শিল্প ও সংস্কৃতি

প্রয়াত হলেন পাহাড়ের গুনী শিল্পী রূপায়ন দেওয়ান: শুন্যতা পুরণ হবার নয়, বলছেন বিশিষ্টজনরা

সতেজ চাকমা:  প্রয়াত হলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের গুনী শিল্পী রূপায়ন দেওয়ান (রাঙা)। আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ইংরেজী সকাল ৭.০৫ টায় তিনি রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে মারা যান। আগামীকাল রাঙ্গামাটিতেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে বলে আইপিনিউজকে নিশ্চিত করেছেন প্রয়াতের ভাতিজা প্রবাল দেওয়ান (তুমনি)।

রূপায়ন দেওয়ান(রাঙা)র প্রয়াণে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে শোক। পাহাড়ের বহু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, লেখক, বিশিষ্টজন ও তরুণরা শোক জানিয়ে ফেসবুকের ওয়ালে এই গুনী শিল্পীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন। এ নিয়ে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায়ের সাথে মুঠোআলাপ হল। আইপিনিউজকে তিনি বলেন, “রূপায়ন দেওয়ান(রাঙা) আমার চেয়ে বয়সে কিছুটা বড় ছিলেন। তবে আমরা ছিলাম সহপাঠীর মত। একসাথে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ব্যাচেলরও পড়েছিলেন তিনি। তবে শেষ করতে পারেননি একটুর জন্য।”

স্মৃতিচারণ করে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় আরো বলেন, “সেই আশির দশকে আমরা রূপায়ন দেওয়ানসহ একটু একটু করে গিটার শিখতাম। সেসময় তো গিটার খুব কমই দেখা যেত। রাঙ্গামাটি’র খোলামাঠ কিংবা স্ট্যাডিয়ামে কনসার্ট আয়োজন করতাম। তখনতো গেংহুলী বাদে চাকমা’দের তেমন কিছু ছিলনা। রঞ্জিত আজু (শিল্পী রঞ্জিত দেওয়ান)দের একটা গানের ধারা ছিল। তবে  মর্ডান ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে চাকমা গান রচনার নতুন যে ধারার সূচনা হয়েছে তার প্রথম সারির নেতৃত্বে ছিলেন প্রয়াত রূপায়ন দেওয়ান। গীতিকার, সুরকার এবং সর্বোপূরী একজন শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন অতুলনীয়।”

সঙ্গীত শিল্পী রূপায়ন দেওয়ান।

ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায় আরো বলেন, “আশির দশকে গেংহুলী শিল্পীগোষ্ঠী যখন প্রতিষ্ঠা করি, তখন তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং আমি সভাপতি। এ দিক দিয়ে তিনি একজন সঙ্গীত ও শিল্পী সংগঠকও। একসময় তিনি রাজদ্বীপ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় (বর্তমানে নাম পরিবর্তিত) এর ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।এভাবে তিনি আমাদের সমাজে নানাভাবে অবদান রেখে গেছেন।”

এদিকে কথা হয় বিশিষ্ট শিল্পী কালায়ন চাকমা’র সাথে। শোক জানিয়ে তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি পাহাড়ে তিনি ছিলেন প্রথম দিককার একজন কি-বোর্ডিস্ট। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা আদিবাসীদের গানের আদি ধারা গেংহুলী সাথে সমন্বয় করে আধুনিক ধারার সুর রচনা করতে রূপায়ন দেওয়ান ছিলেন বেশ পারদর্শী । বহুজন সুরারোপ করলেও তাঁর সুর রচনায় তিনি নিজের শেকড়েকেই খুঁজতেন সবসময়। পাহাড়ের শিল্পী হিসেবে এটাই ছিল তাঁর মৌলিকত্ব।

শিল্পী রূপায়ন দেওয়ান (রাঙা)

এদিকে কিংবদন্তী শিল্পী রঞ্জিত দেওয়ান আইপিনিউজকে বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে শিল্পী হিসেবে নিজের বিকল্প একমাত্র নিজেই ছিলেন রূপায়ন দেওয়ান। কেবল শিল্পী হিসেবে নয় আত্মীয়তার দিক দিয়েও তিনি ছিলেন আমার ঘনিষ্ট। কথা ও সুর রচনায় তিনি বেশ অবদান রেখে গেছেন। তবে আমি মনে করি, তিনি যদি আরো সচেষ্ট থাকতেন নতুন কিছু দিয়ে আমাদের সমাজ, দেশ ও জাতিকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারতেন। তাঁর এই চলে যাওয়া আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি।”

উল্লেখ্য, রূপায়ন দেওয়ান রাঙা ১৯৫৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটিতে জন্মগ্রহন করেন। দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তাঁর মৃত্যুর মাত্র নয় মাস আগেই তাঁর সহধর্মিনী পুষ্পিতা চাকমা পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তিনি দুই পুত্র ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। “মা হোচপানা সান সংসারত হিচ্ছু নেই”, “ওই আগাজর বার্গী পেক অদং”, “যুদি চোগ ন তুলজ দুয়ারান ন হুলজ”, “গদা আন অবার পরেন্দি”, “আজার বজর ধুরি ইদু আগং মুই”, “মনান যেদ চায় সিদু”, “মর মরানার পর”সহ নানা শিরোনমে বহু গান ও সুর রচনা করে গেছেন তিনি। পাহাড়ের জুমিয়া জীবনবোধ, তাঁদের সুখ- দুঃখ, মিলন, বিরহ, সংগ্রাম ও প্রাণ-প্রকৃতির সামগ্রিকতাকে কথা ও সুর দিয়ে তৈরী করে গেছেন বিশাল এক সৃষ্টির ভান্ডার।

Back to top button