পাহাড়ের এমন নিরব বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণ যেন আর না আসে: সতেজ চাকমা

বিদায় ১৪২৬ বঙ্গাব্দ।এক ধরণের অবরুদ্ধ ও অনিশ্চিত জীবনের তরী বেয়ে পাহাড়ে আসলো ১৪২৭।কেবলমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেন্দ্রিক উৎযাপনে এবারের বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণে ছিল একেবারেই শুনশান নীরবতা।সাধারণত এই সময়ে পাহাড়ে জৌলুসতা নিয়ে আসে চৈত্র্য সংক্রান্তির এই ক্ষণ। পাহাড়ের আদিবাসীরা ঘটা করে পালন করে থাকে এই সংক্রান্তি ও বরণের উৎসব। বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন নাম দিয়ে এই উৎসবটিকে পালন করলেও উৎসবের রঙ ও আবহ যেন এক সুরে আবদ্ধ। চাকমারা বলে বিজু, ত্রিপুরা’র বৈসু, মারমা’রা সাংগ্রাই, তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু, ম্রো’দের চাংক্রান এবং আসামীদের বিহু।চৈত্র্যের শেষ দু’দিন এবং নতুন বছরের বৈশাখের প্রথমদিন পর্যন্ত চাকমা ও অন্যন্য জাতির মানুষ এটি পালন করলেও মারমাদের সাংগ্রাই শুরু হয় দু’একদিন পরে নিজেদের গণণার মগাব্দের অনুসারে।
দিন ক্ষণের ধরাবাঁধা নিয়ম থাকলেও এই সময়ে পাহাড়ে চলে ধুমধাম আয়োজন। গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় নানা ফুলের সৌরভে যেমন বাতাস মাতাল হয়, তেমনি কোকিলের মধুর সুরও দোলা দিয়ে যায় পাহাড়ী মানুষের মনকে। ‘বিজু পেক’ বলতে চাকমা’রা এক ধরণের পাখির আগমণ দেখে ঠিক এই সময়েই। আবার এই সময় শেষে সেই পাখির ডাক যেন কোথায় মিলিয়ে যায়। মগাব্দের শুরুতেই মারমা’রা জলখেলির আয়োজনে সাংগ্রাই এর জলে পুরনো যত জঞ্জালকে ধুয়ে পবিত্র হওয়ার উদ্যোগ নেয়। জুমের চূড়ায় চূড়ায় খুশির ‘রেঙ’ যেমন পাহাড়কে আন্দোলিত করে তেমনি ত্রিপুরাদের গড়িয়ার তালে তালে নৃত্য আয়োজনে গ্রামে গ্রামে খুশির বন্যা ঢেউ খেলে যায়। নানা আয়োজনে পাহাড়ে এ উৎসবের রঙ ছেয়ে যায় আর এ আয়োজন ধনী-গরীব সকল কিছুকেই ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু করোনা আতংকে পাহাড়ের এ রং যেন ফিকে হয়ে পাহাড়কে নীরবতা পালনে বাধ্য করেছে।
করোনা সংক্রমণের আশংকায় এবছর বর্ষ বরণ ও বর্ষ বিদায়ে পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ নিজেদের ঘরে বন্দী থেকে কেবল ঘরোয়া আয়োজনে ১৪২৭ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিল। কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের ঘরের নানা আয়োজনের ছবি এবং অনেক তরুণ ও অভিজ্ঞ কন্ঠ শিল্পী নিজেদের গানে গানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাতিয়ে এ উৎসবের আমেজকে ধরে রাখার চেষ্টা দৃষ্টিগোচর হয়েছে এই প্রতিবেদকের।
এরই মধ্যে বৈশ্বিক মহামারী করোনার পাশাপাশি পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিয়েছে হাম।ইতোমধ্যে তিনশতাধিক আক্রান্ত এবং কমপক্ষে ১০ জন শিশু মারাও গিয়েছে। যার ফলে সেখানেও তৈরী হয়েছে এক ধরণের মানবিক সংকট। সাজেকের বিভিন্ন ত্রিপুরা পাড়ায় ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের অনেক শিক্ষার্থীকে পৌঁছে দিতে হয়েছে দুর্গম প্রত্যন্ত জনপদে নিরাপদ পানি। এইসব নানা মানবিক আয়োজনেও ব্যাঘাত ঘটছে করোনা আতংকে পুরো পাহাড়ে চলমান লক ডাউনিং এর কারণে।এইসব নানা মানবিক সংকটে পাহাড়ের বিজু,বৈসু,সাংগ্রায়,বিষু,বিহু ও চাংক্রান যেন অচেনা হয়ে পাহাড়ে এসেছে আর নীরবেই হয়ে গেল পাহাড়ে ১৪২৭ কে বরণ ও ১৪২৬ কে বিদায়। তবে এই নিরব বর্ষ বরণ ও বিদায়ের মধ্যেও পাহাড়ের আদিবাসী মানুষের একটাই কামনা- চলমান বৈশ্বিক মহামারী থেকে উত্তোরণ ঘটে পুরো পৃথিবীটা যেন শীঘ্রই সুস্থ হয়ে ওঠে।আর পৃথিবীটা যেন আরো মানবিক হয়ে ওঠে।