পাহাড়ের কান্না আমরা শুনতে কি পাই ? -মোহাম্মদ জাহেদ হাসান
১.”রাঙ্গামাটি’ নামটা শুনার সাথে সাথেই সাধারনত আমাদের চোখের সামনে ভাসে চারদিকে পাহাড় ও লেক ঘেরা নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের অপরুপ এক সুন্দর শহর, যাকে প্রকৃতি নিজের মতো করে সাজিয়ে রেখেছে । এখানাকার মানুষ সেই প্রকৃতির মতোই সুন্দর, সহজ সরল। কাজের কারনে আমাকে প্রায় রাঙ্গামাটিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলাতেই যেতে হয় এবং সেই সাথে সেখানকার মানুষগুলোর সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছে । তাই রাঙ্গামাটিতে যখন গত ১৩ তারিখের পাহাড়ধসের তথ্য পেলাম সাথে সাথে আমার বন্ধু, সহকর্মী সহ পরিচিত-অপরিচিত মানুষগুলোর জন্য উদ্বিগ্ন ছিলাম। মূলত সেদিন দুপুর ১২ টায় অফিসে বসেই অনলাইন নিউজে প্রথমে জানতে পেলাম রাঙ্গামটিতে পাহাড় ধসে ৬ জনের মৃত্যু, সেনাবাহিনী উদ্ধার অভিযানে গিয়ে চার জন সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন, এবং একজন নিখোঁজ রয়েছেন। বিকেলের দিকে বাসায় ফিরে টিভির স্ক্রলে চোখ বুলিয়েে আবারো আঁতকে উঠলাম, মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৩০ এবং রাত বাড়ার সাথে সাথে মৃত্যুর সংখ্যাও আরো বাঁড়তে থাকলো। আর গতকাল উদ্ধার অপারেশন শেষ করার সময় জানা গেলো রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের এ পাঁচ জেলায় সর্বশেষ নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৬ জন আর শুধুমাত্র রাঙ্গামাটিতেই মারা গেছেন ১১০ জন। গত এক দশকে পাহাড়ে এতো সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা কখনো ঘটেনি। আর বর্ষা মৌসুমের আগেই পাহাড়ে এত ভারি বর্ষণ আগে কখনো হয়নি। প্রকৃতিও অদ্ভুত আচরন করছে । কিছু দিন আগে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে রাঙ্গামাটি সহ পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক ঝড়ো হাওয়া সহ ভারী বর্ষন হয়েছে। আর গত ১১ তারিখে রাঙ্গামাটিতে ৩৬৫ মিলিলিটার রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়। আর এই ভারি বর্ষণের কারনেই পাহাড় ধসে এত প্রাণহানী ঘটেছে। আর আমাদের দেশে সাধারনত কোন একটি দূর্ঘটনা ঘটলেই তার উপর সবার নজর পরে, ঘটনার বিশ্লেষন হয়, কারন অনুসন্ধান হয় কিছু সুপারিশ করা হয় এবং একটা সময় সে সুপারিশ ফাইলবন্দী হয়ে থাকে, তা আর আলোর মুখ দেখেনা। তবে এবারের পাহাড় ধসের কারনগুলো যাদের পাহাড়ে নিয়মিত যাওয়া-আসা আছে তাদের সকলেরই কাছেই দৃশ্যমান। গত এক দশকে যত্রতত্র পাহাড় কাটা হয়েছে, পুনর্বাসনের নামে পাহাড়ে অধিক জনগোষ্ঠির বসতি স্থাপনের একটি চাপ ছিল। পাহাড়ের উপরিভাগে গাছ না থাকা, নিবিচারে গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাহাড় থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি সরানো ব্যবস্থা না রাখা, যথাযথ ও ব্যাপক হারে বনায়ন না করা, আর জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মিলে আজকের এই চরম দূর্দশা। অপরুপ রাঙ্গামাটি এখণ স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে, রাঙ্গামাটি এখন শোকের শহর।
২. ভয়াবহ ভূমিধসের পর প্রশাসনিক দিক থেকে তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর রাঙ্গামাটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাঙ্গামাটিবাসী চরম কষ্ট ও দূর্দশার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছে। টানা চারদিন বিদ্যুৎহীন থাকার পর বিদ্যুৎ আসা-যাওযা করছে, খাবার পানির চরম সংকট, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব, আর যে সব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে বিশেষ করে চাল-ডাল-আলু-লবন-ডিম, মোমবাতি, কেরোসিন তা এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর কারনে ২-৩ গুন মূল্য চাওয়া হচ্ছে। যদিও প্রশাসন এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে নির্দিষ্ট মূল্যে জিনিস পত্র বিক্রয় করার জন্য তদারকী শুরু করেছে। আর থেমে থেমে বৃষ্টি মানুষকে চরম আতংক ও ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আবারো ভূমিধসের আশংকায় প্রশাসন মাইকিং করে মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে প্রায় ২০০০ পাহাড়ী-বাঙ্গালী মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে জীবন বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো পুন:স্থাপিত হয়নি। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের ১৪৩ পয়েন্টে ভূমিধসে বিপর্যস্ত পাহাড় ধসে পড়েছে। তার মধ্যে একটি স্থানে ১০০ মিটার রাস্তার পুরোটাই ধসে পড়েছে। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের অবস্থাও একই । আশা করা হচ্ছে সড়ক গুলো পুরাপুরি যোগাযোগ উপযোগী হতে আরো সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। এমতাবস্থায় এখানাকার মানুষগলো আগামী দিনগুলি কেমন যাবে তা সহজেই অনুমেয়।
৩. এখন প্রশ্ন হচ্ছে পাহাড়ের এই স্বজনহারা মানুষের কান্না- তাদের কষ্ট আমাদের মনকে কতটুকু নাড়া দেয়? পাহাড়ের মাটি চাপা মানুষগুলোকে যখন একের পর এক বের করে আনা হচ্ছিল, চারদিকে স্বজনরা নিকট আত্মীয় হারানোর শংকায় উৎকন্ঠিত ঠিক তখনি আমরা ক্রিকেট প্রিয় জাতি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালের ভারত-বাংলাদেশ খেলার চুলচেরা বিশ্লেষণ দিয়ে ফেসবুকের টাইমলাইন গরম করে ফেলছিলাম। মূহুর্তের মধ্যে খেলায় ব্যর্থতার জন্য কাকে বাদ দিতে হবে, কিংবা কে উইকেট নেওয়ার পর কেমন এক্সপ্রেশন দিয়েছে তার মন্ডুপাত করতে করতে দিন শেষ করে ফেললাম। আমাদের কি পাহাড়ের মাটি চাপা মানুষগুলোর খবর নেওয়ার সময আছে? যদিও শোনা গিয়েছিল আমাদের খেলোয়াড়রা খেলার সময় নিহতদের স্মরনে হাতে কালো ব্যাজ ধারন করে খেলবেন, কিন্ত খেলার মাঠে তার কোন চিহ্নও খুঁজে পাওয়া গেল না ! দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যুতেও রাষ্ট্র এক দিনের জন্য শোক জানায়নি ! হাতে গুনা কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে যে দেখিনি এতটুকু উদ্বেগ জানাতে? হায় ! রাঙ্গামাটি কি আমাদেরে দেশের ভেতরে নয়? সেখানকার মানুষগুলো কি অন্যগ্রহ থেকে এসেছে? কিছু দিন আগে একটি হত্যাকান্ডকে ঘিরে লংঘদুতে প্রায় ৩০০ বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। সেই ঘটনায় অনেককে দেখলাম যারা আগুন দিয়েছে তাদেরকে সমর্থন করতে। আমাদের মানসিকতা কোথায় গিয়ে পৌছেছে? যারা মোটরসাইকেল চালক নয়নকে হত্যা করেছে তাদেরে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলত শাস্তি হতে হবে, এবং সেটার জন্য ৩০০ বাড়ীতে আগুন দিয়ে এতোগুলো মানুষগুলো গৃহহারা করা, তাদের বাড়ীতে লুটপাট করার ঘটনাকে জাস্টিফাইড করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশ-সেনাবাহিনী সবার চোখের সামনে এতাগুলো বাড়ী পুড়ে ছাই হয়ে গেল, এটা কিভাবে সম্ভব? দিন দিন আমাদের অনুভূতিগুলো হয়তো ভোঁতাই হয়ে যাচ্ছে ! আমরা এখন সবই পারি ! একটু ভাবেন লংগদুর হামলায় ঘরছাড়া মানুষগুলো এই টানা বৃষ্টিতে জঙ্গলে খোলা আকাশের নিচে কিভাবে দিন কাটাচ্ছে? আমরা কি লংগদু হামলার উস্কানিদাতাদের বের করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহন, হামলা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহনে সোচ্চার হতে পারি না?
৪. চ্যাম্পিয়ান্স ট্রফি ক্রিকেটে বাংলাদেশের খেলা আপাতত শেষ, আসুন এবার দেশের সবচেয়ে বৃহত্তর কিন্ত এ মূহর্ত্তে সবচেয়ে বেশ দূর্যোগপূর্ণ এলাকা রাঙ্গামাটিবাসীর দিকে একটু নজর দেই। ভূমি ধসের পর উদ্বার কাজ পরিচালনায় ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুন;স্থাপনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা জীবন দিয়ে কাজ করেছেন এবং তা সত্যিই প্রশংসনীয়। সরকারী ত্রাণ কার্যত্রম শুরু হয়েছে, কিন্ত এখন পযন্ত তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। আর পত্রিকায় খবরে অনুযায়ী, ত্রান কার্যক্রম সহ অন্যান্য বিষয়াধি সমন্বয় সঠিকভাবে হচ্ছেনা। এমতাবস্থায় সরকারের সাহয্যের পাশাপাশি আমাদের বেসরকারী-ব্যক্তিগত-সমাজভিত্তিক কিংবা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনভিত্তিক উদ্যোগ গুলো একত্রিত হয়ে তাদের সাহার্যাথে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ভালোবাসা- ছোট ছোট সহায়তা স্বজন হারানো, গৃহহীন মানুষগুলোকে একটু হলেও স্বস্তি দিবে। প্রার্থনা করি আমাদের প্রিয় রাঙ্গামাটি ভালো থাকুক, রাঙ্গামাটিবাসী সবাই ভালো থাকুন, রাঙ্গামাটি আবার তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে ফিরে আসুক ।
লেখক: উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী