মতামত ও বিশ্লেষণ

পার্বত্য চুক্তির প্রকৃত বাস্তবায়নের পরিবর্তে সরকার সক্রিয় রয়েছে অপপ্রচার ও মিথ্যাচারেঃ মঙ্গল কুমার চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া শুরু করা ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কোন উদ্যোগ নেই বললেই চলে। বরঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে সরকারকে সক্রিয় থাকতে দেখা যায় চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করতে গোয়েবলসীয় কায়দায় নিরবিচ্ছন্ন অপপ্রচার ও মিথ্যাচারে। সেই সাথে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদের সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব ধ্বংস, জুম্মদের ভূমি জবরদখল, তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উৎখাত, বহিরাগত অনুপ্রবেশ, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বনজ সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যসহ আন্দোলনরত অধিকার কর্মীদেরকে চাঁদাবাজি, অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ইত্যাদি সাজানো অভিযোগে অভিযুক্ত করে মিথ্যা মামলা দায়ের, ধরপাকড়, জেলে প্রেরণ, ক্যাম্পে আটক ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি তল্লাসী ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন জোরদার করেছে।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি: গত আগস্ট মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারাসমূহ সংশোধনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের এ যাবৎ তিনটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি ২০১৭ বান্দরবান জেলার সার্কিট হাউজে তৃতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর কার্যবিধিমালা প্রণয়নের পর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত আবেদনপত্রের শুনানী বা বিচারিক কাজ শুরু করা, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় কমিশনের শাখা কার্যালয় স্থাপন, কমিশনের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ ও জনবল নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে পুনরায় তুলে ধরা, দাখিলকৃত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদনগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করা ইত্যাদি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে জানা যায়। উল্লেখ্য যে, ১০ জানুয়ারি ২০১৭ পর্যন্ত মোট ২২,৮৬৬টি আবেদন কমিশনের নিকট জমা পড়েছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
আরো উল্লেখ্য যে, পার্বত্য ভূমি কমিশন গঠিত হলেও কমিশনের নেই পর্যাপ্ত জনবল, তহবিল ও পারিসম্পদ। কমিশনের এ যাবৎ একজন সচিব, একজন রেজিস্টার ও একজন পিয়ন ছিল। কিন্তু গত নভেম্বরে কমিশনের সচিবকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। ফলে কমিশনে কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো এখন মাত্র একজন রেজিস্টার রয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে একটি অর্গানোগ্রাম প্রস্তাব করা হলেও সরকার এখনো তা অনুমোদন করেনি। অপরদিকে কমিশনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো কোন তহবিল নেই। সরকারের কাছে তদ্বির করেও এখনো সরকার পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ প্রদান করেনি। ফলে জনবল ও তহবিলের অভাবে কমিশনের কাজ চালিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। খাগড়াছড়ি জেলায় কমিশনের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হলেও তহবিল, জনবল ও পারিসম্পদের অভাবের কারণে এখনো রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় শাখা কার্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান থেকে খাগড়াছড়িতে গিয়ে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত আবেদনপত্র জমা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের পর গত ৩০ অক্টোবর ২০১৬ রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত কমিশনের দ্বিতীয় সভায় সংশোধিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ অনুসারে কমিশনের কার্যবিধিমালার খসড়া তৈরির জন্য কমিশনের অন্যতম সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তদনুসারে খসড়া কার্যবিধিমালা তৈরি করে তা তিনি জানুয়ারি ২০১৭-এ প্রথমার্ধে ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সরকার সেই কার্যবিধিমালা চূড়ান্ত করেনি। ফলে কার্যবিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ার কারণে কমিশনের ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত মামলার শুনানী বা বিচারিক কাজ শুরু করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্ত ও প্রত্যাগত শরণার্থী পুনর্বাসন: গত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে প্রত্যাগত শরণার্থী পুনর্বাসন এবং আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের তালিকা প্রস্তুতকরণ ও পুনর্বাসন, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের মধ্যে পূর্বতন চাকরিতে পুনর্বহালকৃত ব্যক্তিদের সিনিয়রিটি প্রদান, ঋণ গ্রহণকারী শরণার্থীদের তালিকা প্রস্তুত ও তাদের ঋণ মওকুফ, টাস্ক ফোর্সের কার্যাবলী (টিওআর) সংশোধন, টাস্কফোর্সের সদস্যদের সম্মানী ভাতা নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে টাস্কফোর্স কমিটি গঠিত হলেও ১৯৯৮-২০০১ সালে টাস্কফোর্সের তৎকালীন চেয়ারম্যান দীপঙ্কর তালুকদারের আমলে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণভাবে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পরিচিহ্নিত করা হয়। সেসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি লঙ্ঘন করে সেটেলার বাঙালিদেরও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে চরম জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ কারণে আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজ আজ অবধি অগ্রগতি সাধিত হয়নি।
পার্বত্য চুক্তি সংক্রান্ত আপিল মামলার শুনানী: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্টের প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে দায়েরকৃত আপিল মামলার শুনানী উদ্বেগজনকভাবে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালের এপ্রিলে আপিল আবেদনের দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর গত ৩০ আগস্ট ২০১৬ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ সম্পর্কে আপীলকৃত এই মামলার শুনানী শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের রায় হওয়ার কারণে মামলাটি সেদিন শুনানীর তালিকার আসেনি। এরপর যথাক্রমে ৪ জানুয়ারি, ২৪ জানুয়ারি ও সর্বশেষ ৩১ জানুয়ারি মামলাটির শুনানীর তালিকায় ছিল। কিন্তু প্রত্যেক বারে সময়ের অভাবে শুনানী শুরু হতে পারেনি। সর্বশেষ ৩১ জানুয়ারি ২০১৭ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফোয়েজ সিদ্দিক, বিচারপতি মির্জা হুসাইন হায়দার ও বিচারপতি মো: নিজামুল হক-এর সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যক বেঞ্চে পার্বত্য চুক্তি সংক্রান্ত আপিল মামলার (সিভিল আপিল, ৯৪/২০১১, সি.এ. ৯৫/১১) শুনানীর জন্য ১৫ ক্রমিকে তালিকাভুক্ত ছিল।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরুদ্ধে ২০০০ সালে বদিউজ্জামান ও ২০০৭ সালে এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম কর্তৃক দায়েরকৃত পৃথক দু’টি মামলায় গত ১২-১৩ এপ্রিল ২০১০ বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা অসাংবিধানিক মর্মে যে রায় দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৫ এপ্রিল ২০১০ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায়কে ছয় সপ্তাহের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। পরবর্তীতে এই স্থগিতাদেশ নিয়মিত আপিল মামলা পর্যন্ত বর্ধিত হয়। সর্বশেষ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত ৭ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আপিল আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিতাদেশ জারি করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সংক্রান্ত এই আপীল মামলা যথাশীঘ্র নিষ্পত্তির জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও এটর্নী জেনারেল অফিসের আরো তৎপর ও উদ্যোগী হওয়া জরুরী বলে বলা যেতে পারে।
১৯তম বর্ষপূর্তিতে সরকারি ক্রোড়পত্র ও অপপ্রচার: সরকার প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বর্ষপূতি উপলক্ষ্যে ২ ডিসেম্বর ২০১৬ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। উক্ত ক্রোড়পত্রে বরাবরের মতো সরকার এবারও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে অসত্য বক্তব্য প্রদান করেছে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ১৯ বছর’ শিরোনামে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রমা রাণী রায়ের প্রবন্ধে পূূর্বের মিথ্যাচার পুনর্ব্যক্ত করে উল্লেখ করেন যে, “শান্তি চুক্তির শর্তানুযায়ী চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ইতোমধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ, ১৫টি ধারা আংশিক এবং অবশিষ্ট ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান আছে।” তিনি আরো বলেন, “ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়াধীন ৩০টি বিভাগ/বিষয় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে, ৩০টি বিষয়/বিভাগ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে এবং ২৮টি বিষয়/বিভাগ বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়েছে।” বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এখনো দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের এই বাস্তব চিত্র তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতির পক্ষ থেকে গত ১ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যেসব বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি তার বিবরণ” সম্বলিত ১৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন এবং তৎসঙ্গে সহায়ক দলিল হিসেবে ১৬টি পরিশিষ্ট সংযুক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর নিকট জমা দেয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে গোয়েবলসীয় কায়দায় অব্যাহতভাবে মিথ্যাচার করে চলেছে।
উল্লেখ্য যে, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মোট ৩৩টি বিষয়ের মধ্যে এযাবৎ ১৭টি বিষয়/বিভাগ হস্তান্তরিত হয়েছে। তম্মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্বে ১০টি বিষয়/বিভাগ হস্তান্তরিত হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যুব উন্নয়ন বিষয় (রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পরিষদে) এবং পূর্বে হস্তান্তরিত শিক্ষা বিভাগের অধীনে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে। মহাজোট সরকারের বর্তমান মেয়াদে ২০১৪ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা, জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান, জুম চাষ, পর্যটন (স্থানীয়) ইত্যাদি হস্তান্তরিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর (খাগড়াছড়ি পরিষদে), স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অধীনে নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কৃষি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ও তুলা উন্নয়ন বোর্ডের খাগড়াছড়ি কার্যালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের অধীন রামগড় মৎস্য খামার (হ্যাচারি) এবং সমাজকল্যাণ বিভাগের অধীন সরকারি শিশু সদন মোট ৭টি কর্ম/অফিস হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু পূর্বে হস্তান্তরিত বিষয়/বিভাগের অধীনস্থ উল্লেখিত ৭টি কর্ম/অফিসগুলোকে এক একটি স্বতন্ত্র বিষয়/বিভাগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে যথাক্রমে ৩০, ৩০ ও ২৮টি বিষয়/বিভাগ হস্তান্তর হয়েছে বলে পার্বত্য মন্ত্রণালয় অপপ্রচার চালাচ্ছে যার মধ্য দিয়ে এটা অনেকে ভুল ধারনা করতে পারেন যে, ৩৩টি বিষয়/বিভাগের মধ্যে অধিকাংশ বিষয়/বিভাগই হস্তান্তরিত হয়েছে। বস্তুত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের প্রথম তফসিলে তালিকাভুক্ত ৩৩টি বিষয়/বিভাগের মধ্যে মাত্র ১৭টি বিষয়/বিভাগ হস্তান্তরিত হয়েছে এবং এই ১৭টি বিষয়/বিভাগের অধীনে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে ৩০টি করে এবং বান্দরবানে ২৮টি কর্ম/অফিস রয়েছে। ‘বিষয়/বিভাগ’ এবং ‘কর্ম/অফিস’ এর মধ্যে উদ্দেশ্যে-প্রণোদিতভাবে গুলিয়ে ফেলে পার্বত্য মন্ত্রণালয় এই বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে চলেছে।
উক্ত ক্রোড়পত্রে অতিরিক্ত সচিব রমা রাণী রায়ের প্রবন্ধে “পার্বত্যাঞ্চলের দীর্ঘদিনের চলমান সংঘাতকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়” বলে উল্লেখ করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে ক্রোড়পত্রের কোথাও গুরুত্বারোপ করা হয়নি। সস্তা বাহবা অর্জনের জন্য এবং চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে ক্রোড়পত্রে সরকারের গৃহীত উন্নয়ন কার্যক্রমের ফিরিস্তি এবং চুক্তির ফলে সশস্ত্র সংঘাতের অবসানের কথাই ঘুরেফিরে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
ক্রোড়পত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণীতে বলা হয় যে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের জাতিগত হানাহানি বন্ধ হয়। অনগ্রসর ও অনুন্নত পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তি ও উন্নয়নের ধারা।” পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাহাড়ি (উপজাতীয়) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং তা সংরক্ষণের বিধান করা হয়েছে; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সমন্বয়ে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান করা হয়েছে, যে পরিষদগুলোর উপর সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন, পরিবেশসহ প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্পিত হয়েছিল; ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ও বহিরাগতদের নিকট প্রদত্ত ইজারা বাতিল, সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার, প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদেরকে সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এসব মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে যে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই রাজনৈতিক সমাধান এখনো অর্জিত হয়নি। অথচ ক্রোড়পত্রে এসব বিষয়ে কেউই তুলে ধরেনি। তার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয় যে, সরকার এসব মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে আন্তরিক তো নয়ই, মোটেই আগ্রহীও নয়।
পার্বত্যবাসীরা নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করবে সেরূপ স্পিরিট নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হলেও সেসব পরিষদের আইনগুলো এখনো যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হয়নি। ফলে এই পরিষদগুলো অনেকটা অর্থব প্রতিষ্ঠানে পরিণতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল পূর্ণাঙ্গ পরিষদ গঠনের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক মনোনীত চেয়ারম্যান-সদস্যদের নিয়ে অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী পরিষদের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে পরিচালনার ফলে এই পরিষদগুলো দুর্নীতি ও দলীয়করণের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যে পরিষদগুলোতে জনগণের অংশগ্রহণ নেই এবং যেখানে গণমানুষের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নেই, সেখানে যদি ‘স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্ব প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে’ বলে অতিরিক্ত সচিব রমা রাণী রায় তাঁর প্রবন্ধে যে দাবি করেছেন তা সত্যের অপলাপ ও অপপ্রচার বৈ কিছু নয়। অপরদিকে যেখানে পূর্বের মতো উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া উন্নয়নের মাধ্যমে এলাকার মানুষের অস্তিত্ব ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে দেয়, সেখানে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে এক নবযাত্রার শুভ সূচনা’ তো হতেই পারে না, উপরন্তু সেই ধরনের উন্নয়ন মানেই জুম্মদেরকে এধরনের চরম আতঙ্ক, উদ্বেগ ও বঞ্চনার মধ্যে ঠেলে দেয়।
চুক্তির মধ্য দিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগের সংঘাতের অবসান’ হলেও চুক্তির পর জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, আক্রমন, ভূমি বেদখল, স্বভূমি থেকে উৎখাত, বহিরাগত অনুপ্রবেশ, চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদের সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব ধ্বংস করা ইত্যাদি অব্যাহতভাবে চলছে। অথচ সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে “শান্তি চুক্তির সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর পারস্পরিক সহনশীলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে” বলে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি তাঁর বাণীতে পার্বত্য অধিবাসীদেরকে চরম পরিহাস করেছেন। অপরদিকে, যেখানে খাগড়াছড়ি ইউনিয়নের খেটে-খাওয়া নিরীহ কালিবন্ধু ত্রিপুরাকে অস্ত্র গুঁজে দিয়ে সন্ত্রাসী হিসেবে গ্রেফতার করে তার সাজানো ঘরসংসার তছনছ করে দেয়া হয়, যেখানে সেনা-পর্যটনের ফলে রুইলুই-এর দুই গ্রামের ৬৫ পরিবার ত্রিপুরাদের উচ্ছেদ আতঙ্কে অনিশ্চিত জীবন কাটাতে বাধ্য হয় বা রুমার বগালেকে বংশ পরম্পরায় বসবাসরত ৩১টি বম পরিবারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, সেখানে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা ক্রোড়পত্রে কিভাবে বলতে পারেন যে, ‘পার্বত্য জনপদে ফিরে আসে শান্তি ও স্বস্তি’? এ ধরনের বিধ্বংসী ঘটনা তিন পার্বত্য জেলায় সর্বত্রই অহরহ ঘটেই চলেছে। বস্তুত চরম দালালিপনা ব্যতীত স্বজাতির এই কঠিন সংকটে কেউ এ ধরনের নি:লজ্জ মিথ্যাচার করতে পারে না।
ক্রোড়পত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী তাঁর বাণীতে বলেছেন, “শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।” কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সত্যিই কি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে কাজ করছে? গত ২০ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে জাতীয় সংসদ ভবনে এ কমিটির সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এক বছরের অধিক কাল ধরে আর কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। কাগজে-পত্রে কমিটি গঠিত হলেও এ কমিটির নেই কোন অফিস, জনবল ও তহবিল। সুতরাং যে কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে চুক্তি বাস্তবায়ন করা এবং চুক্তির বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে পরিবীক্ষণ ও ত্বরান্বিত করা, সেই কমিটির অবস্থা যদি তথৈবচ হয় বা সেই কমিটি যদি অর্থব ও অচল হয়ে পড়ে থাকে, তাহলে সেই কমিটি কিভাবে ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে’ বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা যে একেবারেই অন্তসারশূণ্য তা বলাই বাহুল্য। আর এর মধ্য দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা সহজেই অনুমান করা যায়।
…………………
তারিখ: ৩১ জানুয়ারি ২০১৭।
মঙ্গল কুমার চাকমা; তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

Back to top button