মতামত ও বিশ্লেষণ

পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধনঃ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরোধিতা ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নিরবতা- মঙ্গল কুমার চাকমা

দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও দেনদরবারের পর অবশেষে গত ১ আগস্ট ২০১৬ তারিখ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনকল্পে মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি সাপেক্ষে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৯ আগস্ট “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১৬” নামে উক্ত সংশোধনী আইনের প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে তড়িঘড়ি করে ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পাশ করেছিল। ফলে উক্ত আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে অনেক বিরোধাত্মক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও নাগরিক সমাজ ভূমি কমিশন আইনের এই বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধনের জন্য একদিকে সভা-সমিতির মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে, অন্যদিকে সরকারের সাথে একের পর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত করে আসছে। বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক অনেক বৈঠকের পর ২০১১ এবং ২০১৫ সালে দুইবার সরকার ও আঞ্চলিক পরিষদের মধ্যে ১৩-দফা সংশোধনী প্রস্তাবাবলী সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তদনুসারে উক্ত ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া এক রহস্যজনকভাবে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে থাকে।
১. সেটেলার বাঙালিদের বিরোধিতা ও অপপ্রচার:
মন্ত্রীসভা বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ অনুমোদনের পর পার্বত্য নাগরিক পরিষদ, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ, পার্বত্য গণপরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন ও পার্বত্য বাঙালি ছাত্র ঐক্য পরিষদ নামে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক পরিচালিত পাঁচটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন উক্ত আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় তিন পার্বত্য জেলা ও ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে এবং সর্বশেষ গত ১০-১১ আগস্ট দুইদিন ব্যাপী তিন পার্বত্য জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। তারা আরো কঠোর কর্মসূচির ঘোষণার হুমকি দিয়ে চলেছে।
সেটেলার বাঙালিদের উক্ত পাঁচ সংগঠনের বক্তব্য হচ্ছে, “নতুন এ আইনের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালিরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবেন এবং ভূমির অধিকার হারাবেন। …আগে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হতো। কমিশনের নয় সদস্যের মধ্যে দু’জন থাকতো বাঙালি। কিন্তু এখন আইনে সংশোধনীর ফলে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তে আর কোনও বিষয় চূড়ান্ত হবে না। চেয়ারম্যানসহ অন্তত তিন সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন হবে কোরামের জন্য। আর এতে পাহাড়িদের আধিক্য থাকবে ও নিজেদের অধিকার ক্ষুন্ন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন’ (বিবিসি ১০ আগস্ট; পার্বত্যনিউজ ১১ আগস্ট)। আর সে কারণে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধনী বাতিলের দাবি জানাচ্ছে এই পাঁচটি সেটেলার বাঙালি সংগঠন।
২. কী সংশোধন করা হয়েছে:
সেটেলার বাঙালিদের বক্তব্য ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে অনেকে মনে করতে পারেন, পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিষদকে বা জনসংহতি সমিতিকে বা জুম্ম জনগণকে নতুন আরো ক্ষমতা বা অধিকার দেয়া হয়েছে। বস্তুত এই আইন সংশোধনের মাধ্যমে নতুন কোন অধিকার বা ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। এই আইন সংশোধনের মাধ্যমে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে এই ভূমি কমিশন আইনটি সঙ্গতিপূর্ণ করা হয়েছে এবং চুক্তিতে বর্ণিত কার্যাবলী বা এখতিয়ার ভূমি কমিশনের উপর ন্যস্ত করার বিধান যথাযথভাবে করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ‘ভূমি কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন’ মর্মে উল্লেখ রয়েছে। ২০০১ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে কেবলমাত্র ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি’ উল্লেখ ছিল। ‘পদ্ধতি’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রচলিত ‘পদ্ধতি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই ‘পদ্ধতি’ শব্দটি এবারের ২০১৬ সালের সংশোধিত ভূমি কমিশন আইনে সন্নিবেশ করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও এযাবৎ যেইসব জায়গা-জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হইয়াছে সেই সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিলকরণের পূর্ণ ক্ষমতা এই কমিশনের থাকিবে’ মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ২০০১ সালের ভূমি কমিশন আইনে কেবলমাত্র ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা’র বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ‘যেইসব জায়গা-জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হইয়াছে সেই সমস্ত জমি ও পাহাড়ের’ বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়া হয়েছিল। অথচ প্রত্যাগত জুম্ম শরণাথীদের জমিজমা সংক্রান্ত ভূমি বিরোধ ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর ‘বন্দোবস্ত’ ও ‘বেদখল’ সংক্রান্ত ভূমি বিরোধ রয়েছে। এবারের ২০১৬ সালের সংশোধিত ভূমি কমিশন আইনে উক্ত ‘বন্দোবস্ত’ ও ‘বেদখল’ সংক্রান্ত ভূমি বিরোধের বিষয়টি সন্নিবেশ করা হয়েছে।
২০০১ সালের ভূমি কমিশন আইনে “চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সহিত আলোচনার ভিক্তিতে ৬(১)-এ বর্ণিত বিষয়টিসহ উহার এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হইলে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে” মর্মে কমিশনের চেয়ারম্যানকে একতরফা ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। এবারের ২০১৬ সালের সংশোধিত ভূমি কমিশন আইনে সেই একক ও স্বৈরাচারী ধারাকে সংশোধন করে গণতান্ত্রিক করা হয়েছে যাতে বলা হয়েছে “চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্ত কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে”। মহামান্য হাইকোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চেও সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতির ভিত্তিতে যেভাবে রায় দেওয়া হয়, তারই আঙ্গিকে ভূমি কমিশন আইনের এই বিধানও সংশোধিত হয়েছে।
উক্ত সংশোধিত আইনে কমিশন বৈঠকের কোরামের জন্য ‘চেয়ারম্যানসহ অপর দুই সদস্যের’ পরিবর্তে ‘চেয়ারম্যানসহ অপর তিন সদস্যের’ উপস্থিতির বিধান সংযোজন করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে কমিশনের কার্যপ্রণালীকে আরো বেশি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহি ও স্বচ্ছ করা হয়েছে। অধিকন্তু ‘কমিশনের সচিবসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে পার্বত্য জেলার উপজাতীয়দের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগের বিষয়টি এবারের সংশোধনী আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে কমিশনের চাকরিতে পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে পার্বত্য জেলাসমূহের স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
৩. অন্যায্যভাবে উচ্ছেদ ও ভূমি হারানোর আশঙ্কা অমূলক:
বস’ত ভূমি কমিশন আইনের উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনে জুম্মদের সদস্য সংখ্যা যেমনি বৃদ্ধি করা হয়নি, তেমনি বাঙালিদের সদস্য সংখ্যাও কমানো হয়নি। কমিশনের চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা কমিয়ে ও কোরামের জন্য চেয়ারম্যানসহ দুইজন সদস্যের পরিবর্তে তিনজন করার ফলে অন্য কোন সদস্যের ক্ষমতাও বাড়ানো হয়নি। বরঞ্চ অধিকতর গণতান্ত্রিক ধারা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতাকে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের ভূমি অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে ‘পাহাড়িদের আধিক্য থাকবে ও বাঙালিদের অধিকার ক্ষুন্ন হবে’ কিংবা ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালিরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবেন এবং ভূমির অধিকার হারাবেন’ এমন আশঙ্কা নিতান্তই অমূলক ও অবান্তর।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী পাহাড়ি-বাঙালি যাদের জায়গা-জমি বন্দোবস্ত ও ভোগদখল রয়েছে তাদের অন্যায্যভাবে উচ্ছেদ হওয়ার বা ভূমি অধিকার হারাবার কোন কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতিকে লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে, জবরদস্তি উপায়ে কিংবা পদ্ধতি-বহির্ভুতভাবে জায়গা-জমি বন্দোবস্তী নিয়েছেন বা বেদখল করেছেন তাদের তো আইনের আওতায় আসতেই হবে এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে তো অবৈধ বন্দোবস্তী বা বেদখল ছেড়েই দিতে হবে। সেইসব অবৈধ দখলদারদের পক্ষে সাফাই গাওয়া কখনোই মানবিক, ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক হতে পারে না। বলাবাহুল্য, বাঙালিরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও ভূমি অধিকার হারাবার সস্তা শ্লোগান তুলে ধরে সাধারণ বাঙালিদের তথা দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার যেভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে সেভাবে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও চুক্তির বিরুদ্ধে সেইরূপ অপপ্রচার চালিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
৪. স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও প্রশাসনের নিরবতা:
পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের একটা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসেবে নি:সন্দেহে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এই আইন সংশোধনকে কেন্দ্র করে তথা এই আইনের সংশোধনীর বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তবাদী মহল যে অপপ্রচার, হরতাল ও হুমকি-ধামকি দিয়ে চলছে তার বিরুদ্ধে তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও প্রশাসন একেবারেই নিরব ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এই সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও উগ্র জাতীয়তবাদী শক্তির অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে তারা একেবারেই দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে।
অথচ যখন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের বিরুদ্ধে যৌক্তিক কারণে পার্বত্যবাসী ও দেশের নাগরিক একাট্টা হয়ে বিরোধিতা করতে থাকে, সেই জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দীপঙ্কর-বীর বাহাদুর-ক্যশৈহ্লা-কুজেন্দ্র নেতৃত্বাধীন তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও প্রশাসন উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠে। ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি সেই বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হামলার জন্য দীপঙ্কর তালুকদারের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ তাদের লালিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছিল। অধিকন্তু তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে নির্বাচিত পরিষদ গঠন না করে এবং ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত চেয়ারম্যান-সদস্যদের দ্বারা অন্তর্বর্তী পরিষদের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে অগণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার হীনউদ্দেশ্যে যখন সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করে অন্তর্বর্তী পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৫ থেকে ১৫-তে বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল তখন তার বিরুদ্ধে পার্বত্যবাসী ও দেশের নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়ও জনমতের বিপরীতে তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব আন্দোলনকারী জনতার বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকি ও রাজনৈতিক প্রতিরোধে তৎপর ছিলেন।
অথচ সংশোধিত ভূমি কমিশন আইন ২০১৬-এর বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর চলমান পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী নাশকতামূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগ এখনো নিরব রয়েছে। গত ১২ আগস্ট রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমীর আয়োজনে শিল্পকলা সম্মেলন কক্ষে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আলোচনা সভায় রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার ভূমি কমিশন আইন সংশোধনীর বিরোধিতার নামে পাঁচ সেটেলার বাঙালি সংগঠনের চলমান সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গীবাদী তৎপরতা বিষয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। এর মধ্য দিয়েই পার্বত্য জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগের চুক্তি-পরিপন্থী ও জুম্ম-স্বার্থ বিরোধী এবং পক্ষান্তরে সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গীবাদী তৎপরতার প্রতি সহানুভূতিশীল ভূমিকাকে স্পষ্টভাবে উন্মোচিত করে বলে নি:সন্দেহে বলা যেতে পারে। ভূমি কমিশন আইন সংশোধনীর বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর এই সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গী তৎপরতাকে জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার হীনউদ্দেশ্যে তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগ নানাভাবে ইন্ধন দিয়ে চলেছে বলে নানা সূত্রে জানা যায়।
বলাবাহুল্য, স্থানীয় আওয়ামীলীগসহ জাতীয় রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত অনেক ব্যক্তিবর্গ ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনীর বিরোধিতাকারী পাঁচ সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর সাথে নানা কায়দায় সম্পৃক্ত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে এসব জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর অহি-নকুল সম্পর্ক হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চুক্তি বিরোধিতার ক্ষেত্রে, জুম্ম-স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমে, জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তারা একে অপরের সাথে এক গভীর ঐক্যে আবদ্ধ হতে অবিশ্বাস্য ও উদ্বেগজনকভাবে লক্ষ করা যায়। ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর বিরোধিতা ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকার মধ্য দিয়ে এসব সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর প্রতি তাদের নিরব সমর্থনের বিষয়টি আরেকবার পার্বত্যবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ও তার জোট সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সোচ্চার হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় তাদের শাখা সংগঠন সেই সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুরিপুষ্ঠ করে চলেছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে যা কখনোই কাম্য হতে পারে না।
তারিখ: ১৩ আগস্ট ২০১৬

Back to top button