদিবাসী গ্রামবাসীদের মধ্যে কেউই এ অগ্নিসংযোগ ও হামলায় তাদের কোনও সম্পত্তি রক্ষা করতে পারেনি। হাজার হাজার আদিবাসী গ্রামবাসীরা এ সহিংসতা থেকে কোন মতে জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা অদূরে কোন জঙ্গলে অথবা আশেপাশের গ্রামগুলিতে আশ্রয় নেয়। এখনো অধিকাংশ আদিবাসী খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করেন এবং তারা খাবার, বস্ত্র এবং চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তাদের জন্য সরকারি সাহায্যও পর্যাপ্ত ছিল না।
সমতল অঞ্চলের আদিবাসী জনগণের জমি বেদখলের পরিস্থিতিও অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক। মৌলভীবাজার ও টাঙ্গাইল জেলার অধিকাংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের পূর্বপুরুষদের জমি থেকে উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছে। তাছাড়া, গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জের বাগদা ফার্মে অগ্নিসংযোগ, উচ্ছেদ ও হত্যাকান্ড ঘটনার সেই উচ্ছেদ হওয়া ১২০০ আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারকে এখনও একটি সন্তোষজনক সমাধান প্রদান করা সম্ভব হয়নি। আদিবাসীদের নামে ভূমি ও বনকেন্দ্রিক মিথ্যে মামলা ও হয়রানীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকারের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও সমতলের আদিবাসীদের ভূমিকেন্দ্রিক সমস্যাগুলির সমাধান বা ভূমি সমস্যা মোকাবেলার জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের উদ্যোগ সরকার আজও গ্রহণ করতে পারেনি। আরও দুশ্চিন্তা হচ্ছে, দেশ জুড়ে জমি সংক্রান্ত মামলা মোকাবেলা করার সময় আদিবাসী মানুষ প্রায়ই আরো নানাবিধ ঝামেলায় পড়ছে।
আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুর মানবাধিকার পরিস্থিতি
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করার জন্য বাংলাদেশে কোন বিশেষ বা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উদ্বেগের বিষয় হলো, আদিবাসী নারীদের প্রতি সহিংসতার ঘটনার সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। আসলে এটি বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘণের সবচেয়ে ব্যাপক একটি ক্ষেত্র। আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক মাত্রা রয়েছে যেমন-ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণের পর হত্যা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অপহরণ, পাচার ইত্যাদি। তাদের মধ্যে আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদিবাসী লোকজনদের প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি এ ধর্ষণ বা সহিংসতামূলক কোন ঘটনারই এপর্যন্ত কোন সুষ্ঠু বিচার হয়নি বরং ঘটনায় জড়িত অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে।
২০১৭ সালের ১ জানুয়ুারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদিবাসী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৪৮টি (সমতলে ২০টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৮টি)। ৪৮টি ঘটনায় মোট ৫৮ জন আদিবাসী নারী ও মেয়েশিশু যৌন বা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হয়। যার মধ্যে, ধর্ষণের শিকার হয় কমপক্ষে ১২ জন আদিবাসী নারী, ৯ জনকে হত্যা ও ধর্ষণের পর হত্যা এবং ৯ জন নারীকে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এই প্রতিবেদন সময়ের মধ্যে অন্যান্য ঘটনার মধ্যে ৪ আদিবাসী নারী গণধর্ষণ এবং ৮ জন আদিবাসী নারী ও কিশোরীকে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত ৭৫ জন অপরাধীদের মধ্যে ৬৪ জন মূলধারার বাঙালি লোক এবং ৪ জন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক। সহিংসতার শিকার আদিবাসী নারী ও মেয়েশিশুর বয়স ৩ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে ছিল।

আদিবাসী শিশু ও যুবদের মানবাধিকার পরিস্থিতি
বাংলাদেশে আদিবাসী শিশু ও যুবদের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি বিগত বছরের ন্যায় বিরাজমান রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য থাকলেও, সরকার আদিবাসী শিশু ও যুবদের মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ডে ১০টি আদিবাসী শিশু অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে।
শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে প্রণীত আদিবাসী শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে সরকারের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত ছিল। সরকার বিগত পাঁচ বছরে বার বার প্রতিশ্রুতি প্রদানের পরে অবশেষে পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছে। আদিবাসীদের জন্য নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হলেও সরকার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে কার্যকর করতে পারেনি। যেমন- অপর্যাপ্ত পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ও পুরো আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা আওতায় না আনা, সংশ্লিষ্ট আদিবাসী ভাষায় দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব এবং উক্ত ভাষাভাষী আদিবাসী শিক্ষার্থীদের এ কার্যক্রমের সঠিক হিসেবে না আনা ইত্যাদি।
শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু উন্নয়নের পাশাপাশি, পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৭ সালে ২১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তথাপি দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় আদিবাসীদের আবাসন ও যাতায়াতের সমস্যা, স্কুলের দূরত্ব, শিক্ষক সংকট, শিক্ষার্থীদের ভাষাগত সমস্যা, ও বর্গা শিক্ষাপ্রথার মতো অনেক সমস্যা সেখানে বিদ্যমান যা আদিবাসী শিশু ও যুবদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে যাচ্ছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলের অনেক ছাত্রছাত্রী’ই ২০১৭ সালে প্রথমবারের মত প্রচলিত নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক পায়নি। শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা উপকরণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ৬টি; যথাক্রমে- চাকমা, গারো, মারমা, সাদরী, সাঁওতালি এবং ত্রিপুরা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এ পদ্ধতি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয় যেখানে মাঠ পর্যায়ের আদিবাসী বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বহুবছরের প্রচেষ্টার পর অবশেষে মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের ১লা জানুয়ারি সারাদেশে সাঁওতালি বাদে অন্য পাঁচটি ভাষায় ৫০,০০০ প্রাক-প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করে। আনুমানিক মাত্র ২৫,০০০ আদিবাসী শিশু বিতরণকৃত এ পাঠ্যপুস্তকগুলো হাতে পেয়েছে।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা
সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করে যে তারা চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করেছে। বাকি ৯টি ধারাও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। অথচ চুক্তির মূল বিষয়গুলো যথা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে প্রশাসনিক ও আইনগত পদক্ষেপ; সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও পুলিশ সহ ভূমি ও ভূমি ব্যাবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ এবং যোগাযোগ ব্যাবস্থার মত বিষয়গুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেদখলকৃত জমিগুলো প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া; ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের যথাযথ পুনর্বাসন করা; অপারেশন উত্তরণ সহ পার্বত্য অঞ্চল থেকে সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা; ও অস্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে দেওয়া লীজ বাতিল করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হয় একবারেই বাস্তবায়িত হয়নি নতুবা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কিত বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হল পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ও টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করা। তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি এবং ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে কোন অগ্রগতি নেই। সারা বছরেও ভূমি কমিশন, টাস্কফোর্স, ও চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ কমিটির কোন মিটিং হয়নি। এমনকি তাদের দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল, জনবল ও অফিস কোনটিই সরবরাহ করা হয়নি। অবশিষ্ট ১৬টি অহস্তান্তরিত কার্যাবলীর/বিষয়ের কোনটিই পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যবিধিমালা যেমন ভূমি কমিশনের কার্যবিধিমালা ও তিন জেলা পরিষদের নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালার প্রণয়নের কাজ ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য প্রযোজ্য এমন কোন সাধারণ বা বিশেষ কোন আইনের সংশোধনেও সরকার কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন
২০১৭ সালে দেশের পার্বত্য জেলায় ভূমিধসের কারণে অনেক আদিবাসী ও অআদিবাসী নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে ১৩১ জন লোক মারা গেছে। কেবল রাঙ্গামাটি জেলায় ১২১ জনের মৃত্যু হয়েছে, অপরপক্ষে খাগড়াছড়ি জেলায় ৪ জন এবং বান্দরবান জেলায় ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলায় দুইজন অফিসারসহ ৪ সেনা সদস্য মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় মানিকছড়ি, ভেদভেদী ও রিজার্ভ বাজার এলাকায় ৪৫ জন মারা গেছে। অপরপক্ষে রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলায় ৪৭ জনের মৃত্যু ঘটে।
অন্যদিকে প্রলঙ্করী ভূমিধসের ফলে রাঙ্গামাটি জেলায় ২২৭ জন লোক আহত হয়েছে এবং ১৫,০০০ পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায় যে, তাদের মধ্যে ১২,৪৫০ পরিবার হচ্ছে রাঙ্গামাটি সদর, কাউখালী, কাপ্তাই, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী ও নানিয়ারচর উপজেলায়। আহত অনেককে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছিল। ভূমিধসের ফলে মাটি সরে যাওয়ার ফলে হাজার হাজার একর বাগান-বাগিচা, টিলা ভূমি ও ধান্য জমি ধ্বংস হয়েছে যা চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারের ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল।
দেখা গেছে যে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য যথাযথ কোন সমন্বয় ছিল না। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের। কিন্তু ভূমিধসের পর দুর্যোগ মোকাবেলায় আঞ্চলিক পরিষদকে সম্পৃক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি জেলা প্রশাসনের আহুত ভূমিধস সংক্রান্ত কোন সভায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকেও আমন্ত্রণ করা হয়নি বলে জানা গেছে। ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে। এর ফলে ত্রাণের অর্থ বিতরণে নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে।
আন্ত:মন্ত্রণালয়ের সভায় ২৭-সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয় এতবড় প্রলঙ্করী ভূমিধসের পেছনে কী কারণ ছিল তা পরিচিহ্নিত করার জন্য। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে এই কমিটির আহবায়ক করা হয়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি এবং ৫ জেলার জেলা প্রশাসকদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষণীয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কোন প্রতিনিধিকে এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

Back to top button