মতামত ও বিশ্লেষণ

পার্বত্য চুক্তি করে পিসিজেএসএস কি ভুল করেছে? অনুরাগ চাকমা

পার্বত্য চুক্তি নিয়ে ঢাবি’র শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অনুরাগ চাকমার একটি ভিন্নধর্মী বিশ্লেষণ

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি করে পিসিজেএসএস জুম্ম জনগণের সাথে প্রতারণা করেছে। সরকারের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে সন্ত লারমা জুম্ম জনতার সাথে বেইমানি করেছে। জুম্ম জনগণের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করেছে। এটা কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ? চুক্তির ২৫ বছর পরেও এই প্রশ্নটি জুম্ম সমাজে প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে।
পিসিজেএসএস কেন শান্তি চুক্তি করল? আপনি এই প্রশ্নটি নিয়ে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ভাবতে পারেন। বিশ্বে কি শুধুমাত্র পিসিজেএসএস সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি করেছে? চুক্তি করার মাধ্যমে জনগণকে প্রতারিত করেছে? আপনার-আমার পারসেপশন অনুসারে প্রতিটি শান্তি চুক্তি যদি প্রতারণার বিষয় হয়, তাহলে UCDP Peace Agreement Dataset Version 22.1 তথ্য মতে ১৯৭৫-২০২১ সালের মধ্যে দেশে-দেশে ৩৭৪টি শান্তি চুক্তি কিভাবে হল? পিসিজেএসএস না হয় প্রতারণা করল, দালালি করল, ভুল করল, তাহলে দেশে-দেশে শত-শত অধিকারকামী সংগঠন কেন একই ভুল করবে? আমার প্রশ্নটা সেখানে।
গবেষণা দাবি করে, স্নায়ু যুদ্ধের পরে বিশ্বে শান্তি চুক্তি কয়েকগুন বেড়েছে। এজন্য আপনাকে বুঝতে হবে, কেন শান্তি চুক্তি হয়? কখন সরকার এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো চুক্তি করে? এই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের ডিসিপ্লিনে অনেক গবেষণা হয়েছে। এসব অনেক গবেষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Johns Hopkins University-এর অধ্যাপক I. William Zartman-এর দেওয়া Ripeness Theory ব্যবহৃত হয়েছে। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত গোষ্ঠীগুলো (Conflicting Parties) এমন সময়ে চুক্তিতে উপনীত হয় যখন উভয় পক্ষ উপলব্ধি করতে পারে এক পাক্ষিক (Unilateral means) পদক্ষেপ/কৌশলের মাধ্যমে যুদ্ধের সন্তোষজনক কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসবে না। বরং, যুদ্ধ চলমান থাকলে উভয় পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেটাকে আমরা Negative-Sum Outcome বলে থাকি। উভয় পক্ষ যখন এটা বুঝতে পারে সেই সময় এবং বাস্তবতাকে আমরা “Ripe Moment” এবং “Mutually Hurting Stalemate” হিসিবে অধ্যয়ন করে থাকি। অর্থাৎ, Ripe Moment-এ উভয় পক্ষ যুদ্ধ থেকে বের হয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চলমান সমস্যার একটা সমাধান (Way Out/Positive-Sum Outcome) করার চেষ্টা করে। অনেকটা Prisoner Dilemma Game থেকে বের হয়ে Cooperative Game শুরু করে।
তত্ত্ব নিয়ে লেখাটা জটিল করতে চায় না। বরং, Simulation-এ গেলে বুঝতে সুবিধা হবে। আমরা সবাই জানি, সরকার শান্তি চুক্তি করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পেরেছে। সরকার নানা দিকে থেকে লাভবান হয়েছে। আপাতত সরকারের লাভ-ক্ষতির হিসাবটা (Cost-benefit analysis) বাদই দিন। বরং পিসিজেএসএসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেটা নিয়ে ফোকাস করা যাক। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি না হলে জুম্মরা কি লাভবান হত? লাভবান হলে কিভাবে হত? স্বায়ত্তশাসনের বেশি পেতেন? নাকি বর্তমান শান্তি চুক্তির চেয়ে বেশি রাজনৈতিক অধিকার পেতেন? মাইগ্রেশন থেমে থাকত? পাহাড়িদেরকে উচ্ছেদ করার কর্মযজ্ঞ বন্ধ থাকত?
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আপনার আফ্রিকায় যাওয়ার দরকার নেই। ল্যাটিন আমেরিকায় যাওয়ার দরকার নেই। দক্ষিণ এশিয়া থেকে সিমিলার কেস স্টাডি নিতে পারেন। প্রতিবেশী ভারতে মিজোরা কি পেয়েছে? শ্রীলঙ্কায় তামিলরা কি পেয়েছে? ভারতের কাশ্মীরে জনগণ কি পেয়েছে? পাকিস্তানের বেলুচেস্তানে জনগণ কি পেয়েছে? আপনার সমস্যা তো আপনার একার না। দেশে-দেশে লড়ায়-সংগ্রাম চলছে। এসব কেস স্টাডি বিবেচনায় নিলে আপনার কি মনে হয়, বর্তমান শান্তি চুক্তি আপনার জন্য কম হয়েছে?
বর্তমান চুক্তিতে ভাল কিছু কি একেবারে নেই? তবে হ্যাঁ, চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা এবং রোডম্যাপ নেই। কথা সত্য। বিশ্বে কি একমাত্র পিসিজেএসএস এই কাজটি করেছে? আমাদের এটা জানা দরকার। অনেক দেশের শান্তি চুক্তিতে বাস্তবায়নের সময়সীমা নেই। ক্রোয়েশিয়ার ১৯৯৫ সালের Erdut Agreement এবং ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী সরকারের সাথে নেলসন ম্যাণ্ডেলার স্বাক্ষরিত Interim Constitution Accord-এ চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা উল্লেখ নেই। Kroc Institute-এর মতে, চুক্তি সম্পাদনের দশ বছরের মধ্যে ক্রোয়েশিয়ার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের হার ৭৩.৩৩ শতাংশ। অপরদিকে, চুক্তি সম্পাদনের দশ বছরের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের হার ৯২.০০ শতাংশ। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা উল্লেখ না থাকার পরেও এই দুটো চুক্তির অগ্রগতি কি প্রমাণ করে না, চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বরং সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ?
তাই, চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা এবং রোডম্যাপ (যেটা দিয়ে পিসিজেএসএসকে খোঁচা মারা হয়) থাকলে যে চুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেটা সন্দেহাতীতভাবে ভাবা অনেকটা বোকার স্বর্গে বসবাস করা। কেন বলছি জানেন? দুটো উদাহরণ দিয়ে বিষয়টার ব্যাখ্যা করি। Djibouti-তে ২০০১ সালে শান্তি চুক্তি হয়েছিল। বাস্তবায়নের সময়সীমা উল্লেখ থাকার পরেও চুক্তি সম্পাদনের দশ বছরের মধ্যে মাত্র ৫১.৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। Philippines-এ ১৯৯৬ সালে Mindanao Final Agreement হয়েছে। এই চুক্তিটিতেও বাস্তবায়নের সময়সীমা উল্লেখ থাকার পরেও এই চুক্তির মাত্র ৫৯.৭২ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এই দুটো চুক্তির বাস্তবায়নের অগ্রগতি অনেকটা আমাদের পার্বত্য চুক্তির মত বলা যেতে পারে। তাই, আমাদের পার্বত্য চুক্তিতে না হয় বাস্তবায়নের সময়সীমা উল্লেখ নেই। কিন্ত এই দুই দেশের চুক্তিতে তা উল্লেখ আছে। তাহলে কেন এই দুটো চুক্তির বাস্তবায়ন থমকে গেছে? বাস্তবায়নের সময়সীমার সাথে চুক্তির অগ্রগতির হওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে, এটা এই দুটো উদাহরণ তা ভুল প্রমাণিত করে। তবে হ্যাঁ, চুক্তিতে বাস্তবায়নের সময়সীমা এবং রোডম্যাপ থাকলে ক্ষতি হয় না। তবে, এটা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একমাত্র Explanatory Variable না।
চুক্তি বাস্তবায়ন প্রত্যাশিতভাবে না হলেও সরকারের পাশাপাশি পাহাড়িদেরও একটা বিশাল অর্জন হয়েছে। সেটা হল, শান্তি চুক্তি করার মাধ্যমে সরকার পাহাড়িদের অধিকার মেনে নিয়েছে। পাহাড়িরা দীর্ঘ দুই যুগের বেশি যে লড়ায়-সংগ্রাম করেছে তা যে যৌক্তিক ছিল অন্তত তার বৈধতা মিলেছে। একথা কমবেশি আমাদের সবাইকে মানতে হবে।
শেষ করব এই বলে, নিজের ইতিহাসকে অস্বীকার করে কেউ নিজের ভবিষ্যতকে গড়তে পারে না। ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৭২ সাল থেকে জুম্ম জনগণের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে লড়ায়–সংগ্রামের গোরবোজ্জল ইতিহাস, সেটার জন্ম দিয়েছে আজকের দিনের এই পিসিজেএসএস। তখন তো আজকের দিনের মত অনেক সংগঠন ছিল না। মনে রাখবেন, আপনি যদি আপনার সিনিয়র নেতৃবৃন্দদের সন্মান করেন, আপনার জুনিয়ররাও আপনাকে সন্মান করবে। কারণ, আপনি সেই শিক্ষা আপনার পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়েছেন। জুম্ম জনগণের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসুক। ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সঠিক ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে সমাজে মঙ্গল আসুক – এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক- অনুরাগ চাকমা
সহকারী অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পিএইচডি গবেষক, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

Back to top button