মতামত ও বিশ্লেষণ

বঞ্চিত হচ্ছে পাহাড়ি জনগণঃ ইমতিয়াজ মাহমুদ

(১)
শোনেন, কিছু মনে করবেন না। আমার পাহাড়ের মানুষজন তো কিনা খানিকটা বঞ্চিত আছে, সেজন্যেই আপনারা যখন কোন কিছু নিয়ে ফুর্তি ফার্তা করেন তখন শুধু আমার এদের কথা মনে হয়।

গতকাল গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। আজ যখন ফিরেছি, ঢাকায় মহা উৎসব চলছে- ইউনেস্কো থেকে ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্বব্যাপী হেরিটেজ সংক্রান্ত কিরকম একটা ইয়ে হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে সেজন্যে এই উৎসব। আমাদের ৭ই মার্চের ভাষণ তো আমাদের বুকের ধন- আমরা এই উপলক্ষ্য সেই উপলক্ষ্য একটা কিছু হলেই এই ভাষণটি শুনি। মাঝে মাঝে আবার একটু চোখের পানিও ফেলি- কখনো আনন্দে কখনো ক্রোধে বা অহংকারে কখনো এমনিই। আমাদের তো ঐ একটাই ইয়ে, চোখের পানি। ভালোবাসা আর চোখের পানি। কথায় কথায় ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদি আর হাসি। তো জাতিসংঘ থেকে ৭ই মার্চের ভাষণকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থান দিয়েছে, একটু ফুর্তি আনন্দ তো জায়েজ আছেই আরকি। হোক।

ট্র্যাফিকে আটকে আছি, তখন মনে হলো। আচ্ছা, আমাদের পাহাড়ের মানুষদের নিয়েও তো এই জাতিসংঘ থেকেই দুই চারটা কথা বলা হয়েছিল। আপনারা কি সেই কথাটির কোন গুরুত্ব দিয়েছেন? না, ইউনেস্কো ইউনিসেফ বা এইরকম কোন সংস্থা থেকে নয়। খোদ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হয়েছে কথাগুলি- আদিবাসী মানুষের অধিকার নিয়ে ঘোষণা- আপনারা একটু গুরুত্ব দিয়েছেন সেইসব কথার? দেননাই। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ঘোষণাটি পাস হলো, আপনারা কি ঘোষণাটি একটু গুরুত্ব দিয়ে পড়ে দেখেছেন? দেখেননাই। উল্টা সরকারী আদেশ জারি করেছেন, আদিবাসীদেরকে আদিবাসী বলা যাবে না।

না, আমি জানি, বিত্তবানের ঘরের উৎসবে পার্বণে যখন রঙের ধারা উজ্জ্বল আলো হয়ে পুড়তে থাকে, দরিদ্র প্রতিবশিরা তখন নিজের অন্ধকার ঘরের কথা বলে না। বললে খারাপ দেখায়। আপনি যখন ফেলে ছড়িয়ে বিরিয়ানি খাবেন, দরিদ্র আত্মীয় এসে ক্ষুধার কথা বলে না। ভাল দেখায় না। আপনাদের উৎসব আনন্দ শোভাযাত্রা এইসবের মাঝখানে এইসব হতভাগা পাহাড়িদের কথা নিয়ে প্যানপ্যান করছি। বিরক্ত করছি মাফ করে দিয়েন।

(২)
দেখেন, জাতিসংঘের একটা সংস্থার একটা সিদ্ধান্ত আপনাদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে- আনন্দ ফুর্তি সংবর্ধনা সবকিছুই তো করছেন- গোটা সাধারণ পরিষদের কথার কোন গুরুত্ব দিবেন না? বাংলাদেশ আমেরিকা নিউজিল্যান্ড এইরকম কয়েকটা দেশ ছাড়া পৃথিবীর বাকি সব দেশ এই ঘোষণাটি সমর্থন করেছে। এইটা মানবেন না?

কি এমন ইয়ে চায় আদিবাসীরা। নিরাপত্তা চায়। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, নিজস্ব সংস্কৃতির নিরাপত্তা, সম্পদের নিরাপত্তা আর ভূমি অধিকার রক্ষার নিরাপত্তা। এটা কি এমন অন্যায় কোন আবদার। এই কথাটা বলা আছে জাতিসংঘের ঘোষণায়। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে বেচে থাকার এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নিরাপত্তা যায় যদি আদিবাসী জনগোষ্ঠী, সেটা মানতে আমাদের কি অসুবিধা? অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বিষয়টা কি? জোর করে একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আপনি বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে পারবেন না বা আশেপাশের বৃহৎ যেসব জনগোষ্ঠী আছে ওদের সাথে জোর করে মিশিয়ে ফেলতে পারবেন না। এটা কি কোন অন্যায় কথা? মোটেই না।

আরেকটা কথা আছে ঘোষণায়। এই যে আপনারা উন্নয়ন উন্নয়ন করেন, সেইটা নিয়ে। আদিবাসী কথাটার সাথে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কথা জড়িত থাকে। স্বতন্ত্র সংস্কৃতি মানে একটি দেশের মুল বা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তার থেকে ভিন্ন। আপনি যখন উন্নয়নের প্লাবন চালাবেন তখন এই বিশেষ সংস্কৃতির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আদিবাসীদের ভূমির ব্যাবহারের প্যাটার্ন, জীবনযাপনের ধরন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরন- উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে যে এইগুলি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সেজন্যে ঘোষণায় বলেছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড একটু চিন্তা ভাবনা ক্রে নিবেন, সতর্কতার সাথে নিবেন। এটাতে অন্যায় কি আছে? বলেন।

আর নিজেদের জীবনযাপন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রশাসন এইসব বিষয়ে আদিবাসীদের যেন নিজেদের একটু নিয়ন্ত্রণ থাকে। ব্যাস। এইটাতেও তো অন্যায় কিছু নাই। কিন্তু আপনারা এইসব কিছু মানবেন না। ও ভাই, জাতিসংঘের একটা সার্টিফিকেট নিয়ে লাফাবেন, আনন্দ করবেন, আর এইরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা প্রতিনিয়ত অস্বীকার করে যাবেন- একটু ভণ্ডামি হয়ে যাচ্ছে না?

(৩)
ভণ্ডামি আরও আছে। টেকসই উন্নয়ন বলে একটা কথা চালু হয়েছে। ইংরেজিতে বলে সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট। এইটা এখন মোটামুটিভাবে সারা দুনিয়াতেই একটা খুব চালু কথা। সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য বলে কতোগুলি লক্ষও ঠিক করেছে জাতিসংঘ থেকে। আমাদের সরকারেরও এই নিয়ে বেশ তৎপরতা আছে। তো ভালো কথা। সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্টের গোঁড়ার কথা তো হচ্ছে কাউকেই পেছেন ফেলে রাখা যাবেনা। মানে কিনা একটি দেশের সকলকেই উন্নয়নের কর্মপরিধির মধ্যে রাখতে হবে। আমাদের আদিবাসীদেরকে রেখেছেন সেখানে? ওদেরকে ওদের জন্যে যেটা উপযুক্ত ওদের জন্যে যেটা টেকসই সেই উন্নয়নের কথা ভাবেন? ভাবেন না।

আদিবাসীদেরকে তো সকল কর্মকাণ্ডে হিসাবেও ধরেন না। শুধু সরকার নয়, আপনারা যারা সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ বলে লোকজন আছেন, এনজিও বা বিদেশী সংস্থার সাথে কাজ টাজ করেন, আপনারাও তো আপানদের কাজে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব রাখেন না।

সেদিন এক আদিবাসী বন্ধু নারী নির্যাতন বিরোধী আইনের প্রয়োগ ইত্যাদি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিতে গেছেন। সেই প্রসঙ্গে পরে তিনি আমাকে বলছিলেন। আলোচনায় নানাপ্রকার তথ্য উপাত্ত ইত্যাদি নিয়ে দেশে নারী নির্যাতনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটা রিপোর্টের মতো উপস্থাপন করা হয়েছে। আমার বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করেছেন, এই রিপোর্ট তৈরি করতে কি আপানরা আদিবাসী নারীদের কথা আলাদা করে বিবেচনা করেছেন? উদ্যোক্তা সংস্থাটি একটি বিশাল গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা। সংস্থার দিশী কর্মকর্তারা ‘না মানে ইয়ে মানে না সেইভাবে ইয়ে করা হয়নি’ এইসব বলা শুরু করেছেন। হয়না। আপনারা সকলেই জানেন যে আদিবাসী নারীরা কিরকম নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু এইটা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলেন না। কেন?

আমার এই প্রিয় মাতৃভূমিতেই আমার দেশেরই একটা অংশে আমার দেশেরই একদল মানুষ ওদেরকে আমরা দমন পীড়ন করবো, আদিবাসী হিসাবে ওদের যে ন্যায়সঙ্গত অধিকার সেই অধিকারটুকু মানবো না, এইটা কি ধরনের কথা? সরকারের কথাটা না হয় বাদই দিলাম। সরকার তো সরকার। আপনি আমি যে সাধারণ মানুষ, আমাদের দায়িত্ব নাই। আপনি কি করেছেন? কখনো কি খোজটাও নিয়েছেন?

(৪)
এই দেখেন আজকে নারী ও নারী শিশুদের প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক দিবস। আপনি খবরের কাগজগুলি খুলে দেখেন। লোকজনের আলোচনা কথাবার্তা শুনে দেখেন। কাউকেই দেখবেন না বিশেষ করে আদিবাসীদের কথাটা, আদিবাসী নারীদের উপর যে মাত্রায় নির্যাতন হয় সেই কথাটা বলছেন না।

পাহাড়ের আদিবাসীদের উপর প্রতিনিয়ত যে অন্যায় আচরণটা হয় সেটা আপনি সেখানকার রোজকার ঘটনাবলীর খোঁজ রাখলে হয়তো খানিকটা বুঝবেন। কিন্তু ঘটনাবলী দিয়ে পুরো চিত্রটা বুঝতে পারবেন না। সাধারণভাবে আদিবাসীদের প্রতি বাঙালি পুলিশ বিজিবি সেনাবাহিনী সহ প্রশাসনের লোকজন যে আচরণ করে সেটা না দেখলে অবস্থার ভয়াবহতার মাত্রা বুঝতে পারবেন না। একটা উদাহরণ দিই।

ধরেন আপনি ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ছুটিতে গেছেন গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে। বন্ধুর সাথে মোটর সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন স্থানীয় বাজারে বা সেরকম কোন জায়গায় আড্ডা দিবেন বা চা ফা খাবেন। আপনাকে কি রাস্তায় কোন পুলিশের কনস্টেবল ‘এই থাম, কোথায় যাস’ এইরকম করে তুই তুকারি করে থামাবে? না। কোন কনস্টেবল যদি চুয়াডাঙ্গায় বা কসবায় বা ভেদরগঞ্জে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে বা মেয়ের সাথে এইরকম তুই তুকারি করে তাইলে সেই কনস্টেবলের খবর আছে। আমার পাহাড়ে কিন্তু এইরকম ঘটনা হর হামেশা ঘটে। আপনার পরিচিত কোন পাহাড়ি ছেলেমেয়ে থাকলে তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। কনস্টেবল বা সিপাই ধরনের লোকদের এইরকম তুই তুকারির মুখোমুখি ওদেরকে প্রায়ই হতে হয়।

কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া, মারপিট করা বা গণহারে গুলি করা বা বাড়িঘরে আগুন দেওয়া এইগুলি ঘটনা হয়তো প্রতিদিন ঘটে না। কিন্তু আচরণের এই যে তুই তুকারি টাইপের প্যাটার্ন, এইটা কিন্তু নৈমিত্তিক ব্যাপার। এটা তো আর খবরের কাগজে আসবে না, এর জন্যে মিটিং মিছিল মানববন্ধন হয় না। কিন্তু এই অসভ্যতাটা আমরা পাহাড়ে প্রতিদিন করি।

(৫)
না, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর একটা রেকর্ডে বিশেষ মর্যাদায় লিখেছে, সেটা নিয়ে আপনারা আনন্দ করতে চান, করেন। আমার কথা যদি শুনতে চান, তাইলে আমি বলবো যে ৭ই মার্চের ভাষণ মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ। ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বক্তৃতা। গুরুত্বে দিক দিয়ে এটা গেটিসবার্গের বক্তৃতাটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইউনেস্কো এই কথাটা রেকর্ড করে আমাদেরকে কোন ইয়ে করেনাই। ইউনেস্কো ইউনেস্কোর দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। তবুও আনন্দ করতে চান, করেন।

কিন্তু আমার পাহাড়ে যে অন্যায় হচ্ছে সেটা যদি আপনি দেখতে না পান, তাইলে এইসব আনন্দ উল্লাস শোভাযাত্রা এইগুলি কি একরকম ভণ্ডামি হয়ে যাচ্ছে না? জাতিসংঘের একটা সংস্থার একটা দায়িত্বপ্ল্যাঙ্কে নিয়ে এতো উল্লাস, আর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রকে মানবেন না বলে পণ করে বসে থাকবেন, এইটা কি মিলল!
…………………………….
ইমতিয়াজ মাহমুদ, লেখক ও আইনজীবী

Back to top button