পার্বত্য মন্ত্রণালয় পার্বত্য চুক্তির উল্টো পথে হাঁটছে: মঙ্গল কুমার চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের লক্ষে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার অংশ হিসেবে জেলা পর্যায়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও অঞ্চল পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আ লিক পরিষদ গঠিত হয়। আর স্কটিশ ধাঁচের স্বায়ত্তশাসনের আদলে জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেখভালের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের বিধান করা হয়। এজন্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, তিন সার্কেলের সার্কেল চীফ, তিন পার্বত্য সংসদীয় আসনের সাংসদ প্রমুখদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটির গঠনেরও বিধান করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পার্বত্য মন্ত্রণালয় কি পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেখভালের সেই দায়িত্ব যথাযথবাবে পালন করতে সক্ষম হচ্ছে? নাকি উল্টো পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বার্থ-বিরোধী তথা পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে? পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দু’টি অনুষ্ঠানের উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে বলে বিবেচনা করা যায়।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় দু’টি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত করেছে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে আমন্ত্রণ বা সম্পৃক্ত করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে আমন্ত্রণ করা তো আরো দূরের কথা। অথচ উক্ত দু’টি অনুষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ফসল হিসেবে উঠে এসেছে। এই দু’টি অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি হলো ইউএনডিপি’র পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই ও সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং আরেকটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন।
গত ৯ জুলাই ২০১৭ ইউএসএইড ও ড্যানিডার অর্থায়নে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূূচি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ বাস্তবায়নে ৫ বছর মেয়াদী ৩১ মিলিয়ন ডলারের ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই ও সমন্বিত উন্নয়ন (এসআইডি-সিএইচটি) প্রকল্প’ উদ্বোধন করা হয় রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উক্ত পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং। উক্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে আমন্ত্রণ বা সম্পৃক্ত করা হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে (যিনি প্রতিমন্ত্রী মর্যাদাসম্পন্ন) নিমন্ত্রণ করা হয় একটি সাধারণ আমন্ত্রণপত্র প্রেরণ করে যা ছিল অনেকটা অপমানের সামিল। অথচ আইন অনুসারে যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের এবং সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের এখতিয়ার হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের। উক্ত অনুষ্ঠানে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কোন প্রতিনিধি না দেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, যিনি উক্ত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যাদের নিয়ে আজকে এই উন্নয়ন প্রকল্প সেই অ লের জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে আমন্ত্রণ বা সম্পৃক্ত না করা কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল স্পিরিটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
গত ১৫ জুলাই ২০১৭ ঢাকার একটি হোটেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পালন হলো এ মন্ত্রণালয়ের ১৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। এ উপলক্ষে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কাজী গোলাম রহমান। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফসল এই পার্বত্য মন্ত্রণালয় হলেও এ চুক্তির অন্যতম পক্ষ জনসংহতি সমিতির কাউকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। এমনকি আমন্ত্রণ করা হয়নি পার্বত্য চুক্তির অন্যতম রূপকার ও স্বাক্ষরকারী, জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে বা তাঁর কোন প্রতিনিধিকে। উক্ত আলোচনা সভার প্রধান অতিথি হাসানুল হক ইনু এ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির পেছনে যাদের নেতৃত্বে রক্তপিচ্ছিল সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও জনসংহতি সমিতির বর্তমান নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার অবদান স্বীকার করলেও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের কোন মন্ত্রী-আমলা ভুলেও তাদের অমূল্য অবদানের কথা স্মরণ করেননি।
পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ১৯তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত উক্ত আলোচনা সভায় পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-আমলারা পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের কোন বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য প্রদান করেননি। এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ জানিয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কাজী গোলাম রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ১৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের এখনো কোন রোডম্যাপ নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে রোডম্যাপ থাকবে না কেন? রোডম্যাপ ছাড়া এতবড় অর্জন এই চুক্তির বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়া কখনোই সম্ভব নয় বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে চলমান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সংক্রান্ত মামলা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগহীনতার জন্য তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, কেবল উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে একটা অঞ্চলের শান্তি নিশ্চিত করা যায় না। তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে স্বশাসন ও আইনের শাসনের মতো গণতান্ত্রিক অধিকার ও প্রক্রিয়াসমূহ। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চুপ থেকেছেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আর চুপ থাকার সময নয়। এখন এ বিষয়গুলো বলতে হবে এবং যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে বলে তিনি জোরালো অভিমত তুলে ধরেন। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির উপর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি নির্ভর করে। তাই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়গুলোর উপর, বিশেষত: শান্তি ও উন্নয়নের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
উল্লেখিত দু’টি ঘটনার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে গঠিত এই মন্ত্রণালয় এখন কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী ভুমিকা পালন করে চলেছে এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করছে। পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে বর্তমান সরকারের দেশে-বিদেশে যে মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তা উঠে এসেছে এই মন্ত্রণালয়ের উর্বর মস্তিস্ক থেকে। প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং ও সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার নেতৃত্বে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের বর্তমান এজেন্ডা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম পক্ষ জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে এবং সমিতির নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে উপেক্ষা করে চলা এবং প্রকারান্তরে অর্থব করে ফেলা।
পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-আমলারা ক্লান্তিহীনভাবে পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়ন কার্যক্রমের ফিরিস্তির বুলি আওড়িয়ে চললেও পার্বত্য চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তাদেরকে সরব ও তৎপর হতে দেখা যায় না। চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলোর মধ্যে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী হস্তান্তর এবং এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিতকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ; ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কার্যবিধিমালা চূড়ান্তকরণ এবং পর্যাপ্ত তহবিল ও জনবল বরাদ্দ পূর্বক ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ; ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণসহ পুনর্বাসন; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ; চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ ও চেষ্টা-চরিত্র লক্ষ্য করা যায় না। এমনকি সুপীম কোর্টের আপীল বিভাগে চলমান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সংক্রান্ত মামলার কাজ এগিয়ে নিতে পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়। এভাবে আজ পার্বত্য চুক্তির ফলে সৃষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পার্বত্য চুক্তির উল্টো পথে হাঁটছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে জটিল থেকে জটিলতর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।