জাতীয়

প্রয়াত হলেন বর্ষীয়ান বাম নেতা ও লেখক হায়দার আকবর খান রনো

আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা):  মারা গেলেন দেশের  প্রবীণ রাজনীতিক, তাত্ত্বিক ও বামনেতা এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা হায়দার আকবর খান রনো। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসধীন অবস্থায় শুক্রবার রাত ২টা ৫ মিনিটে মারা গেছেন প্রখ্যাত এই রাজনীতিক। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

নানা সূত্রে জানা যায়,  দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসতন্ত্রের নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। গত ৬ মে পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। সেখানেই মধ্যরাতে মারা যান তিনি।

প্রবীণ এই রাজনীতিকের শারীরিক অবস্থা জানিয়ে গত ৭ মে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিলেন।
সেখানে তিনি বলেছিলেন, “রাজনীতিবিদ ও লেখক হায়দার আকবর খান রনোর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বাড়ছে। তাকে এইচডিইউতে রেখে বিশেষ পদ্ধতিতে অক্সিজেনের যোগান দেওয়া হচ্ছে।”

এদিকে পরিবারের সদস্যরা দেশের বাইরে থাকায় হায়দার আকবার খান রনোর মরদেহ সোমবার পর্যন্ত শমরিতা হাসপাতালের মর্গে রাখা হবে বলে জানা গেছে।

স্বজনরা দেশে ফিরলে শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নেয়া হবে এই প্রবীণ রাজনীতিকের মরদেহ। এরপর বনানী কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে তাকে।

হায়দার আকবর খান রনো।

উল্লেখ্য হায়দার আকবর খান রনোর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩১ অগাস্ট কলকাতায়। তার পৈতৃক নিবাস নড়াইলের বরাশুলা গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হায়দার আকবর খান রনো ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন। ছিলেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক। তাছাড়া ৯০ দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনসহ এরশাদ পতনের গণঅভ্যুত্থানেরও একজন বলিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন। রনো বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকলেও ২০১০ সালে মতভিন্নতার কারণে এই দলটি ছেড়ে সিপিবিতে যোগ দেন। ২০১২ সালে তাকে সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। এরপর তিনি সিপিবির উপদেষ্টা হন।

তবে রাজনীতিকের পরিচয়ের বাইরেও তিনি তাত্ত্বিক ও লেখক হিসেবে বেশ সমাদৃত। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৫। বইগুলোর মধ্যে অন্যতম হল শতাব্দী পেরিয়ে, ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর, মার্কসবাদের প্রথম পাঠ, মার্কসীয় অর্থনীতি, গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাঁধো, মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম, কোয়ান্টাম জগৎ- কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন (বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত), রবীন্দ্রনাথ শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ, বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড), পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড),  স্তালিন প্রসঙ্গে (পুস্তিকা), অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট (পুস্তিকা)। এছাড়া তাঁর সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে অন্যতম-১) মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীরা, ২) নারী ও নারীমুক্তি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক:

এদিকে এই বাম নেতার মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই শোক জানাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট লেখক মহিউদ্দীন আহমেদ স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “ডাউন টু আর্থ মানুষ ছিলেন। মন খুলে কথা বলতেন। আমাকে খুব পছন্দ করতেন। প্রথম পরিচয়েই তিনি তাঁর ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইটি আমাকে গিফট করেছিলেন। বইটি খুব কাজে লেগেছে। আমার বেশ কয়েকটি বইয়ে এটি থেকে উধৃতি দিয়েছি।”

তিনি আরো লিখেছেন, “শেষ সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় খুব অসুস্থ ছিলেন। এক হাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার ধরে ঘরের মধ্যে হাঁটাহাটি করতেন। এর আগেরবার যখন হাসপাতালে গেলেন, তখন তাঁর অবস্থা বেশ খারাপ। কিন্তু তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও চলে গেলেন তাঁর ছোট ভাই জুনো। এবার তাঁর আর ফেরা হলো না।পলিটিশিয়ান আর ভদ্রলোক সচরাচর একসঙ্গে যায় না। তবে তিনি ব্যতিক্রম। আপাদমস্তক এই ভালো মানুষটিকে আর পাব না। তিনি থাকবেন আমার স্মৃতিতে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক  ও লেখক ড. আসিফ নজরুল লিখেছেন, “তিনি আপাদমস্তক সৎ এবং আদর্শবান রাজনীতিক ছিলেন। ভালো মানুষ ছিলেন। আমার ভালবাসা আর শ্রদ্ধা।”
বিশিষ্ট আইনজীবি জেড আই খান পান্না বলেন, “ইতিহাসের একজন স্রষ্টা হায়দার আকবর রনোভাই আজ রাতে পরলোক গমন করেছেন।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম লিখেছেন, “কমরেড রনো ছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক। রনো ও তাঁর সহযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গঠিত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে ১৪টি আধামুক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলো। রনো এই সকল ঘাঁটি অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং রাজনৈতিক নির্দেশনা দিতেন। এই সংগঠনের প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই অঞ্চলগুলোতে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন শতাধিক। রনো ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ১৯৯০ সালের গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার।“

Back to top button