পীরেনের দেশে আদিবাসী জীবন: মান্দিরা ভালো থেকো
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2020/01/p-3.jpg)
সতেজ চাকমা: মান্দি মানে মানুষ। বাংলাদেশের গারো আদিবাসীরা মান্দি নামেই নিজেদেরকে পরিচয় দেয়। বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়, টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়, শেরপুর সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই মান্দিদের বাস। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অন্যসব আদিবাসীদের মত তাঁদের সাথেও আমাদের পরিচয় লড়াইয়ের মাঠে। এ লড়ায় মূল স্রোতধারার আগ্রাসী সংস্কৃতি তথা বিশ্বায়নের প্রভাবে আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়ে হারিয়ে যেতে থাকা নিজেদের পিনোন,খাদি,দকমান্দা,দকশাড়ী,দামা, খ্রাম,নাথুক, ইজোর,হুত্তি,ককবরক, অঝাপাত রক্ষার লড়াই।আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সাংঘিক মেলবন্ধনে, বিশ্বাসের অটুট বাতাবরণে বন-পাহাড় ও প্রকৃতির সাথে সহজ-সারল্যে গড়া জীবনগুলো যাপনের জন্য একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আমরা যে পথে সুন্দর দেশ ও পৃথিবী গড়বার আয়োজনে মিলিত হয়েছি সে আয়োজনে অলীক মৃ, নিপন ত্রিপুরা, সুনয়ন চাকমা, রাতুল তঞ্চঙ্গ্যা, চ্যংইয়ং ¤্রাে, বাদল হাজং’রা একে অপরের বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। তাঁরা বন্ধু হতে চাই রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে।প্রত্যক্ষভাবে জীবনে জীবন মেলাবার খায়েসে টাঙ্গাইলের মধুপুরে মানুষ নামে পরিচয় দেয়া ‘মান্দি’দের সাথে বিগত বছরের সেপ্টেম্বরে কাটিয়ে এলাম কিছুদিন। প্রকৃতির সারল্যে আঁকা মঙ্গোলয়েড চেহারা অধ্যুষিত এই শাল বনের জনপদে আমি যাদের সাথে গিয়েছিলাম তাঁদের অনেকের নাম একটু আগে উল্লেখ করলাম।বনের মধ্যে এই জনপদে আমরা যারা মান্দিদের মাটির ঘরে আথিতেয়তা নিয়েছিলাম তাঁদের নিশ্চয় একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে যে তাঁরা কত আপন মনে আমাদের গ্রহন করেছে আর অনেকেই নিখাদ মননে জিজ্ঞেস করেছে- নামি ডঙা ? মানে, কেমন আছো। আমরা নিশ্চই বলেছিলাম- ভালো আছি। তবে আসলে ভালো আছি কী না সেটা নিশ্চিত হতে একটু সময় দরকার।এখন তো ২০২০!
সে যাই হোক, মাটির ঘরে বাস করা অনেক ‘মান্দি’ বন্ধুর কাছে আমি জানতে সক্ষম হয়েছি বৃটিশ চলে যাওয়ার পরে ১৯৫০ সালে পাক’রা যখন আইন করে মধুপুরের শালবনে জুম চাষ বন্ধ করে দেয় তখন থেকেই বদলে যেতে থাকে এই মানুষদের উৎপাদন পদ্বতি।রাষ্ট্র ‘আইন’কে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে এইসব বন্ধুহীন মানুষকে আরো দূরে ঠেলে দেয় এবং প্রান্তিক থেকে আরো প্রান্তিক করে তোলে। এই বননির্ভর মানুষ যে বিস্তৃত শালবনকে নিজেদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে দামা,খ্রাম বাজিয়ে ‘ওয়ানগালা’ উৎযাপন করে তাদের বিশ্বস্ত ফসলের দেবতা ‘মিসি’ ও ‘সালজং’কে জুমে উৎপাদিত ফসলাদি উৎসর্গের মধ্যে যে কৃতজ্ঞতাবোধ ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করত সেই প্রশান্তি ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যেতে থাকে। ১৯৬২ সালে রাষ্ট্রের তৎকালীন বনবিভাগ মধুপুরের বিস্তৃত শালবনকে ‘ন্যাশন্যাল ফরেষ্ট’ হিসাবে ষোষণা করে এইসব মাটির মানুষদের ভূমিগুলোকে রাষ্ট্রীয় করায়ত্বে নিয়ে আসে। মান্দি অধ্যুষিত এই বিস্তৃত এলাকা যেটাকে ন্যাশন্যাল ফরেষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে তার আয়তন হিসেব মতে ২০,৮২৭.৩৭ একর। রাষ্ট্রের মালিকানায় নিয়ে আসা মান্দিদের এই বন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্র সেখানে পাহাড়াদার নিয়োগ করে ‘বন কর্মকর্তা’র বেশে। কিন্তু আসলেই কী তারা রক্ষকের ভূমিকায় আছে! আদিবাসীদের একটাই সমস্যা এবং অপরাধ।সেটা হল তাঁরা খুব সরল,সাদাসিদে। নিজেদের জমি চিনিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁদের কংক্রিটের তৈরী কৃত্রিম দেওয়ালের দরকার পড়ে না। দরকার পড়ে না কোনো কাগুজে দলিল দস্তাবেজের। নিজেদের পারষ্পপরিক বোঝাপাড়া এবং পারষ্পরিক বিশ্বাস,শ্রদ্ধাবোধ এবং ‘কথায় কথা রাখার’ প্রথায় হল তাঁদের আসল দলিল দস্তাবেজ এবং এই পারষ্পরিক ‘বিশ্বাস’এর দেয়াল কংক্রিটের দেয়ালের ্ঋদ্ধতা থেকেও বেশী টেকসই। যার জন্য আদিবাসীরা তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেয় এভাবেই ‘বন যতদূর ঠিক ততদূর আমার বাড়ী’। কিন্তু রাষ্ট্র নামের যন্ত্রটা যে মানতেই চাইনা এই সরল বিশ্বাসের প্রতিশ্রুতি। তথাকথিত ‘আধুনিক’ এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় কাগুজে দলিলের দরকার পড়ে নয়তো ঘোষণা দিয়ে ফেলবে ‘খাস’ আর এই সুযোগে জমি কেড়ে নিবে। সরল বিশ্বাসে যে অবিশ্বাসের বিষ ছড়িয়ে রাষ্ট্র আদিবাসীদের পর করে ছাড়ে। যার জন্য পাহাড়ে’র যত সমস্যা আর সমতলের আদিবাসীদের বেহাল দশা। আমিও শালবনের জমি হারানো ‘মান্দি’ বন্ধুদের বলে এসেছি ১৯৬০ সালের কাপ্তাই বাঁধের কথা। আমার পূর্বপুরুষদের বাস্তুভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পরদেশে শরনার্থী জীবনের নির্মমতার কথা। হৃদের জলে জীবন ছন্নছাড়া হয়ে যুথবদ্ধ পথচলায় যে ফাটল পাহাড়ের মানুষদের জীবনে রাষ্ট্র ধরিয়েছিল উন্নয়নের নামে সে উন্নয়নের অন্য মডেলের কথা আমি শুনে এসেছি মধুপুরের এইসব সরল মানুষদের মুখে।
অনেকদিন ধরে বনে যাওয়া হয়নি তাঁদের।বিষয়টি আন্দাজ করেছিলাম এভাবে। আমাদের পাহাড়ে (পার্বত্য চট্টগ্রাম) পাহাড়ী মানুষদের কাছে বাঁশের কচি ডগা ‘বাচ্চুরি’ বেশ প্রিয় ব্যঞ্জন। কিন্তু বন রক্ষার প্রয়োজনে বাঁশ যেন গজাতে পারে সেজন্য এলাকার সকলের সার্বজনীন সম্মতিতে কিছু সময় এই বাচ্চুরি খাওয়া বন্ধ থাকে বা বাঁশ সংগ্রহ বন্ধ থাকে। আদিবাসীরা বন থেকে যেমন নিজেদের নানা ধরণের প্রয়োজন মিটিয়ে নেয় তেমনিভাবে এই বন রক্ষার প্রয়োজনে নানা উদ্যোগেও সামিল হন সামগ্রিকভাবেই। এধরণের উদ্যোগে হয়ত মধুপুরের মান্দি’রাও বনে যায় নি কিছু সময় ধরে।এর ভিতরে বনবিভাগ কংক্রিটের দেয়াল তৈরী করে ফেলেছে গহীন বনের ভেতর। ‘ইকো পার্ক’ এর নাম দিয়ে রাষ্ট্রের বনবিভাগ সেখানে প্রকৃতির মধ্যে কৃত্রিমতার দেয়াল তৈরী করে আবারো আদিবাসীদের জমিতে তৈরী করতে যাচ্ছে এই প্রকল্প। যে পার্কে ঢুকতে কাগজের টাকা পে করতে হবে এবং বের হতেও এই কৃত্রিম বস্তুটির দরকার পড়বে। যে বনকে আদিবাসীরা মা’ মনে করে সেটার বিস্তৃত সমগ্র পৃষ্ঠকে নিজেদের বাড়ী মনে করে এবং অবাধে বিচরণ করতে পারে সেখানে কৃত্রিম দেয়াল তৈরী করে এই অবাধে পদচারণার মধ্যে বাঁধা তৈরী করার রাষ্ট্রীয় প্রয়াসকে মেনে নিতে না পেরে ‘ইকো পার্ক’ বিরোধী আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে ২০০৪ সালে শহীদ হন ‘পীরেন স্নাল’। যে স্থানে পীরেনকে হত্যা করা হয় সেটি স্থানীয় মান্দিদের কাছে ‘পীরেনের খিম্মাহ’ নামে পরিচিত। খিম্মাহ মানে সমাধি। এই সমাধির স্থল এখনো বাস্তুভূমি থেকে উচ্ছেদের আশঙ্খায় থাকা মান্দিদের কাছে এক অনুপ্রেরণা।
এই সমাধিস্থল ঘুরে এসেছিলাম বিগত সেপ্টেম্বর ’১৯ এ। বনের মধ্যেই স্মৃতিসৌধ। গহীন এ বন ডিঙিয়ে গিয়েছিলাম সাধুপাড়া নামে সেই গ্রামে।টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার তেলকি গ্রাম থেকে আমরা রওনা হয়েছিলাম সাধুপাড়ার দিকে। মান্দি বিয়ে দেখতে ও উপভোগ করতে এবং সেইসাথে মান্দিদের সাথে কিছু সময় কাটাতেই আমাদের সেই যাত্রা। তেলকি থেকে হেঁটে মধুপুরের শাল বৃক্ষের গহীন বনের ভেতর দিয়ে জালাবাদা’য় পৌছঁতেই দেখা পেলাম পীরেনের সেই স্মৃতিসৌধ। সেই গ্রামগুলোতে সবার বাড়ি নির্মাণ শৈলী ও কাঠামোর মধ্যে এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পেলাম। মাটির বাড়ি।টিঁনের চালা। মুখোমুখি তিনটি ঘর। একটি ঘর রান্নার জন্য অন্য ঘরগুলো নিজেদের আবাসের জন্য। ঘরের আশেপাশে বাগান। কলা,আম, লিচু, আনারস বা অন্য ফলের বাগান। কিন্তু যতদূর জানতে সক্ষম হলাম এই বাগান মান্দিদের কারোর নই।যত বাগান আমি দেখেছি এইসব বাঙালিদের। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভূমি মান্দিদের কিন্তু এই ভূমিকে ভর করে যে ফলন তা কেন বাঙালিদের? উত্তর মিলল! ভূমি থাকলেও এইসব চাষ করার জন্য তাঁদের পকেটে পয়সা নেই। যার জন্য বছরের পর বছর তাঁদেরকে বাঙালিদের নিকট নিজেদের ভূমিগুলো লিজ দিতে হয়। বাঙালিরা এসে চাষ করে। এই ভূমিগুলোতে আবার বাঙালিদের বাগানে মজুরি খাটতে হয় মান্দিদেরই। নিজের ভূমিতে নিজেই মজুর। এই হল শালবনের আদিবাসীর জীবন। তাই আমার ভাবতে হয়, বাংলাদেশ উন্নয়নের কোন মহাসড়কে যাত্রা করলো তাতে আদিবাসী জীবনে কী বা আসে যায়! এই লেখা যখন লিখছি তখন ২০২০ এর সাল গণণার দু’দিন হয়ে যাচ্ছে।আজ ৩ জানুয়ারী, ২০২০- পীরেন স্নালের ১৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী। যে পীরেন স্নাল ২০০৪ সালে ইকোপার্ক বিরোধী ভূমি রক্ষার আন্দোলনে রাষ্ট্রের পুলিশ, বন রক্ষীদের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন এই দিনে।
সাধুপাড়ায় যে গ্রামে যার বাসায় আমরা ছিলাম বৃদ্ধ এক মহিলার সাথে তাঁর দাওয়াই গল্প হয়েছিল কিছুটা সময় ধরে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। সেই চাঁদের ধবল আলোতে তিনি বলেছিলেন এরকম- ইকোপার্ক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার ৩ হাজার একর জমি বেছে নেয়। মধুপরের এই জমিগুলোর মালিক মান্দিরাই। ২০০৪ সালে আদিবাসীদের যে ৩ হাজার একর জমি রক্ষার জন্য সাধুপাড়া গ্রামে ৩ জানুয়ারী মান্দি মানুষরা জড়ো হয়েছিলেন।লক্ষ্য ছিল সেখান থেকে ইকোপার্ক বিরোধী শান্তিপূর্ণ মৌন মিছিল নিয়ে জালাবাদা পার হয়ে গায়রা গ্রামে এসে প্রতিবাদ সমাবেশ করবে। কিন্তু জালাবাদা পার না হতেই প্রতিবাদী আদিবাসী মানুষের মিছিলে গুলি করে রাষ্ট্রীয় পুলিশ, বনরক্ষীরা। মৃত্যুকে বরণ করে নেন পীরেন স্নাল। সেই সাথে উৎপল নকরেককে বরণ করে নিতে হয় আজীবন পঙ্গুত্বের অভিশাপ। সেইসাথে অর্ধশতাধিক মান্দি নারী-পুরুষ আহত হন।এতেই কী শেষ! সেই বৃদ্ধা মান্দি মহিলার লক্ষ দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে যায় বনের নির্মল বাতাসে। আদিবাসী মানুষের পবিত্র বনের বাতাস নির্মল, কলুষমুক্ত।সেই মুক্ত নির্মল বাতাসে এই মান্দি বৃদ্ধার দীর্ঘশ্বাস ফেলার কাহিনী যে অনেক দীর্ঘ। ১৫০ একর জমি ছিল তাঁদের। তাঁর স্বামীকে সে সম্বোধন করে-হিমেলের বাবা বলে। তাঁর হিমেলের বাবা পীরেন স্নালের নিহত হওয়ার ঘটনায় পাল্টা মামলা খেয়ে সেই মামলা চালিয়ে নিতে এই ১৫০ একর জমির অনেক একরকেই হারাতে হয়েছিল এই হিমেলের মা’কে।জমির মালিকানার ভিত্তিটা কেন আমি সেই বৃদ্ধাকে ধরে হিসেব করছি! কারণ, মান্দিরা মাতৃতান্ত্রিক। যাইহোক, পীরেন স্নাল নিহত হয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় পুলিশ ও বনরক্ষীদের গুলিতে। এতে রাষ্ট্র দু:খিত হওয়ার কথা। কিন্তু রাষ্ট্র সেসময় নিরপরাধ মান্দিদের অনেকের বিরুদ্ধে বন মামলা করেছিল। এখনো সে এলাকার অনেকের বিরুদ্ধে গাছ চুরির মামলা, বন ধ্বংসের মামলা চলমান। এত এত মামলা চালাতে চালাতে তাঁরা হয়রান। এভাবেই যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আদিবাসী অধ্যুষিত সে অঞ্চলে চালানো হচ্ছে তা যেন বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারণার সাথে বেমানান। বাংলাদেশ উন্নত হলে কী আদিবাসীদের এভাবে হয়রান হতে হবে! পীরেনের মত অনেককে মরতে হবে রাষ্ট্রীয় পুলিশের গুলিতে! তখন এই প্রশ্নগুলোই সামনে চলে আসে।
২০২০ সাল। এই রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণের যে চূড়ান্ত ফায়সালা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, সেই সংগ্রামের অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শততম জন্মজয়ন্তী। শাসক দল তথা সরকারের নানা মহল এই বর্ষটিকে আখ্যা দিয়েছেন মুজিব বর্ষ। বেশ ভালো কথা। এই শেখ মুজিবুর রহমান যখন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট সপরিবারে শহীদ হন তখন পুরো দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামীলীগের বাঘা বাঘা নেতারা ছিলেন নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কিছুদিন আগেই বলেছিলেন- এত নেতারা কোথায় ছিলেন! এমনি নিস্তদ্ধ সময়ে তখন শালবনের মধুপুর গড়ের এই মান্দিরাই প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের সাহস দেখিয়েছিলেন। যে অন্যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে কলংকিত হয়ে আছে সে অন্যায়ের প্রতিরোধে আদিবাসীরাও অগ্রণী তারই প্রমাণ এটি। তাই মুজিব বর্ষে সরকারের অন্যতম উদ্যোগ হওয়া উচিত আদিবাসী মানুষের প্রতি আরো সংবেদনশীল এবং উদার হয়ে তাঁদের জীবন মান উন্নয়নে কাজ করা এবং তাঁদের যথাযথ স্বীকৃতি। পাহাড়ের সমস্যাকে নিরাপত্তার চশমা দিয়ে না দেখে মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখা। আর আদিবাসী মানুষের জীবনের যে সংগ্রাম সেটাকে রাষ্ট্র নিজেদের করে নেবে এই হোক মুজিব বর্ষের অন্যতম অনুকরণীয় দিক।
আজ পীরেন স্নালের ১৬ তম শাহদাৎবার্ষিকী।এই পীরেনের দেশে মান্দিরা এখনো লড়ছেন নিজেদের ভূমিকে নিজের করে নেবার লড়াইয়ে। মধুপুর গিয়ে শুনলাম, গতবছর থেকে আরেকটি কৃত্রিম লেক তৈরীর প্রকল্প শুরু হয়ে গেছে। দোখালা, চুনিয়া, বুটিয়া, পেগামারি এইসব গ্রামগুলোতে যে বিস্তৃত ধানক্ষেতকে অবলম্বন করে মান্দিরা বেঁচে আছে আর মিসি ও সালজংকে পূজা করে ওয়াগালায় নেছে গেয়ে আহ্লাদ করে সেই আহ্লাদ ও আনন্দ সেখানে ম্লান হয়ে যাবে এই কৃত্রিম লেকের কালো থাবায় । একের পর এক আদিবাসী বিধ্বংসী প্রকল্প নেয়া হচ্ছে এই অঞ্চলে। কাজেই পীরেনের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি, শেষ হবারও নয়। চুনিয়া গ্রামের খামাল জনিক নকরেকের কথা না বললে আমার লেখাটি অপূর্ণ থেকে যাবে। খামাল হল- মান্দিদের আদি ধর্ম সাংসােেরক এর পুরোহিত।শতের কাছাকাছি বয়সি এই খামাল আচ্চু জনিক নকরেক এখনো স্বপ্ন দেখেন মান্দিরা তাঁদের আদি ভূমিতে দকমান্দা-দকশাড়ী পরে, দামা, খ্রাম, নাথুক বাজিয়ে আবারো গাইবে আর ওয়ানগালাই মাতবে। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণে পীরেন স্নালের ভূমি রক্ষার লড়াইটা যেন জরুরী। তাই পীরেনের খিম্মা’য় হোক মান্দি আদিবাসী তথা সকল আদিবাসী মানুষের ভূমি রক্ষার লড়াইয়ে অন্যতম অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎম। পীরেন বেঁচে থাকুক আদিবাসী মানুষের জীবনের লড়াইয়ের প্রতিটি পরতে পরতে। প্রয়ান দিবসে অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা -পীরেন স্নাল।ভালো থেকো মধুপুর গড়ের পীরেনের দেশের মান্দি মানুষরা।
সতেজ চাকমা
তরুণ লেখক
ও
শিক্ষার্থী- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।