পোশাকি মানবতাবাদীদের আত্মপ্রচারণাঃ দীপায়ন খীসা
২জুন রাঙ্গামাটির লংগুদুতে পুড়ে ছাই করে দেয়া হলো ২৫০-এর অধিক বসতবাড়ী। অভিবাসী বাঙালিরা প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় এই অপকর্ম সম্পন্ন করে প্রকাশ্য দিবালোকে। তার রেশ কাটতে না কাটতেই রাঙ্গামটিতে ব্যাপক পাহাড় ধস। ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতিসহ মৃত্যুর মিছিল। কোথাও পুরো পরিবার, কোথাও আলিঙ্গনবদ্ধ সন্তানসহ জননীর মরদেহ। ধ্বংস স্তুপের নীচে শুধু নিথর প্রাণের পাহাড়। এই দুর্যোগও শুধু প্রাকৃতিক নয়। এখানেও অভিবাসী বাঙালিদের দায়ভার রয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর কাদেরও সেই কথাই বলেছেন। এই সেটেলার জনসংখ্যার কারণে রাতারাতি বদলে যায় পাহাড়ের জনমিতি। বদলে যায় পাহাড়ের প্রকৃতি। সুবজ পাহাড় হয়ে যায় বৃক্ষরাজিহীন। চারিদিকে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠে। জনমিতি পরিবর্তনের স্রোত ৮০-র দশকে শুরু হলেও বর্তমান অবধি তা প্রবাহমান। তাই ওবায়দুর কাদের সাহেব বিএনপির ঘাড়ে এই দোষ চাপালেও একই দোষে তিনিও দুষ্ট। চলতি লেখাতে অবশ্য সেই বিষয়ে আলোকপাত করা হচ্ছেনা। লংগুদুর পোড়া বসতি আর পাহাড় ধসে চাপা পড়া ধ্বংস স্তুপ নিয়ে কিছু কর্মকাণ্ড- এই রচনাটি লিখতে আমাকে প্ররোচিত করেছে।
এই দুই ঘটনায় মানবিক বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ে আক্রান্ত মানুষের পাশে অনেকে দাঁড়িয়েছেন কিংবা এখনও দাঁড়াচ্ছেন। এটাও মানুষের সহজাত মানবিক প্রবৃত্তি। এই ধামে অমানুষ যেমন রয়েছে তেমনি মানবিক বোধ সম্পন্ন অগণিত মানুষও দেখা মিলে। তাইতো সেটেলার বাঙালিরা ঘর পোড়ায় আবার বিবেকের তাড়নায় অনেকে বাঙালি ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। তবে হাল নাগাদ পাহাড়ী মানুষদের মধ্যে কিছু মানবতাবাদীর উদয় হয়েছে। মূলতঃ এই মানবতাবাদীদের জন্যই চলতি রচনা। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, আক্রান্তদের সহায়তা করা মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তিকে অনেকে প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এই প্রচারণাটা অনেক বেশি দৃশ্যমান। আমরা দেখছি অনেকে সহায়তা চেয়ে ইভেন্ট খুলছেন, বিকাশ নম্বর দিচ্ছেন, তারপর আক্রান্ত জনপদে যাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে ব্যানার টাঙাচ্ছেন, আক্রান্ত মানুষদের হাতে নগদ টাকা আর অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে দিচ্ছেন। সাথে আবার সেটা ক্যামেরাবন্দি করছেন। সেই ছবি আবার ফেসবুকে দিয়ে দিচ্ছেন। এই বিষয়টা আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অনেকে বলবেন-এটাতো ঠিক কাজ। তারাতো মহৎ কাজই করছেন। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি মহৎ ও মানবিক মনে হতে পারে। এই যাদের জন্য এই সহায়তা আপনি করছেন তাদের জন্য বিষয়টি কতটুকু সম্মানের সেটাও অবশ্য বিবেচ্য। ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে, পাহাড় ধসে আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন, তাই বলে তাদের আত্মমর্যাদা পুড়ে গেছে কিংবা ধসে পড়া মাটিতে মানসম্মান চাপা পড়ে গেছে সেটা যারা মনে করছেন তারা আক্রান্ত মানুষকে সহায়তার বদলে উপহাসই করছেন। যারা মানবতার নামে এই উপহাস করছেন এই রচনা সেই কথিত মানবতাবাদীদের জন্য। ফেসবুকের কল্যাণে একটি পোস্ট আমার চোখে পড়েছে। একটি কথিত গ্রুপের দুই সদস্য ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ লিপিবদ্ধ করছেন। কিন্তু তাদের টাইম লাইনে তারা লিখছেন কিভাবে সেই পরিবারটি মাটিতে চাপা পড়ে ছিল, কিভাবে পাহাড় ভেঙে পড়লো, কিভাবে পরিবারটি উদ্ধার হলো সেই বিষয়গুলো তারা লিপিবদ্ধ করছেন। লম্বা একটা বেঞ্চ বসানো, সেই বঞ্চে বসে অতি উৎসাহের সাথে এই গল্প তারা লিখছে। আর তা ভাইরাল জগতে ছড়িয়েও দিচ্ছেন। এই যদি হয় ক্ষয়ক্ষতি লিপিবদ্ধ করার নমুনা তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেই। মনে হচ্ছে তারা কোন গল্প সংগ্রহ করছেন। দুর্গত মানুষের কাছে তারা বেদনার গল্প শুনছেন না ক্ষতির পরিমাণ নিরূপন করছেন? এইটুকু পরিমিতবোধ যাদের নেই তারাই এখন মানবাতার ধব্জা উড়াচ্ছেন। ব্যক্তি উদ্যোগ থাকবে। বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকে কাজে নামবেন। কিন্ত সেই তৎপরতাকে আমরা সমষ্ঠিতে রূপান্তরিত করতে কতটুকু উদ্যোগি হয়েছি। রাঙ্গামাটির জ্যেষ্ঠ নাগরিকগণ ব্যক্তি ও বিভিন্ন সামাজিক সেচ্ছাসেবী সংগঠন সমূহের উদ্যোগকে একত্রিত করার এক মহৎ কর্মসূচী হাতে নিয়েছেন। ছড়িয়ে ছিটানো গুচ্ছ গুচ্ছ কার্যক্রমকে একীভূত করে সমন্বিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। মুঠো মুঠো সংগ্রহকে জড়ো করে সহায়তাকে যতটুকু সম্ভব বড় আকার দিতে তৎপর রয়েছেন। খাগড়াছড়িতে একই কার্যক্রম চলছে। কিন্তু আমরা পর্যবেক্ষণ করছি জ্যেষ্ঠ নাগরিকবৃন্দের সমন্বিত কার্যক্রমে শামিল হতে অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সমষ্ঠির নিকট সমর্পিত না হয়ে তারা ব্যক্তি প্রচারণাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। দুর্গত মানুষের সাথে সেলফি তুলছেন, ত্রাণ বিতরণ করছেন, দু-এক ব্যাগ কাপড় সংগ্রহ করে সেই ছবি দিয়ে ভি চিহ্ন দিয়ে অনেকে ফেসবুকে পোস্ট দিতেও দ্বিধা করছেন না।
এহেন প্রচার সর্বস্ব সেলফিবাজ মানবতাবাদীরা আবার নানান প্রশ্নও ছুঁড়ে দেন। প্রথমত নিজেদের উদ্যোগকে জাহির করেন আবার নিজেরাই প্রশ্ন করেন রাজনৈতিক কর্মীরা চুপ কেন? তাদের একজনকে বলা হয়েছিল আপনার উত্তোলিত টাকাটা সমন্বিত তহবিলে জমা দিলে অংকটা আরও বড় হতে পাতো। কিন্তু তিনি পাল্টা যুক্তি দিলেন, কাউকে ভরসা করা যাচ্ছেনা। এ কি ধৃষ্ঠতা? নিজেকে ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা রাখতে না পারা সমষ্ঠিকে অস্বীকার করা। এই কথিত মানবতাবাদীরা এইভাবে সামগ্রিকতাকে বাঁধাগ্রস্থ করছে। সেই সাথে ইতিহাসকেও স্বীকার করতে তাদের বড়ই অনীহা। মনে পড়ে শৈশবে মহালছড়ির ভুয়াটেক দাদুদের গ্রামে কাউখালির কিছু উদ্বাস্তু পরিবার এসেছিলেন। তাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় দাদুদের গ্রামে থাকতেন। কিন্তু গ্রামবাসী সেই উদ্বাস্তুদের নিরাশ করেন নি। পরম মমতায় গ্রামে বসতি করার জায়গা দিয়েছিলেন। উৎসুক শিশুমন সেদিন সেই উদ্বাস্তুদের চোখভরা কৌতুহল নিয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল। পাহাড় ধস বিষয়টা নতুন হলেও সেটেলার আগুনে জুম্ম জনপদ পুড়ে যাওয়া, সেনা অত্যাচারে বসত-ভিটা হারানোর ঘটনা পাহাড়ে নতুন নয়। বসত-ভিটা হারানো মানুষ নতুন ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে জীবনের প্রয়োজনে। কিন্ত মানুষ অনাহারে মরেনি। কারণ কেউ না কেউ এই নিঃস্ব মানুষের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন। সেলফিবাজ মানবতাবাদীরা এই সত্যটুকুও কি বেমালুম অস্বীকার করবেন। মনে পড়ে বান্দরবানের ১৯৯৫ সালের ১৫মার্চের কথা। সেই দিনও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় বাঙালিরা শহরের পাহাড়ী গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত শহরবাসী সরকারি ত্রাণ প্রত্যাখান করেছিল। বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটির মানুষ বান্দরবানবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময় তো আর ফেসবুক ছিলনা, মুঠোফোনও ছিলনা। তাই বলে কি মানবতা ছিল না? পাহাড়ে শাসকগোষ্ঠী অনেক রক্ত ঝড়িয়েছে। শুন-শান করেছে অনেক জনপদ। কাউখালী, লংগদু, ভূষণছড়া, লোগাং, নান্যাচর এইরকম কত গণহত্যায় অগণিত মানুষের তাজা রক্ত পাহাড়ী জনপদে বয়ে গেছে। পুড়ে ছাড় খার করা হয়েছে কত সমৃদ্ধ বসতি। শরণার্থীর- স্রোত পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সময় কি সর্বস্ব হারানো, জীবন নিয়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষের পাশে কেউ দাঁড়ান নি। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুুদ্ধে আত্মহুতি দেয়া সেই বীর গেরিলাদের স্বজনদের খোঁজ কি কখনও নিয়েছেন সেলফিবাজ মানবতাবাদীরা। গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের বীরযোদ্ধা ৭০ বছর বয়সেও তারুণ্যের অমিত তেজে জীবন দান করেছিলেন সেই বড়দ্বাজ মনি। ক্যজাই, নিতীশ, অমর, সুকেশ, মনতোষদের তাজা রক্তের প্রবাহ কি কোনদিন আপনাকে ডেকেছিল হে নব্য সেলফিবাজ মানবতাবাদী?
এই রকম হাজারো প্রশ্ন পোশাকি মানবতাবাদীদের উদ্দেশ্যে অনেকে ছুঁড়ে দিতে পারেন। তখন কি উত্তর দিবেন। নিকট পরিচিত একজনের উদ্বতপূর্ণ পোস্টও পড়েছি। প্রবাসী হতে পারতেন, রাজধানীতে আয়েশি জীবন যাপন করতে পারতেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তিনি সব ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে আর্তমানবতার সেবা করছেন এই রকম আরও কত কি? মনে হবে তিনি বিশাল ত্যাগ শিকার করে মাদার তেরেসা হয়েছেন। এ যেন সেই কবিতার পংক্তিমালা,“ শৈবাল দীঘিরে বলে, লিখে রাখো দিলাম তোমায় দু ফোঁটা শিশির।” জীবন যার দীঘির জলে কাটে সে শৈবাল যদি দীঘিকে দু ফোঁটা শিশির লিখে রাখতে বলে তাহলে কি দাঁড়ায়। হাল নাগাদ অবির্ভাব হওয়া পোশাকি মানবতাবাদীদের আচরণও শৈবালের ন্যায়। তাপররেও কথা থেকে যায়। এই পোশাকি সেলফিবাজ মানবতাবাদীদের দৌরাত্ম্যের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা মানবতাকে হারিয়ে যেতে দেন নি। আমার অনুজ এক জন, কিছুদিন যার গৃহশিক্ষক ছিলাম। লংগুদুর জন্য ভালো একটা অংকের সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু বারংবার বলেছেন তিনি নিভৃতে এই সহায়তা দিতে পছন্দ করেন। দুইটি মানবতাবাদী প্রতিষ্ঠানের কথা জানি, যারা লংগুদুর জন্য তাৎক্ষণিক দুই লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিলেন। রাঙ্গামাটির নাগরিক কমিটির কাছে আনুষ্ঠানিক চেকও হস্তান্তর করেন নি। পাশে যদি দেরি হয়ে যায়। প্রচারবিমুখ এই মানবাতাবাদীরা আছে বলেই এখনও মানব সেবার মহান কার্যক্রমকে চালু রাখা গেছে। সেলফিবাজ পোশাকি মানবতাবাদীরা যতই আত্মপ্রচার চালিয়ে আত্মতুষ্ঠিতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলুক না কেন তারা দীঘি নয়, দীঘি আশ্রয়ী পরজীবী শৈবাল এটাই চিরন্তন সত্য।
দীপায়ন খীসা, তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম