জাতীয়

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্যাঞ্চল একটি মহাশ্মশানে পরিণত হয়েছেঃ সন্তু লারমা

‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপপন্থী সকল কার্যক্রম প্রতিরোধ করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে অধিকতর আন্দোলন সংগঠিত করুন’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, সাবেক গলপরিষদ ও জাতীয় সংসদ সদস্য, বিপ্লবী মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে আজ রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে এক স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়।

জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি সুবর্ণ চাকমার সভাপতিত্বে স্মরণ সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, জনসংহতি সমিতির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক কল্পনা চাকমা, বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী রঞ্জিত দেওয়ান, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অরুণ ত্রিপুরা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুমন মারমা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নীলোৎপল খীসা ও সদস্য সুপ্রভা চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় শোক প্রস্তাব পাঠ করেন জনসংহতি সমিতির ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক ত্রিজিনাদ চাকমা।

স্মরণ সভার পূর্বে সকাল ৮টায় রাজবাড়িস্থ জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে প্রভাতফেরি শুরু হয়। ব্যানার ফেস্টুন সহকারে দুই লাইনে সারিবদ্ধ হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে বনরূপা প্রদক্ষিণ করে প্রভাতফেরিটি শিল্পকলা একাডেমিতে এসে শেষ হয়। তারপর শুরু হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার ও এম এন লারমার প্রতিকৃতিতে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের পুষ্পমাল্য অর্পণ। পুষ্পমাল্য শেষে শুরু হয় স্মরণ সভা। জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও ফানুস উড়ানো হয়। এছাড়া এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী লেখক ফোরামের উদ্যোগে বিকাল ৪টায় আয়োজন করা হয় কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী লেখক ফোরামের সভাপতি শিশির চাকমার স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে প্রায় ৩০ জন কবি কবিতা পাঠ করেন।

জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, ১০ই নভেম্বর ’৮৩-তে এম এন লারমাসহ অনেককে নৃশংস হত্যা ছিল একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। এই হত্যাকান্ডের পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র জড়িত ছিল। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে ধ্বংস করার হীনউদ্দেশ্যে বিভেদপন্থী চার কুচক্রী দ্বারা সেই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। মহান নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল সেই কুচক্রী মহল। সেই বিভেদপন্থী, সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এখনো সক্রিয় রয়েছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য তারা বর্তমানে উঠে পড়ে রয়েছে। সেজন্যই আজকে স্মরনসভায় বক্তাদের বক্তব্যে সেসব সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সতর্ক হওয়ার ও তাদের প্রতিরোধ করার হওয়ার কথা উঠে এসেছে। জুম্ম সমাজে যারা সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, সরকার-শাসকগোষ্ঠীর লেজুর হয়ে নিজেদের স্বার্থ পরিপূরণে সবসময় যারা সচেষ্ট রয়েছে তাদের সম্পর্কে আজকের স্মরণসভা আমাদেরকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে তাদের ব্যাপারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে, আরও সংগ্রামী হতে হবে। দরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াই-সংগ্রামকে আরো উজ্জীবিত করা ও নিজেকে আরো সমর্পিত করা।

তিনি আরো বলেন, আজকে যারা এই লড়াই-সংগ্রামকে গলা টিপে হত্যা করতে চাচ্ছেন এবং আমাদের জুম্ম সমাজের সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল যারা রয়েছে তাদের প্রতিরোধ ও প্রতিবিধান করা সবচেয়ে জরুরী হয়ে পড়েছে বলে আমি মনে করি। আজকে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন করেছে। কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হতে পারছে না এবং সরকার বাস্তবায়ন করছে না। এখানে ষোলো আনা সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। বাংলাদেশ জন্মলাভ করেছে ৪৬ বছর হয়েছে। ৪৬ বছর ধরে আমরা পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণ তথা এই এলাকার পাহাড়ি-বাঙালি অধিবাসীরা আমরা সেনাশাসনে রয়েছি। সেনা শাসন, গোয়েন্দা বাহিনী, এখানকার আমলা বাহিনী, ক্ষমতাসীন দলের সেটেলারদের মিলিতভাবে যে দমন-পীড়ন, নির্যাতন, শোষণ, বঞ্চনা আজকে সীমাহীন পর্যায়ে চলে গেছে। আজকে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমাদের নিরাপত্তাহীন, অনিশ্চিত জীবন নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এ জীবন আমরা মেনে নিতে চাই না এবং আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত নই। সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন চায় না। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করতে চায়। সেজন্য আজ জুম্ম জনগণের জীবন এক নিরাপত্তাহীন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বিরাজ করছে। পার্বত্য চুক্তির পর ২০ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ একটি মহা শ্মশানে পরিণত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ষাট দশকে ছাত্র-যুব সমাজের প্রতি এম এন লারমার আহ্বান ছিল ‘গ্রামে চলো’। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত শত যুবক গ্রামে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেছিলেন। এম এন লারমা নিজেও শিক্ষকতা করেছিলেন। শিক্ষকতার মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষায় সচেতন করেছিলেন। শিক্ষার পাশাপাশি ঘুমন্ত জুম্ম সমাজকে রাজনৈতিকভাবে জাগরিত করেছিলেন। তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতা নন, তিনি সমগ্র দেশের নেতা ছিলেন। তাঁর সংসদীয় বক্তব্য আমি শুনেছি। তিনি আস্তে আস্তে যুক্তিসঙ্গতভাবে বক্তব্য দিতেন এবং শব্দ প্রয়োগ করতেন। কি প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি সংসদীয় বক্তব্য দিতেন তা আমি দেখেছি। তাঁর বক্তব্য প্রদানকালে অনেক সাংসদ তাঁকে ঠাট্টা করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর বক্তব্য ও দাবিনামা তুলে ধরতে পিছপা হননি। উনসত্তরে অন্যতম জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল সব কথার শেষ কথা স্বায়ত্তশাসিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু কতটুকু তা অর্জিত হয়েছে? আমি মনে করি, আমরা একেবারেই বিফল হইনি। আমাদের আরো কঠোর আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করেই সেই সফলতার পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হবে।

জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা বলেন, এম এন লারমা ছিলেন মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি ক্ষমতা গুণ, শিক্ষা গ্রহণের গুণ, পরিবর্তন হওয়ার গুণ-এর কথা বলেছিলেন। তারই আলোকে বিভেদপন্থীদেরকে ‘ক্ষমা করা ভুলে যাওয়া’ নীতির ভিত্তিতে ক্ষমা করা ও পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা সফল হয়নি। তিনি বলেছিলেন, আমাদের প্রধান কাজ হবে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। জুম্ম সমাজের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। এজন্য তিনি সাংগঠনিক নীতি দিয়েছিলেন যেটায় তিনি বলেছিলেন, শত্রুকে নিরপেক্ষ করতে হবে, নিরপেক্ষকে সক্রিয় করতে হবে। আওয়ামীলীগের এক নেতার বক্তব্য উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও এদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক হতে পারেনি। তাই দেশের ০.০১ শতাংশ মানুষ পার্বত্য চুক্তির পক্ষে থাকলেও ৯৯.০৯ শতাংশ মানুষ চুক্তি বিরোধী। এই বাস্তবতা মনে রেখেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে তিনি বলেন।

Back to top button