পাহাড়ে বিপন্ন মানবতাঃ প্রশ্নবিদ্ধ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ – ইমতিয়াজ মাহমুদ
(১) না, ঠিকঠাক মতো চলছে না কোনকিছুই। একটা দেশের সবচাইতে বড় জেলাটি সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে আর আপনি বলবেন ‘ভালো আছি’ সেটা তো হয়না। একই জেলায় ভূমিধ্বসে দুইশ মানুষ মারা গেছে দুইদিন আগে আর আপনি বলবো ভালো আছি এটা কি করে হয়? এই কয়দিন আগে সেই জেলারই একটা উপজেলায় একদিন একবেলায় বাঙালীরা একযোগে তিন শতাধিক মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল ইচ্ছা করে আর আপনি বলবেন সব ঠিকঠাক আছে, এটা তো ভাই হয়না।
শুনতে খারাপ শোনায়, কিন্তু খারাপ শুনালেও কথা তো মিথ্যা নয়। ভূমিধ্বসে সেনাবাহিনীর চারজন মারা গেলো সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি সবাই শোক জানালেন। ভাল করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা মারা গেলো ওদের জন্যে একলাইন লিখে দিলে কি হতো? সেনাবাহিনীর সদস্যরা মারা গেছে সেটাতে তো অবশ্যই ব্যাথিত আমরা। সে তো আর ওরা আর্মির অফিসার বলে না। ওরা মানুষ এবং মানুষের বিপদে মানুষকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে- সেই কারণে। সেই কারণে ওদেরকে আমরা মানবতার শহীদ বলবো। কিন্তু আপনারা যে অন্যদের মৃত্যুতে একটু শোক প্রকাশ করলেন না, তাতে ব্যাপারটা কিরকম হলো?
শোক না হয় বাদই দিলেন। একটা প্রেস রিলিজ দিয়ে শোক প্রকাশ করলে, বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটা দুইটা দিন শোক পালন করলে বা প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর বাতিল করে হেলকপ্টারে একবার রাঙ্গামাটি গেলে আমাদের রাঙ্গামাটিবাসীর মনে একটা সাহস হতো, শান্তি হতো। ওরা বুঝতে পারতো যে ওরা আমাদেরই অংশ, যে সরকার ওদের পাশে আছে, যে দেশবাসী সবাই ওদের পাশে আছে। এর কিছুই তো করলেন না। বাদ দেন। একটু জরুরী তৎপরতা তো চালাবেন, নাকি?
(২)
রাঙ্গামাটি শহরে কি এখন বিদ্যুৎ সংযোগ পুনস্থাপিত হয়েছে? জানিনা। রাঙ্গামাটির সাথে সারা দেশের যোগাযোগ কি পুনস্থাপিত হয়েছে? হয়নি। তাইলে এই জেলাটা চলছে কিভাবে? রাঙ্গামাটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে হুহু করে। চাল ডালের দাম বেড়ে দরিদ্র মধ্যবিত্তের কষ্ট বাড়িয়েছে। অনেক পণ্যের সরবরাহই নাই। সরকার কি জরুরী ভিত্তিতে ব্যাবস্থা নিতে পারে না? হেলিকপ্টার করে খাবার জিনিস পাঠানো হচ্ছে না কেন? জলপথেও পাঠানো যায়। পাঠাচ্ছেন না কেন? অসুস্থ লোকজনকে তো হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় বা চট্টগ্রামে আনা যায়। এনেছেন কাউকে?
প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল আর ত্রাণ ভাণ্ডার নামক একটা জিনিস আছে। সেখানে নানারকম সব ত্রাণসামগ্রী আছে। জরুরী খাবার জিনিস আছে, কাপড় চোপড় আছে। নগদ টাকা তো আছেই। মাঝে মাঝেই আপনি দেখবেন কোন ব্যাকের পরিচালকরা বা কোন ব্যাবসায়ি গ্রুপ প্রধানমন্ত্রীর হাতে চেক তুলে দিচ্ছে। এইসব টাকা ত্রাণ তহবিলে যায়। সাজেকে মানুষ এখনো না খেয়ে আছে। লঙ্গদুতে যাদের ঘর পুড়িয়েছে যেটেলাররা ওরা এখনো গৃহহীন। এখন যোগ হয়েছে রাঙ্গামাটির এই দুর্দশা।
একজন নাগরিক হিসাবে আমি কি একবার জিজ্ঞাসা করতে পারি না যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আপনার ত্রাণ তহবিল থেকে এইসব দুর্যোগে কয় টাকা খরচ করেছেন? ত্রাণ ভাণ্ডার থেকে কয় প্যাকেট বিস্কুট গেছে সাজেকের শিশুদের জন্যে? ত্রাণ ভাণ্ডার থেকে কয়টা তাঁবু গেছে লঙ্গদুতে গৃহহীনদের সাময়িক আবাসনের জন্যে? এইসব প্রশ্নের উত্তর যদি না পাই, তাইলে কি এই প্রশ্নটা করতে পারি যে এই ত্রাণ ভাণ্ডার ত্রাণ তহবিল এইগুলি কিসের জন্যে, কার জন্যে আর কবে ব্যাবহারের জন্যে রাখা হয়েছে?
(৩)
কেন এই উপেক্ষা? অনুমান করি রাঙ্গামাটির মানুষ আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। ওরা হয়তো আপনাদের কাছে বগুড়া পাবনা বরিশাল বা কুমিল্লার মানুষের সমান মর্যাদার না। হবে কি করে? রাঙ্গামাটির মানুষ হচ্ছে পাহাড়ি মানুষরা- আপনার যাদেরকে আদিবাসী হিসাবে স্বীকার করতেও নারাজ। আর কারা থাকে রাঙ্গামাটি জেলায়? সেটেলাররা। এরা কারা? এরা হচ্ছে সমতলের সেইসব দরিদ্র মানুষরা যাদেরকে জিয়াউর রহমান আদিবাসীদের বিপক্ষে মানব-হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহারের জন্যে সেখানে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে।
এইসব সেটেলারদেরকে আপনারা ব্যাবহার করেছেন আদিবাসীদেরকে চাপের মধ্যে রাখার জন্যে। আর ওদের রক্ষার জন্যে সেখানে সর্বত্র ছড়িয়ে রেখেছেন আর্মি ক্যাম্প। আছে পুলিশ বিজিবি কতো কি। কিন্তু শেষ বিচারে ওরাও আপনাদের কাছে আপনাদের সমান মানুষ না। ওদের মর্যাদাও কেবল আদিবাসী দমনের জন্যে ওদের সংখ্যা আর শক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেটেলাররা মরলের আমার রাষ্ট্রের শোক হয়না।
অথচ দেখেন, এই রাষ্ট্রই কিন্তু আজকের এই ভূমিধ্বসের জন্যে দায়ী। আদিবাসী না, সেটেলার না বা সেখানকার বাঙালী বাসিন্দারা কেউই না। প্রাথমিকভাবে দায়ী এই রাষ্ট্র এবং চূড়ান্তভাবে দায়ী এই রাষ্ট্রই। রাষ্ট্র দায়ী মানে কি? মানে আওয়ামী লীগ বিএনপি না- এদের সকলেই। বঙ্গবন্ধুর পর সেই যে চরিত্র পাল্টানো রাষ্ট্র, যেটা পাকিস্তান স্টাইলের মুসলমানদের রাষ্ট্র হয়ে গেছে- সেই রাষ্ট্র। কেননা পাকিস্তান চরিত্রের এই রাষ্ট্রটি এখন আর মানুষের রাষ্ট্র নাই- এটা হয়ে গেছে ধান্দাবাজদের রাষ্ট্র। আর ধান্দাবাজরা ওদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করে সবচেয়ে মোক্ষম বস্তুটি- ধর্ম আর সেই সাথে মিশেল দেয় খানিকটা জাতীয়তাবাদ।
এইটা ভালো না। মানুষকে উপেক্ষা করা রাষ্ট্রের জন্যে ভাল না। যারা বয়স্ক ব্যক্তি আছেন, ষাটের উপর বয়স হয়েছে তাদের মনে থাকার কথা। সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে সরকারের উদাসীনতা মানুষের মনে কিভাবে কাজ করেছিল সেকথা আপনাদের জানা থাকার কথা।
(৪)
বলবেন যে ভূমিধ্বসের জন্যে রাষ্ট্র কিভাবে দায়ী হয়।
দেখেন, পাহাড়ে এইরকম জোর করে বেহিসাবি মানুষ ঢোকানোর ফলাফল কি হতে পারে সেটা বুঝার জন্যে আপনার বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নাই। পাহাড়ে দেখবেন মানুষ সাধারণত উপত্যকায় বাস করে বা পাহাড়ের ঢালে বাস করলেও এমন জায়গায় করে যেখানে পাহাড়ের প্রান্তটি ঢালু রেখেই বসবাস করা যায়। কারণ পাহাড়ের ঢালু প্রান্ত কেটে যদি আপনি সোজা খাড়া করে ফেলেন, তাইলে সেখানে ল্যান্ডস্লাইড হতেই পারে।
এই কাজটি আমরা রাঙ্গামাটিতে করেছি, চট্টগ্রামে করেছি। পাহাড়ের ঢালু প্রান্তটি কেটে সেখানে একেকটা উল্টা L এর মতো শেলফ বা টেরাস তৈরি করেছি। আর সেইসব টেরাসে মানুষকে ঘর বাড়ি করে থাকতে দিয়েছি। রাঙ্গামাটিতে লোকে এটা করতে বাধ্য হয়েছে কারণ সেখানে হঠাত করে লোকসংখ্যা বেড়ে গেছে। এই লোকসংখ্যা বৃদ্ধিটি প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক নিয়মে ঘটেনি। জিয়াউর রহমানের সময় এই কাজটা শুরু হয়েছে- সেটেলার ঢুকানো। ফলে মানুষের ঘরবাড়ি করার জন্য উপযুক্ত জায়গা শেষ হয় গেছে আর মানুষ বাধ্য হয়েছে পাহাড় কেটে ঐভাবে বাড়িঘর বানাতে।
সাথে কি হয়েছে? গাছ কেটে ফেলেছেন আপনারা। মিলিটারিরা গাছ কেটেছে। গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করেছে। এটা তো আমাদের চোখের সামনে হয়েছে। আমরা চিৎকার করেছি। এতো সেটেলার ঢুকাবেন না পাহাড়ে, এটা অন্যায়। আপনারা শোনেননি। আমরা চিৎকার করেছি, এইভাবে গাছপালা কাটবেন না। আপনারা শোনেননি। ফলাফল কি হয়েছে?
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, হবে না কেন, হয়। সব দুর্যোগ আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না। কিন্তু কিছু কিছু দুর্যোগ আমরা নিজেরা তৈরি করি। পাহাড়ে ল্যান্ডস্লাইডে মানুষের মৃত্যু, এটার জন্যে আমার রাষ্ট্রই দায়ী।
(৫)
কিন্তু দেখবেন আমাদের রাজনীতিবিদরা এইসব অভিজ্ঞতা থেকে কোন শিক্ষা নেবেন না। আওয়ামী লীগ বিএনপি এরা আপনার কথা শুনবে না। এরা আপনাকে নগদ প্রাপ্তির লোভ দেখাবে। বলবে বিদ্যুৎ দিব, সুন্দরবন ভুলে যা। আপনিও বেকুব দলদাস, বলবেন যে উন্নয়ন চাই, সুন্দরবন কিছু না। এরা শঠ প্রকৃতির এক্সপার্ট ভাড়া করবে আর আপনাকে শেখাবে- এমনভাবে করবো, কিছুই হবে না কেউই টের পাবে না। আপনিও ওদের এইসব স্যুডো এক্সপার্টদের কথা শুনে তর্ক করতে থাকবেন- কিসসু হবে না, কিসসু হবে না, আনু মুহাম্মদ চীনপন্থি, সুতরাং সুন্দরবনের ভয় নাই।
এইভাবেই পাহাড়ের বারোটা বাজিয়েছে প্রায়। উন্নয়ন। পাহাড় কেটে ফেল। আদিবাসীরা ওদের জীবনযাত্রার ট্র্যাডিশন ধরে রাখতে পারছে না? তাতে কি? এরা অত অসভ্য জংলী। এদেরকে পাত্তা দেওয়ার কি আছে। বিল্ডিং বানাই। পর্যটক চাই। উন্নয়ন। আদিবাসীরা বাসস্থান হারাচ্ছে, হারাক। ওরা চলে যাক আরও ভিতরে পাহাড়ে। মোটেল বানাতে হবে, রিসোর্ট বানাতে হবে। শুঁড়িখানা খুতে হবে। বেশ্যালয় বানাতে হবে। উন্নয়ন।
এই উন্নয়নের চূড়ান্ত পরিণতি কি হবে জানেন? আমাদের আদিবাসীদেরকে পাহাড় ছেড়ে চলে যেতে হবে বা মরে যেতে হবে। যারা থাকবে ওদের জন্যে রিজার্ভ ফরেস্ট তৈরি করা হবে, কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে ওরা বাস করবে। সমতল থেকে আমাদের নাতিপুতিরা যাবে আর টিকেট কেটে ওদেরকে দেখবে। গাইড এসে বলবে, এই যে দেখছেন এই কয়েকটা ঘর, এরা চাকমা। এক সময় এরা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল ইত্যাদি।
এইটাই হবে। যদি না আপনি সরকারকে বাধ্য করাতে পারেন বুঝতে যে প্রকৃতিতে সমঝে নিয়ে উন্নয়ন বকতে হয়। নাইলে ডিজাস্টার হয়ে যাবে। রামপালে যে প্লান্ট করতে যাচ্ছেন, বুঝে করছেন তো?