অন্যান্য

বল্টুগাছে মোনের সৌন্দর্যে; দুর্গম যোগাযোগে স্থানীয়দের কষ্ট; আছে সম্ভাবনা

হিমেল চাকমা, রাঙামাটি: রাঙামাটির সদর উপজেলার বল্টুগাছ মোন পাড়া। এ গ্রামের উত্তরে কাউখালী, দক্ষিণ ও পশ্চিমে কাপ্তাই পূর্বের রাঙামাটি সদর। পাহাড় চুড়া থেকে সবকিছু দেখা মেলে পাখির চোখে। তিন উপজেলার সীমান্ত এলাকার পাড়াটি পড়েছে মগবান ইউনিয়নে।
এই পাড়ার মোনের চুড়া থেকে দেখা মিলে রাঙামাটির প্রকৃতি, কাপ্তাই হ্রদের নীল পানি, পানির উপরে উড়ে বেড়ানো মেঘের ভেলা, সারি সারি সবুজ পাহাড়, পুর্ণিমা রাতে পাহাড় চুড়ায় বসে পুর্নিমা চাঁদের আলোয় আলোকিত হওয়া, ভোর সকালে পাহাড়ের চুড়ার উপর একগুচ্ছ মেঘের ভেলা যেকোন পর্যটককে আনন্দ দেবে। এই মোনে যাওয়ার একমাত্র পথ কাপ্তাই ওয়াগ্গা ইউনিয়নের দেবতাছড়ির হয়ে বল্টুগাছ মোন। মোনের রাস্তা পায়ে হেটে বল্টুগাছ মোন পাড়ায় পৌছতে সময় লাগে ৩ ঘন্টা। তবে স্থানীয়দের সময় লাগে মাত্র দেড় দুই ঘন্টা।
যান চলাচলের জন্য কোন সড়ক নেই। আধুনিকতার কোন ছোয়াই লাগেনি মোন পাড়ায়। পুরো সড়কের দুপাশে ঝোপঝাড়।
কষ্ট করে মোনের চুড়ায় পৌছলে অতীতের সব কষ্ট ভুলে যাবে যে কেউ। রাঙামাটির প্রকৃতি যে কাউকে আনন্দ দেবে।
র‍্যান্যা টুগুন ইকো রিসোর্টের পরিচালক ললিত সি চাকমা বলেন, আমাদের ঘরের চাউনীর উপরে মেঘের ভেলা উড়ে তা আমরা দেখি না। আসলে বল্টুগাছ মোন পাড়ায় না গেলে বুঝা যাবে না রাঙামাটির প্রকৃতি কতটা সুন্দর।

তবে এ সুন্দর প্রকৃতি বল্টুগাছ মোন পাড়াবাসীর মনে কিছু সময়ের জন্য আনন্দ দিতে পারলেও এটি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না মোন পাড়ার মানুষ। তারা স্বপ্ন দেখেন যান চলাচলের সড়ক আসবে মোনের চুড়া পর্যন্ত। ক্যাবল কার দিয়ে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য মহুর্তে রাঙামাটি শহরে পৌছে যেত তাহলে তারা কত না সুখী হতেন। এমন স্বপ্নে দিন পার করেছেন যুগের পর যুগ।

পাড়ায় আছে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর ১৮ পরিবারের বসবাস। গ্রামের নেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই গ্রামের শিশুদের পড়তে হলে কাপ্তাই, কাউখালী বা রাঙামাটি সদরে আসতে হয়। দুরত্ব বেশী হওয়ার কারণে রাঙামাটির সাথে এদের আসা যাওয়া খুবই কম। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় সরকারী বেসরকারী সুবিধা পায় না এ গ্রামের মানুষ।
গ্রামবাসীর দু:খ তাদের বাড়ির থেকে তাকালে রাঙামাটি শহরকে খুব কাছে মনে হলেও চোখে দেখা সেই গন্তব্য পৌছতে সময় লাগে ৩-৪ ঘন্টার অধিক সময়। বর্ষাকালে এই পথ পিচ্ছিল হওয়ায় পুরো পথ হয়ে উঠে বিপদজনক। আছে মশা ও জোকের উপদ্রব।
গ্রামের কার্বারী (গ্রামপ্রধান) জ্যোতিষ তঞ্চঙ্গ্যা (৬৫) বলেন, ছেলে মেয়েরা ঘর থেকে বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করা সম্ভব নয়। তাই যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের বাইরে রেখে পড়াচ্ছেন। যাদের সামর্থ্য নেই তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।boltu-pic-5
গ্রামে রয়েছে নিরাপদ পানির সংকট। বর্তমানে ছড়াগুলো বৃষ্টি নির্ভর। বৃষ্টি কমে গেলে শুকিয়ে যায় ছড়া। সংকট বাড়ে খাবার পানির। ললিত তঞ্চঙ্গ্যা (৩৪) বলেন, এই গ্রামে কোন টিউবওয়েল বসানো সম্ভব নয়। শুকনো মৌসুমে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে।
গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি কাজ। পাহাড়ে তারা আদা হলুদ চাষ করেন। সম্প্রতি তারা বল্টুগাছ মোনের মাটিতে শুরু করছেন বিলাতী ধনেপাতা বীজ উৎপাদন। সফলতাও পাচ্ছেন। গ্রামের ধনেপাতা চাষী বাঁশি মোহন তঞ্চঙ্গ্যা (৩৫) বলেন, তিনি ৪০ শতক জমিতে ধনেপাতার বীজ বুনেছেন। এতে তার প্রায় দেড় লাখ টাকা খচর হয়েছে। এ থেকে তিনি ৪০ কেজি ধনেপাতার বীজ পাবেন। বর্তমানে এ বীজের বাজার দাম কেজিতে ৭ হাজার টাকা। তিনি বলেন, এই এলাকায় ফল বাগান করা হলেও যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় বাগানে নষ্ট হয় ফল। বাজার থেকে এক বস্তা চাউল আনতে বহন খরচ পড়ে ৫শ টাকা।
বঙ্গ মোহন তঞ্চঙ্গ্যা (৩৭) বলেন, বল্টু গাছ মোনে কৃষিজ যেকোন পণ্যর ভাল ফলন হয়। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় চাষীরা দাম পায় না। যাতায়াত ব্যবস্থার তুলনায় পণ্যর দাম নয় তারা বহন খরচটি পায় না।
মগবান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চাকমা বলেন, এলাকাটি তার ইউনিয়নে পড়েছে। এ গ্রামের মানুষরা সরকারী সুবিধা বলতে বল্টুগাছ মোন পাড়া বয়স্ক, বিধবা ভাতা পায়। ভিজিডি-ভিজিএফ চাল দেওয়া হয়। যারা এ সুবিধা পায় তাদের এসব আনতে গিয়ে যাওয়া আসা করতে এর চেয়ে বেশী টাকা খরচ হয়।
রাঙামাটি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান অরুন কান্তি চাকমা বলেন, বল্টুগাছ মোনের মানুষের সততা দেখে আমি মুগ্ধ হই। ঘন্টার পর পর পায়ে হেটে একটি ভোট দিতে তারা চলে আসেন বড়াদাম গ্রামে। তাদের ভোটে আমরা নির্বাচিত হই। কিন্তু বিনিময়ে তাদের কিছু দেওয়ার সম্ভব হয় না। তারা শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত।

Back to top button