পাহাড়ের গণতন্ত্রের ব্যবচ্ছেদ: প্রশাসনের দ্বিচারিতা কার স্বার্থে? পলাশ চাকমা জুম্মো
১.
গত অক্টোবর ১১/২০১৭ তারিখে রাঙামাটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির ৯ম কাউন্সিল ও প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। এই সম্মেলন ও কাউন্সিলে প্রধান অতিথি ছিলেন ২৯৯ পার্বত্য রাঙামাটি আসনের সাংসদ অর্থাৎ অত্র আসনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি উষাতন তালুকদার। সেদিন সকাল ১০টায় যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হলো; কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধলো মাঝপথে। দুপুর ১২ টার দিকে মাননীয় এমপি মহোদয়ের ফোনে একটা কল আসলো। উনার কথা বলার সুবিধার্থে বক্তব্যরত ব্যক্তি বক্তব্য দেয়া স্থগিত করলেন, পুরো সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট হলরুমে তখন শুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। খেয়াল করলাম মাননীয় এমপি মহোদয় ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে বলছেন- মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। আপনারা কেন আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় বাধা প্রদান করছেন?
বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল মাননীয় এমপি মহোদয়ের প্রধান অতিথির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমপি মহোদয় বলেছিলেন- বাংলাদেশের সংবিধানে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করার কথা বলা হয়েছে। সমাবেশ-মিটিং-মিছিল করার অধিকার দেয়া হয়েছে। আমরা গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা করছি। আমরা এখানে কোনো উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখছি না। কিন্তু হিল উইমেন্স ফেডারেশনকে কেন বাধা দেয়া হচ্ছে? আমাদেরকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে বাধাগ্রস্ত করবেন না। তিনি বলেন, জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সহযোগী সংগঠনগুলো প্রশাসনকে লিখিতভাবে অবহিত করে এযাবৎ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। সে হিসেবে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের আজকের এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অথচ সম্মেলনের অনুমতি নেই বলে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত আজকের এই সম্মেলনকে বাধা দেয়া হচ্ছে। সরকারের দৃষ্টি আর্কষণ করে তিনি বলেন, আমাদের কোন দুরভিসন্ধি নেই। দয়া করে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করবেন না। আমাদের কার্যকলাপের ফলে কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে তার কোন সম্ভাবনা নেই। আমরা কোন রাষ্ট্র বিরোধী কাজ করছি না। আমরা হলের ভেতরে আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আলোচনা করছি মাত্র। অহেতুকভাবে ভুল বুঝা হচ্ছে, অহেতুকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
২.
পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এখানে জুম পাহাড়ের বাসিন্দাকে মানুষ মনে করা হয় না। এখানে ‘মানবাধিকার’ শব্দটা শুধু শোকেসে সাজানো প্রদর্শিত সস্তা বস্তু মাত্র। আপনি এখানে নিজের ইচ্ছায় যে মরবেন সে স্বাধীনতাও নেই। এমনকি পরিবারের একজন সদস্যকে হত্যা করা হলে তার লাশ ফেরত পাওয়ার অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়। নান্যাচরের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের রমেল চাকমা মরে গিয়েও যেন যুগে যুগে তার সাক্ষী দিয়ে যাবে। গত ৫ এপ্রিল ২০১৭ সকালে নান্যাচর সরকারি কলেজ থেকে চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী রমেল চাকমাকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায়। আটকের পর তাকে সেনা হেফাজতে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে রমেল অসুস্থ হয়ে পড়লে এ অবস্থায় তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে গেলে অবস্থা খারাপ হওয়ায় পুলিশ রমেলকে গ্রহণ করেনি। তার অবস্থার অবনতি হলে পরে তাকে চট্টগ্রাম হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেনাবাহিনীর নজরদারি ও পুলিশের পাহারায় দু’সপ্তাহ ধরে রমেল চাকমা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়বে অবশেষে গত ১৯ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়।
রমেল চাকমার লাশটি যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে নিয়ে আসা হচ্ছিল, তখন পথে পথে অপেক্ষারত শত শত মানুষ বিভিন্ন স্থানে লাশের গাড়িতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তারা সেনাবাহিনীর নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতনের প্রতিবাদমুখর হয়। লাশটি যখন গাড়ি থেকে নামিয়ে বুড়িঘাট বাজার থেকে বোটে তোলা হলো আর তখনই সেনাবাহিনী লাশটিকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। লাশটি নিয়ে কতক্ষণ এই বাড়ি, কতক্ষণ ওই বাড়ি করে তারা কোন রকমে রাত পার করলো। হয়তো লাশটি গুম করারও চিন্তা করছিল তারা। কিন্তু লাশটি যে সুদুর চট্টগ্রাম থেকে আনা হয়েছিল সেজন্য সেটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশেষে তারা রমেলের লাশটি পূর্ব হাতিমারায় নিয়ে গিয়ে যথাযথ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলে সমস্ত আলামত নষ্ট করে ফেলে।
এখানেই শেষ নয়। ২৫ এপ্রিল ২০১৭ রমেল হত্যাকান্ড সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য ঢাকা থেকে আসা প্রতিনিধিদল নান্যাচর পৌঁছলে নান্যাচর জোনে প্রতিনিধিদলের সদস্যদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে জোনের গোল ঘরে বসিয়ে রাখা হয়। এসময় নানান অজুহাত দেখিয়ে টিএন্ডটি এবং নান্যাচর কলেজ এলাকায় যাওয়া যাবে না বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদলকে জানিয়ে দেয়া হয়। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে গোল ঘরে বসিয়ে রাখার পর জোনের সেনা কর্মকর্তা টুআইসি মেজর জাকিরের নেতৃত্বে একদল সেনা সদস্য প্রতিনিধিদলকে দু’টো সামরিক যান সহকারে এসকর্ট দিয়ে মানিকছড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। প্রতিনিধিদলটি রাঙামাটি যেতে চাইলে সেনারা যাওয়া যাবে না বলে সোজা চট্টগ্রাম ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এভাবে রমেল চাকমা হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করার মুহুর্তে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা সৃষ্টি করে ব্যানার কেড়ে নেওয়া হয়।
৩.
সাম্প্রতিক সময়ে বিলাইছড়ির দুর্গম এলাকা ফারুয়ায় গত ২২ জানুয়ারি গভীর রাতে সেনাবাহিনীর অভিযানে সেনাসদস্য কর্তৃক সহোদর দুই মারমা বোনকে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে ও সমতলে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সেনাবাহিনীর এমন গর্হিত ও নিকৃষ্টতম কর্মকান্ডের জন্য চারদিক থেকে কঠোর সমালোচনা ও তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এই ইস্যুতে সেনাবাহিনী প্রথমে অত্র এলাকার জনগণের মুখে তালা দেয়ার অপচেষ্টা করছে। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে ধর্ষণের ঘটনাটি যখন সেনাদলের কম্যান্ডার সুবেদার মিজানকে জানানো হয় তখন তিনি কড়া নির্দেশ দেন যেন এ ব্যাপারে কাউকে জানানো না হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কন্ঠ ইতিহাসে কেউ রোধ করার সে কি নির্লজ্জ অপচেষ্টা!
এমনকি ধর্ষিতা ওই দুই মারমা বোনকে চিকিৎসার জন্য রাঙ্গামাটি শহরে নিয়ে আসার পথেও সেনাবাহিনী বিভিন্ন উছিলা দিয়ে বাঁধা প্রধান করে। ওদের মনে ভয় ধরেছে, ধর্ষিতা ওই তরুণীকে যদি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাহলে সেখানে সাংবাদিক যাবে, মানবাধিকার কর্মী আসবে, প্রশ্ন করা হবে কে এই বর্বরতার জন্য দায়ী? এই অভিযোগের আঙ্গুল যে সেনাবাহিনীর দিকে যাবে ওরা জানে। এখনো পর্যন্ত বিলাইছড়িতে যৌন সহিংসতার শিকার দুই মারমা বোনকে চাকমা সার্কেলের চীফ রাজা দেবাশীষ রায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। পক্ষান্তরে পুলিশ ভিকটিমদেরকে তাদের হেফাজতে নেয়ার জন্য অপচেষ্টা করে চলেছে। পুলিশের ষড়যন্ত্রে বিলাইছড়ির ভিকটিমদের ২৩ জানুয়ারি থেকে অব্যাহতভাবে হাসপাতালে কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কন্ঠকে রুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় মিছিল-সমাবেশে বাধা দিয়ে যাচ্ছে। বান্দরবানে সম্মিলিত আদিবাসী ছাত্র সমাজের ব্যানারে অপরাধীদেরকে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি ও প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ প্রশাসন ব্যানার কেড়ে নেয় ও সমাবেশ সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য করে।
এটা পরিস্কার যে, পাহাড়ে মানবাধিকার ও পাহাড়বাসীর গণতান্ত্রিক অধিকারকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এই দমন-পীড়ন যেন তীব্র আক্রোশে ছুটে চলা এক নির্মম ফ্যাসিবাদ। এই ফ্যাসিবাদ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিরোধী। যেখানে পাহাড়ের জাতিগত নির্মুলীকরণের তত্ত বেছে নেয়া হয়েছে। এখানে ভিন্নমতের কোন ঠাঁই নেই। এজন্য ফ্যাসিবাদে ভিন্নমতকে সহ্য না করে দমন করা হয়। যে ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ পাহাড়ের একটা চরমপন্থী, উগ্র জাতীয়তাবাদী, কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনৈতিক মতাদর্শের চাষ করছে। এই দর্শন পাহাড়ের সবকিছুকেই বুটের তলায় পিষ্ঠ করতে চায়। রাষ্ট্রকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে, নেপথ্যে থাকে একটি সর্বগ্রাসী দল বা গোষ্ঠী পাহাড়ের বুকে ফ্যাসিবাদের ষ্টীমরোলার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের প্রতিবাদী জনগণকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমন করা হলেও শাসকগোষ্ঠী তার কুটচালের অপর পৃষ্ঠায় তার মদদপুষ্টদের জন্য যেন উদার গণতন্ত্রের দুয়ার খোলা রেখেছে।
৪.
গত ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ ফেসবুকে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ও রাঙ্গামাটি জেলা মহিলা আওয়মীলীগের সভাপতি ফিরোজা বেগম চিনুর বিরুদ্ধে ফেসবুকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যর জন্য রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। রাঙামাটির পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান বলেছেন, অভিযোগ পেলে এসবের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন। শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টকারীদের কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি। একজন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্যর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুরুচিপুর্ণ মন্তব্য করার অধিকার কারো নেই; তবে রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার বিলাইছড়িতে মারমা তরুণী ধর্ষণের ইস্যুতে গত ২৬ জানুয়ারি তারিখে রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা দেবাশীষ রায় ও ২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মাননীয় সাংসদ উষাতন তালুকদারের সাথে যে ধরনের উলঙ্গ ও উদ্যত আচরণ করেছেন তার বিরুদ্ধে কে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে সেটাও ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। একজন দায়িত্বসম্পন্ন পুলিশ সুপার সংশ্লিষ্ট এলাকার সাংসদের অধীন এই বিষয়টি সবার পরিষ্কারভাবে জানা থাকার কথা কিন্তু রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার সেটা জানেন কিনা? সেদিন তিনি কি বলবর্ধক বটিকা সেবন করেছেন যে, এমন উদ্যত আচরণ করলেন? সেটাও আমরা জানতে চাই এবং এই অপরাধের কারণে তার কি ধরনের শাস্তি হওয়া উচিত সেটাও হিসাবে আনা দরকার।
পাহাড়ের সর্বস্তরের জনগণ পাহাড়ের শান্তি, সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা চাই এবং এ শান্তি,সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করা উচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ ফিরোজা বেগম চিনু এ বিষয়ে কি ভুমিকা রাখছেন সেটাও ভেবে দেখতে হবে। সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি চিনু তার ফেসবুক পোস্টে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সাম্প্রদায়িক ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। তার ফেসবুক পোস্টে তিনি কখনো পাহাড়ের অবিসংবাদিত নেতা আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছেন কখনো বা পাহাড়ের আওয়ামীলীগ সদস্যদের পদত্যাগের কারণে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া একতরফাভাবে জনসংহতি সমিতিকে দোষারোপ করছেন; পাহাড়ীদেরকে গণহারে সন্ত্রাসীর তকমা লাগিয়ে দিচ্ছেন; এইসব খবর কি রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পৌছায়নি? উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া জনসংহতি সমিতিকে একতরফাভাবে দোষ চাপিয়ে দিয়ে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগ কর্তৃক প্রকাশিত “জেএসএস সন্ত্রাসীদের এ কেমন নৃশংসতা” শিরোনামের সাম্প্রদায়িক পোস্টার কি পুলিশ সুপার দেখতে পান না?
৫.
কোনো গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন নাগরিকের অধিকার ও শান্তি-শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে। কারণ সামরিক বা বেসামরিক প্রশাসন কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর হতে পারে না। যদি প্রশাসন কোনো গোষ্ঠী বা দল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত হয় তাহলে সেখানে আইন ও তার অনুশাসনের সঠিক প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হয় ও মানবাধিকার লংঘিত হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত আইন ও আইনের অনুশাসন সবার জন্য সমান। পাহাড়ের সামরিক বা বেসামরিক প্রশাসন কার দ্বারা প্রভাবিত সেটা নতুন করে বলার দরকার নেই। যদি তা না হয় তাহলে লংগদুতে তথাকথিত যুবলীগ নেতা নয়ন হত্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে লংগদু সেনা জোনের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোঃ আব্দুল আলীম চৌধুরী কেন সেটেলারদের সাথে প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিযেছিলেন? সেই প্রতিবাদ সমাবেশে কেন জনৈক পুলিশ কর্মকর্তাকে বক্তব্য দিতে দেখা গিয়েছিল?
যখন পাহাড়ের মানুষ ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করার জন্য মিছিল-সমাবেশ করার চেষ্টা করছে তখনই প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে বাধা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগসহ তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর জন্য যেকোনো ইস্যুতে তথাকথিত মিছিল-সমাবেশের জন্য যেন চারদিক উদার গণতন্ত্রের দুয়ার খুলে দেয়া হয়েছে; ১৪ মে ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটিতে সেনা-গোয়েন্দা-পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় সেটেলার বাঙালিদের সমাবেশে যোগ দিতে এসে সেটেলারেরা কাউখালীতে অসহায় পাহাড়ি বৃদ্ধের দোকান ভাংচুর করলেও তথাপি তাদের সমাবেশে কোন বাধা দেয়া হয়নি এবং দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নিরাপত্তা ও বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া হলো না; বিলাইছড়িতে গত ২১ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সেনা সদস্য কর্তৃক একই পরিবারের দুই মারমা মেয়েকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে নান্যাচরের উপজেলা সদরে নারী সমাবেশে বাধা দেয়া হলো; ২৩ জানুয়ারি বান্দরবানে সম্মিলিত আদিবাসী ছাত্র সমাজের প্রতিবাদ সমাবেশে বাধা দেয়া হলো; অথচ কয়েকদিনের ব্যবধানে গত ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগকে সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক সমাবেশ করতে দেয়া হলো? সমাবেশে কোন প্রকার বাঁধা দেয়া তো দুরের কথা বরং প্রশাসন কর্তৃক সমাবেশে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যবস্থা করা হয়েছি, এমনকি ভেদভেদী-পুরাতন বাসস্টেশন রাস্তা পুরোপরি বন্ধ করে এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে সমাবেশ অনুষ্ঠিত করতে সহায়তা দেয়া হয়েছিল।
৬ ডিসেম্বর রাঙামাটির জুরাছড়ির উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দু চাকমাকে হত্যার প্রতিবাদে রাঙ্গামাটিতে জেলা আওয়ামীলীগ সকাল সন্ধ্যা অবরোধ ডাকে। অবরোধের দিন সকাল ১১ ঘটিকার দিকে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলাধীন রাইখালী ইউনিয়নের ডংনালা গ্রাম থেকে উষামং মারমাকে (৩৮) তাঁর বাড়ি থেকে স্থানীয় ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মিজানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের দুর্বৃত্তরা ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিকভাবে মারধর করতে করতে উষামংকে কাপ্তাই উপজেলাধীন কোদালা গ্রামের দিকে ধরে নিয়ে যায়। অন্যদিকে দুপুর ১২:৩০ টার দিকে রাইখালি ইউনিয়নের কংহ্লাঅং মারমা (৪০) রাইখালি বাজারে গেলে ছাত্রলীগ-আওয়ামীলীগের একদল দুর্বৃত্ত তাঁকে বেদম মারধর করে। স্থানীয়রা বলছে বিষয়টি জানানো হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
অথচ এর বিপরীতে আমরা দেখতে পাই রাঙ্গামাটি শহরের ভালেদি আদামে আওয়ামীলীগ নেত্রী ঝর্ণা খীসা নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনার জের ধরে সে এলাকার অধিকাংশ যুবকদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যার মধ্যে অধিকাংশই সিএনজি ড্রাইভার। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের পরিবারেরা দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন। রাঙ্গামাটি সদর, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলার বিভিন্ন ঘটনার জের ধরে এখন পর্যন্ত রাঙ্গামাটিতে ১১২ জন গ্রামবাসীকে আটক, ২৮ জনকে গ্রেফতার ও ১৯ জন মারধর ও হয়রানির শিকার হয়েছে! স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই প্রশাসনিক বৈষম্যে কার স্বার্থে? নির্বিচারে এই ধর-পাকড়, আটক-অভিযান কার স্বার্থে? কার মনোরঞ্জনের জন্য আমাদের সাথে এমন আচরণ করা হচ্ছে? তাহলে কি আমরা বলতে পারি পাহাড়ের প্রশাসন শুধুমাত্র শাসকগোষ্ঠীর শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে? প্রশাসন যদি জনগণের জন্য হয় তাহলে নিরীহ জনগণের সাথে এমন বৈরি আচরণ কেন? প্রশাসনের কাজে বাধা দেয়ার কোন অধিকার আমাদের নেই তবে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের কাছে অবশ্যই প্রশাসনকে জবাবদিহিতা করতে হবে এবং এসকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।